বিশ্বের ‘দরিদ্রতম প্রেসিডেন্টের’ বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প

উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা তার খামারবাড়ির সামনে। ছবি: আন্দ্রেস স্ট্যাপফ/রয়টার্স

উরুগুয়ের খুব সাধারণ একজন কৃষকের বাড়ির বাগানের একটি দড়িতে ছেঁড়া কাপড় দুলছে। একটি পুরনো গাড়ি ড্রাইভওয়েতে দাঁড়িয়ে আছে। টাকার না থাকার কারণে মালিক গাড়িটি ঠিক করতে পারছেন না। কারণ তিনি তার বেতনের বেশিরভাগই দান করেন। তবে এই বাড়িটি কোনো সাধারণ লোকের নয়। বাড়ির মালিক উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা। তাকে বিশ্বের সবচেয়ে 'দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট'ও বলা হয়।

বিবিসির মতে প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মুহিকা বসবাস করতেন জীর্ণশীর্ণ একটি ফার্মে। যেখানে তার পানির উৎস ছিল আগাছায় ঘেরা একটি কূপ। তার নিরাপত্তার জন্য প্রিয় দুটি কুকুর ছাড়া কিছু ছিল না।

মুহিকা বিলাসবহুল বাসস্থান প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে তিনি একটি কাঁচা রাস্তার পাশের সেই ছোট্ট বাড়িতে থাকবেন। আর এটা জনগণের কাছ থেকে প্রশংসা পাওয়ার জন্য কোনো অপপ্রচারও ছিল না। তিনি সবসময় যেভাবে জীবনযাপন করেছিলেন, সেভাবেই জীবনযাপন করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন।

বাড়ির সামনে প্রিয় দুটি কুকুর সহ হোসে মুহিকা। ছবি: ইনেস মারিয়া হিরিয়ার্ট

প্রেসিডেন্ট হিসাবে তার বেতন ছিল মাসে প্রায় ১২ হাজার ডলার। আর প্রতি মাসে তিনি তার বেতনের ৯০ ভাগই দাতব্য সংস্থা ও দরিদ্র এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের দান করতেন। একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাকে তার সম্পদ ঘোষণা করতে বলা হলে তিনি ২০১০ সালে দেখিয়েছিলেন তার মোট সম্পত্তি ১ হাজার ৮০০ ডলার।

মুহিকার সম্পদ বলতে পুরোনো একটি ১৯৮৭ ভি ডব্লিউ বিটল গাড়ি। ছবি: বিবিসি

নিজের জীবনধারা সম্পর্কে যা বলেন মুহিকা

মুহিকা গণমাধ্যমকে বলেন, 'আমাকে "দরিদ্রতম প্রেসিডেন্ট" বলা হয়। কিন্তু আমি অভাব অনুভব করি না। দরিদ্র মানুষ তারাই, যারা শুধুমাত্র একটি ব্যয়বহুল জীবনধারা বজায় রাখার চেষ্টায় কাজ করে এবং সর্বদা আরও বেশি চায়। আমার জীবনের বেশিরভাগ সময় এভাবেই কাটিয়েছি এবং আমার যা আছে তা নিয়ে আমি ভালভাবে বাঁচতে পারি।'

মুহিকার জন্ম ১৯৩৫ সালের ২০ মে। আট বছর বয়সে তিনি বাবাকে হারান। মৃত্যুর আগে তার বাবা দেউলিয়া হয়েছিল। বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের জন্যে মুহিকা একটি স্থানীয় বেকারিতে কাজ শুরু করেন এবং সঙ্গে ফুল বিক্রি করেন। ছোটো থেকে বেশ দয়ালু ছিলেন মুহিকা।

মুহিকা তার স্ত্রীর খামারে বসবাস করাকে বেছে নিয়েছিলেন। ছবি: বিবিসি

২০ বছরের বয়সে মুহিকা গেরিলা গ্রুপ টুপামারোস নামে একটি বিপ্লবী দলে যোগ দেন। তাদের লক্ষ্য ছিল সরকারকে দুর্বল করা। সম্ভব হলে সরকারের পতন ঘটানো। এগুলো করার জন্য তারা কঠোরও হয়েছিলেন। অপহরণ এবং হত্যা পর্যন্ত করেছিল এবং রবিন হুডের মতো ধনীদের কাছ থেকে চুরি করে এবং কখনো কখনো ব্যাংক বা স্থানীয় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে ডাকাতি করে গরীবদের বিলিয়ে দিতেন।

১৯৬৯ সালের মুহিকা মন্টেভিডিওর রাজধানীতে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টে ডাকাতির জন্য প্রবেশ করে চিৎকার করে বলেন, 'ঘুরে দাঁড়াও, মুখ বন্ধ করো এবং মাথার উপরে হাত রাখো!'

