হারিয়ে যাচ্ছে সৌরা ভাষা

'পরিবারের মধ্যে এই ভাষায় কেউ কথা বলতে পারে না, এতে করে আমিও সৌরা ভাষার অনেক শব্দ ভুলে গেছি। এখন আমরা অল্প কিছু শব্দ বলতে পারি,' কথাগুলো বলছিলেন সৌরা গ্রামের সবচেয়ে প্রবীণ বাসিন্দা ৮৫ বছরের সামরা সৌরা।
সৌরা সম্প্রদায়ের বেশিরভাগই বাংলা, ওড়িয়া ও সাদরি ভাষাতেই কথা বলেন। চা-বাগানে সৌরার থেকে ওড়িয়া ও সাদরি সম্প্রদায়ই বড়।
সামরা সৌরা বলেন, 'আঞ্চলিক ভাষায় আমরা বাড়িতে কথা বলি। আজকাল অনেকে এ ভাষাকে উড়িয়া বা জংলি ভাষার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলেন। আমাদের তাই কথা বলতে হয় বাংলা ভাষায়।'
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বিপন্ন হিসেবে যে ১৪টি ভাষাকে চিহ্নিত করেছে তার মধ্যে 'সৌরা' একটি। যাদের মাত্র ৭০টি পরিবার দেশে বাস করে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলার রাজগাট ইউনিয়নের সৌরা পল্লী গ্রাম থেকে ২০০ গজ দুরে ভারতের সীমান্ত পিলার ও ভারতের ত্রিপুরার বনবাজার। এই সৌরা পল্লীতে ২২টি সৌরা পরিবার রয়েছে।
তারা চা শ্রমিক হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষিত কেউ নেই। সংরক্ষণ ও চর্চার ব্যবস্থা না থাকায় হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষা, সংস্কৃতি আর ইতিহাস।
বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত 'আন্তর্জাতিক শিশু অধিকার সনদ' এর ৩০ নম্বর ধারায় উল্লেখ রয়েছে, 'যেসব দেশে জাতিগোষ্ঠীগত, ধর্মীয় কিংবা ভাষাগত সংখ্যালঘু কিংবা আদিবাসী সম্প্রদায়ের লোক রয়েছে, সেসব দেশে ওই ধরনের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত বা আদিবাসী শিশুকে সমাজে তার নিজস্ব সংস্কৃতি ধারণ, নিজস্ব ধর্মের কথা ব্যক্ত ও চর্চা করা, তার সম্প্রদায়ের অপরাপর সদস্যদের সঙ্গে ভাষা ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না।'
৬৫ বছর বয়সী আরতি সৌরা বলেন, 'আকাশের তারা দেখে বিয়ে করেছি। এটা ছিল আমাদের সংস্কৃতির অংশ। কিন্তু আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষা।'
'বিয়ের এই আচারের নাম ছিল সুংকরা,' তিনি বলেন।
'আমরা আমাদের বাচ্চাদের আমাদের ভাষা ও সংস্কৃতি শেখাতে চাই কিন্তু তারা শিখতে চায় না।'
সম্প্রদায়ের আরও ৩ সদস্য বলেন, তাদের ভাষা চিরতরে হারিয়ে যেতে বেশি সময় লাগবে না।
ষাটোর্ধ্ব যামিনী সৌরা বলেন, 'শুধু ২ জন প্রবীণই আমাদের ভাষায় কথা বলতে পারতেন। তাদের একজন দেড় মাস আগে মারা গেছেন। অন্যজন সবসময় অসুস্থ থাকেন এবং ঠিকমতো কথাও বলতে পারেন না। আমাদের ভাষা হারিয়ে যাবে, যখন তিনি মারা যাবেন।'
আলকুমার সৌরা (৫২) বলেন, 'আমরা আমাদের মাতৃভাষা রক্ষার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছি, কিন্তু কিছুই করা হয়নি।'
অস্ট্রো-এশিয়াটিক ভাষা সৌরা ভারতের উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, তামিলনাড়ু এবং বিহারেও পাওয়া যায়। এ ভাষার লিখিত রূপ আছে। অন্ধ্রপ্রদেশে সৌরা প্রাথমিক নামে একটি পাঠ্যপুস্তকও রয়েছে।
গবেষক পরিমল বারেক বলেন, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট আইন (২০১০) জাতিগোষ্ঠীর সকল ভাষার ভাষা সংরক্ষণ এবং লিখিত রূপ প্রবর্তনের ওপর জোর দিয়েছে।
তিনি বলেন, বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীদের উন্নয়নে কাজ করলেও তাদের ভাষা ও ঐতিহ্য সংরক্ষণে উদ্যোগ নেয় না। তাই এসব সংরক্ষণের জন্য সরকারকেই যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, এই কাজটা খুবই সামান্য এগিয়েছে৷ এ পর্যন্ত মাত্র ৫টি ভাষায় ৩টি করে বই হয়েছে৷ এ ছাড়া কোনো কাজই হয়নি৷ শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার কারিকুলাম, প্রশিক্ষণ এখনও কিছুই হয়নি৷
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের পরিচালক (ভাষা, গবেষণা ও পরিকল্পনা) শাফীউল মুজ নবীন দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমরা সার্ভে করেই এই বিপন্ন ভাষাগুলোর তালিকা করেছি। এ বিষয়ে আমরা একটি গবেষণা নীতিমালা তৈরি করেছি। যেটা এখন অর্থ মন্ত্রণালয়ে আছে। মন্ত্রণালয় থেকে ছাড় পেলেই এই ভাষাগুলো নিয়ে আগামী জুন-জুলাই মাসে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারবো।'
Comments