মোনালিসার পেইন্টিং এত বিখ্যাত কেন

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার খ্যাতি পেইন্টিংটির নিজস্ব উৎকর্ষতা ও অন্যান্য ঘটনার মিলিত একটি ফল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মোনালিসার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৯০৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেইন্টিং হিসাবে বিবেচনা করা হয়।
মোনালিসা

লিওনার্দো দা ভিঞ্চির আঁকা মোনালিসার খ্যাতি পেইন্টিংটির নিজস্ব উৎকর্ষতা ও অন্যান্য ঘটনার মিলিত একটি ফল। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুসারে, মোনালিসার বর্তমান বাজার মূল্য প্রায় ৯০৮ মিলিয়ন ডলারেরও বেশি। মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল পেইন্টিং হিসাবে বিবেচনা করা হয়।

দর্শকরা যখন পেইন্টিংটি কাছ থেকে দেখে, তখন তারা একজন সাধারণ নারীর প্রতিকৃতি দেখে বিস্মিত হয়। তার হাসি এবং দৃষ্টি সম্পর্কে রহস্য লুকিয়ে আছে। পেইন্টিংটি সৃষ্টির প্রায় ৫০০ বছরেও বেশি হয়ে গেছে। এর ভ্রু এবং চোখের পাপড়ি বিবর্ণ হয়ে গেলেও মোনালিসার খ্যাতি সময়ের সঙ্গে বেড়েই চলেছে।

প্রশ্ন জাগতে পারে, তাহলে কীভাবে পেইন্টিংটি এই মর্যাদা অর্জন করেছে?

মনে করা হয়, লিওনার্দো ১৫০৩ বা ১৫০৪ সালে ফ্রান্সেসকো দেল গিওকন্ডো নামে এক ধনী ফ্লোরেনটাইন ব্যবসায়ীর অনুরোধে প্রতিকৃতিটি আঁকা শুরু করেছিলেন। সেই ব্যবসায়ী তার স্ত্রী লিসা দেল গেরাদিনির একটি প্রতিকৃতি চেয়েছিলেন। পেইন্টিংটি তার নতুন বাড়ির জন্য এবং তার দ্বিতীয় পুত্র আন্দ্রেয়ার জন্ম উদযাপনের জন্য করতে বলা হয়। তবে, বিশেষজ্ঞ ও স্কলারদের মধ্যে তাদের পরিচয় নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। নামকরণের ক্ষেত্রে সেই সময়ে ইতালিতে, মোনা মানে ম্যাডোনা, এভাবে সব নারীকে সম্বোধন করা হত। এখন যেমন মিসেস সম্বোধন করা হয়। এই মোনা থেকেই নামকরণ মোনালিসা হয়েছে।

লিওনার্দো ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পেইন্টিংটির কাজ চালিয়ে যান। তিনি মারা যাওয়ার সময় এটি অসমাপ্ত ছিল।

লিওনার্দো ছবি আঁকার যেসব কৌশল তৈরি করেছিলেন তার মধ্যে একটি ছিল স্ফুমাটো কৌশল, যার অনুবাদ করলে দাড়ায়, 'লাইন বা সীমানা ছাড়াই ধোঁয়ার পদ্ধতি'। তৎকালীন সময়ে শিল্পীদের জন্য রূপরেখা বা লাইন তৈরি করে আঁকা একটি সাধারণ চর্চা ছিল। সে জায়গায় লিওনার্দো লাইন বা রূপরেখা ব্যবহার করেননি। আলো এবং ছায়ার বিভ্রম তৈরি করতে বিভিন্ন রঙ ব্যবহার করেছিলেন। যেখানে তিনি কাছের সাবজেক্টগুলোকে স্পষ্ট, আর দূরের সাবজেক্টগুলোকে আস্তে আস্তে দূরত্ব বাড়ার সঙ্গে সেঙ্গ অস্পষ্ট করে তোলেন।

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

মোনালিসার বিশ্বব্যাপী আকর্ষণের আরেকটি অন্যতম জনপ্রিয় কারণ হল হাসি। লিওনার্দো দৃষ্টিকোণ এবং ছায়ার কাজের মাধ্যমে এমন একটি অনন্য হাসি তৈরি করেন, যা একধরনের অপটিকাল ইলিউশন তৈরি করে। দর্শক যখনই মোনালিসার চোখের দিকে তাকায়, মুখ হাসির মতো দেখায়। কিন্তু যখন দর্শকের দৃষ্টি হাসির উপর স্থির হয়, এটি ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে যায়। যেন এটি কখনই হাসি ছিল না। আবার হাসির বিভিন্ন ব্যাখ্যাও আছে, কেউ কেউ মনে করে যে, এটি একটি সুখী হাসি। আবার অনেকে বিশ্বাস করে এটি একটি দুঃখের হাসি৷

মোনালিসা কে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত চিত্রকর্মে পরিণত করার জন্য এগুলো কি যথেষ্ট?