সেসময় মুহিকা একটি হুইলচেয়ারে বসা পোলিও আক্রান্ত এক নারীকে দেখতে পান। তাকে উদ্দেশ্য করে মুহিকা বলেন, 'চিন্তা করবেন না। আপনার কিছু হবেনা।'

সেই বাড়িতে অস্ত্র ও মূল্যবান কাগজপত্র ছিল। বাড়িটির মালিক ছিলেন একজন নামকরা 'কুখ্যাত' বিচারক। তার ছোট ছেলে সেদিন বাড়িতে ছিল। অস্ত্রের মুখে আটক হওয়া সেই ছোট ছেলেটি বহু বছর পরে সেই মুহিকাকেই ভোট দিয়েছিলেন।

১৯৭০ সালের মার্চ মাসে মুহিকা একটি বারে মদপান করছিলেন। তখন ২ পুলিশ সদস্য তাকে দেখতে পান। সেখানে বন্দুকযুদ্ধ শুরু হয়। দুই পুলিশ গুলিবিদ্ধ হন। মুহিকার শরীরে ৬টি গুলি লাগে। অস্ত্রোপচারে তার জীবন রক্ষা পেলেও, তার পরবর্তী গন্তব্য ছিল জেল।

১৯৭১ সালে তিনি প্রায় ১০০ জন গেরিলাদের মধ্যে একজন ছিলেন যারা কারাগার থেকে কাছাকাছি একটি বাড়িতে সুড়ঙ্গ খনন করে পালিয়েছিলেন।মুহিকা পরে ধরা পড়েন। পরের বছর আবার পালিয়ে যান। পরবর্তীতে পুলিশ আবারো তাকে উজি মেশিনগানসহ গ্রেপ্তার করে।

১৯৭০ সালের শুরুর দিকে অনেকের কাছেই টুপামারোস অসহ্য হয়ে উঠছিল। ১৯৭৩ সালে উরুগুয়েতে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের সময় টুপামারোরা সংখ্যায় অনেক কমে যায়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয় বা বন্দী করা হয়। মুহিকা ১৪ বছর কারাগারে কাটিয়েছেন।

তিনি বলেন, তাকে বছরের পর বছর ধরে নির্জন কারাবাসে এবং প্রতিনিয়ত নির্যাতন ও যন্ত্রণায় রাখা হয়। তার স্বাস্থ্য এতটাই খারাপ হয়ে যায় যে জেল থেকে বেঁচে ফেরাও বেশ আশ্চর্যজনক।

পরবর্তীতে উরুগুয়েতে গণতন্ত্র ফিরে আসলে সাধারণ ক্ষমা চুক্তির অধীনে মুহিকাকে মুক্তি দেওয়া হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি এবং তার কিছু সাবেক গেরিলারা সিদ্ধান্ত নেয় তারা প্রকৃত রাজনীতি করবে এবং ভালো কিছু পরিবর্তন আনবে। তারা গড়ে তোলেন রাজনৈতিক দল মুভমেন্ট অব পপুলার পার্টিসিপেশন। মুহিকার ব্যক্তিত্বের কারণে তুলনামূলক যারা কম ধনী তাদের কাছে মুভমেন্ট অব পপুলার পার্টিসিপেশন অনেক জনপ্রিয় ছিল।

নিজ খামারে মুহিকা। ছবি: সংগৃহীত

মুহিকা প্রাণিসম্পদ, কৃষি এবং মৎস্যমন্ত্রী থেকে একজন সিনেটর হন এবং তারপরে ২০০৯ সালে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হন। ২০১০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত তিনি উরুগুয়ের ৪০তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

তবে উরুগুয়েতে মুহিকাকে সবাই মেনে নিয়েছিল বিষয়টি এমন নয়। মুহিকা বিদ্বেষীদের পরিমাণও কম ছিলনা। বিশেষ করে লিবারেল ধারার চিন্তা-ভাবনার জন্য তিনি নিজ দেশে বেশ সমালোচিত হয়েছেন। আবার কিছু লোক তার সহিংস অতীত জীবনেরও সমালোচনা করেন। তার ধারণাগুলো বেশ উচ্চ-মনোভাবাপন্ন বলেও আখ্যা দেওয়া হয়।

 

তথ্য সূত্র:

১. বিবিসি

২. দ্য ইনফোগ্রাফিক শো

৩. ব্রিটানিকা

Comments

The Daily Star  | English

Eid meat: Stories of sacrifice, sharing and struggle

While the well-off fulfilled their religious duty by sacrificing cows and goats, crowds of people -- less fortunate and often overlooked -- stood patiently outside gates, waiting for a small share of meat they could take home to their families

7h ago