অনেক বিশেষজ্ঞ অবশ্য উল্লেখ করেছেন যে মোনালিসার নিজস্ব গুণগুলো পেইন্টিংটিকে বিখ্যাত বানানোর জন্য যথেষ্ট ছিল না। এর সমসাময়িক অনেক ভাল পেইন্টিংও আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ এটিকে রেনেসাঁর একটি অসামান্য প্রতিকৃতি বলে মনে করেন। মোনালিসার উত্থান মূলত ক্যানভাসের বাইরের অনেকগুলো কারণের উপর নির্ভরশীল। বাহ্যিক ঘটনাগুলো সামষ্টিকভাবে শিল্পকর্মটির খ্যাতিতে অবদান রেখেছিল।

লিওনার্দো ছিলেন ফ্রান্সের রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের দরবারের একজন সদস্য। রাজা ফ্রান্সিস পরবর্তীতে পেইন্টিংটি কিনেছিলেন এবং লিওনার্দোর মৃত্যুর পর তা প্রদর্শন শুরু করেছিলেন। লিওনার্দো তার সমসাময়িক সময়ে একজন বিখ্যাত ব্যক্তি ছিলেন। তাই তার খ্যাতি মোনালিসার উপরও ছড়িয়ে পড়ে। যেটি পরবর্তীতে পৃষ্ঠপোষক রাজা ফ্রান্সিস দ্বারা আরও বেড়ে যায়।

১৫৫০ সালে ইতালীয় পণ্ডিত জর্জিও ভাসারি ইতালীয় রেনেসাঁ শিল্পীদের নিয়ে একটি জনপ্রিয় জীবনী প্রকাশ করেন। সেখানে লিওনার্দোও অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। বইটি ব্যাপকভাবে অনূদিত ও বিতরণ করা হয়। এতে মোনালিসাকে 'জীবনের সম্মোহনী অনুলিপি' হিসেবে এর বর্ণনা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে পেইন্টিংটি রাজকীয় সংগ্রহের অংশ হয়ে ওঠে। কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত প্রতিকৃতিটি ফরাসি প্রাসাদগুলোতে নির্জন অবস্থায় ছিল। ফরাসি বিপ্লবে রাজকীয় সংগ্রহটিকে জনগণের সম্পত্তি হিসাবে দাবি করা হয়। এটি নেপোলিয়নের বেডরুমেও ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল। মোনালিসাকে অবশেষে ফ্রান্সের ল্যুভর মিউজিয়ামে সর্বজনীন প্রদর্শনের জন্য নেওয়া হয়। এখানে দর্শনার্থীরা সিংহাসনচ্যুত অভিজাতদের একসময়ের ব্যক্তিগত সম্পদ দেখতে ভিড় জমায়।

১৯ শতকের রোমান্টিক যুগে, চিত্রিত একজন সাধারণ ফ্লোরেন্টাইন গৃহবধূকে একজন রহস্যময় সম্মোহনীতে রূপান্তরিত হয়েছিল। ১৮৫৪ সালে, আলফ্রেড ডুমেসনিল বলেছিলেন, মোনালিসার হাসি একটি 'বিশ্বাসঘাতক আকর্ষণ' দেয়। এক বছর পর থিওফিল গহতিয়া তার 'বিদ্রুপকারী ঠোঁট' এবং 'অজানা আনন্দের প্রতিশ্রুতিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকানো' সম্পর্কে লিখেছিলেন। ১৮৬৯ সালে ওয়াল্টার পেটার মোনালিসাকে 'নারী সৌন্দর্যের নিরন্তর মূর্ত প্রতীক' হিসাবে বর্ণনা করেন।

১৯ শতকে প্রতিভাবান পলিম্যাথ লিওনার্দোকে একজন পৌরাণিক চরিত্রে পরিণত করা হয়। তার মৃত্যুর পর শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে, তাকে বেশ ভালোভাবেই সম্মানিত করা হয়। লিওনার্দোকে শুধু একজন ভালো চিত্রশিল্পী হিসেবেই নয় বরং একজন মহান বিজ্ঞানী এবং উদ্ভাবক হিসেবেও তখন মনে করা হতো। ফলস্বরূপ তিনি 'দ্যা রেনেসাঁ ম্যান' হয়ে ওঠেন। আর এভাবে লিওনার্দো একজন প্রতিভাবান হিসেবে ২১ শতকেও মোনালিসার জনপ্রিয়তায় অবদান রেখে চলেছেন।

ভিনসেনজো পেরুজিয়া ১৯১১ সালে আগস্টে ল্যুভর মিউজিয়াম থেকে মোনালিসার পেইন্টিংটি চুরি করেন। তারপর থেকে মোনালিসার খ্যাতি আরও বেড়ে যায়। ১৯ শতকের লেখকরা মানুষের মধ্যে মোনালিসার প্রতি আগ্রহ জাগিয়েছিলেন। ১৯১১ সালে চিত্রকর্মটির চুরি এবং পরবর্তীতে মিডিয়ার সেনসেশনালাইজেশন এর প্রতি বিশ্বব্যাপী দৃষ্টি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। চুরির এই ঘটনা আন্তর্জাতিক শিরোনামে পরিণত হয়। একসময় ঝুলিয়ে রাখা মোনালিসার ফাঁকা স্থানটি দেখার জন্যে লোকজন জড়ো হতে থাকে।

ভিনসেনজো পেরুজিয়া। ছবি: পাবলিক ডোমেইন

পুলিশ পেরুজিয়ার জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কারণ তিনি ল্যুভর মিউজিয়ামে কাজ করতেন। তবে কেউ তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে মনে করেননি। পাবলো পিকাসোকে ল্যুভর মিউজিয়ামের পূর্বের এক চুরির সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে এবারও তাকে সন্দেহভাজন হিসেবে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। শেষ পর্যন্ত তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

পেরুজিয়া মিডিয়ার কারণে পেইন্টিংটি বিক্রি করতে পারছিলেন না। দুই বছর ধরে পেরুজিয়া পেইন্টিংটিকে স্যুটকেসের একটি ফলস-বটমের মধ্যে রেখেছিলেন। তারপরে তিনি এটিকে ইতালিতে পাচার করেন এবং ফ্লোরেন্টাইনে একজন শিল্প ব্যবসায়ীর কাছে এটি বিক্রি করার ব্যবস্থা করেন। পেরুজিয়া নিজেকে একজন ইতালীয় দেশপ্রেমিক হিসেবে মনে করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন একজন পুরানো মাস্টারের কাজ তার দেশে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু তাকে নিয়ে উদযাপনের পরিবর্তে তাকে অবিলম্বে গ্রেপ্তার করা হয়। অবশেষে দুই বছর পর ইতালিতে পেইন্টিংটি পাওয়া যায়। এর আগে ফ্লোরেন্সের সেই শিল্প ব্যবসায়ী স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে সতর্ক করেন যে, একজন ব্যক্তি এটি বিক্রি করার বিষয়ে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন।

ল্যুভর মিউজিয়ামে পেইন্টিংটি ফিরিয়ে আনার আগে এটি ইতালির বিভিন্ন জায়গায় প্রদর্শন করা হয়। ফরাসিরা এটিকে একটি জাতীয় সম্পদ হিসাবে বিবেচনা করে।

কন্সেপচুয়াল শিল্পী মার্সেল ডুচ্যাম্প মোনালিসাকে নিয়ে উপহাস করেছিলেন। তিনি শিল্পের উপাসনার বিরুদ্ধে গিয়ে তখন মোনালিসার মুখে দাড়ি এবং গোঁফ আঁকেন এবং পেইন্টিংটির নিচে এল.এইচ.ও.ও.কিউ (ফরাসি ভাষায় একটি অশ্লীল বাক্যাংশ উদঘাটন করার অর্থে ব্যবহৃত হয়) লিখে প্রচার করেন। সালভাদর ডালি এবং ওয়ারহোলের মতো শিল্পীরাও তাদের নিজস্ব পুনরুৎপাদনের মাধ্যমে ছবিটি ছড়িয়ে দিতে থাকেন। শিল্পীরা মোনালিসার পুনরুৎপাদনকে বিকৃত করার সঙ্গে সঙ্গে কার্টুনিস্ট এবং অ্যাডম্যানরাও একে নিয়ে কিছুটা বাড়াবাড়ি করে।

এর পরের কয়েক দশক ধরে, প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পেইন্টিংটি পুনরুৎপাদন করা হয়। আর এর সঙ্গে বসে থাকা মানুষের মুখটি বিশ্বে সবচেয়ে সুপরিচিত হয়ে ওঠে।

মোনালিসা সবসময়ই কোনো না কোনো গুরুত্বপূর্ণ স্থানে প্রদর্শিত হয়ে আসছে। ১৫১৯ সালে রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের প্রিয় দুর্গ ফন্টেইনব্লুতেও এটি জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হত। ১৮০০ সালে মোনালিসাকে নেপোলিয়নের বেডরুমে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। বর্তমানে মোনালিসাকে ল্যুভরে রাখা হয়েছে।

মোনালিসা নিঃসন্দেহে একটি ভালো পেইন্টিং হলেও এর এত জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে কোনো একক কারণ নেই। বরং এটি বিভিন্ন পরিস্থিতি ও ঘটনার সমন্বিত ফসল। যা মোনালিসাকে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত পেইন্টিংয়ে পরিণত করেছে।

তথ্য সূত্র

১. ব্রিটানিকা

২. টেড এড

৩. সাইন্স এবিসি

Comments