চেরনোবিলের পরিত্যক্ত এলাকায় যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ইউক্রেন

ইউক্রেনের চেরনোবিলে ১৯৮৬ সালে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটেছিল। তখন থেকে এ অঞ্চলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী বেলারুশ থেকে কয়েক মাইল দূরেই এই ভুতুড়ে শহরের অবস্থান। দীর্ঘদিন পর ‘চেরনোবিল বিপর্যয়ের’ জন্য বিখ্যাত এই প্রাচীন শহর এখন আলোচনায়। রাশিয়ানরা চেরনোবিল থেকে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত, সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র বেলারুশে হাজারো সৈন্য মোতায়েন করেছে।
চরনোবিলের পরিত্যাক্ত এলাকায় ইউক্রেনের সৈন্যদের যুদ্ধের মহড়া দেখছেন সাংবাদিকরা। ছবি: সিএনএন

ইউক্রেনের চেরনোবিলে ১৯৮৬ সালে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়াবহ পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটেছিল। তখন থেকে এ অঞ্চলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেনের সীমান্তবর্তী বেলারুশ থেকে কয়েক মাইল দূরেই এই ভুতুড়ে শহরের অবস্থান। দীর্ঘদিন পর 'চেরনোবিল বিপর্যয়ের' জন্য বিখ্যাত এই প্রাচীন শহর এখন আলোচনায়। রাশিয়ানরা চেরনোবিল থেকে স্বল্প দূরত্বে অবস্থিত, সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র বেলারুশে হাজারো সৈন্য মোতায়েন করেছে।

ফলে বাধ্য হয়ে ইউক্রেন চেরনোবিলকে সামরিক প্রশিক্ষণের কাজে ব্যবহার করছে।

অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে ইউক্রেন আসন্ন বিপর্যয় মোকাবিলায় আরেক ঐতিহাসিক ও ভয়াবহ বিপর্যয়ের সাক্ষী চেরনোবিলকেই বেছে নিয়েছে। 

রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিন বারবার বলছেন, তাদের ইউক্রেনে হামলা চালানোর কোনো পরিকল্পনা নেই। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, সৈন্য মোতায়েনের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে, বেলারুশের সঙ্গে আগামী বৃহস্পতিবার থেকে শুরু হতে যাওয়া যৌথ সামরিক মহড়ায় যোগ দেওয়া।

তবে স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা স্থিরচিত্রে দেখা গেছে ইউক্রেনের সীমানার কাছে রাশিয়ানরা সামরিক ক্যাম্প বসিয়েছে, যে অঞ্চলটি মহড়ার জন্য নির্ধারিত স্থান থেকে কয়েক শ মাইল দূরে।

যদি রাশিয়া ইউক্রেন আক্রমণ করতে চায়, তাহলে তারা রাজধানী কিয়েভে পৌঁছানোর জন্য চেরনোবিলের পরিত্যক্ত অঞ্চলকে ব্যবহার করতে পারে। মার্কিন ও ন্যাটোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে বেলারুশে আনুমানিক ৩০ হাজার সৈন্য মোতায়েন করেছে রাশিয়া। জানুয়ারির শুরুতে এ সংখ্যা ৫ হাজার ছিল।

ছবি: সংগৃহীত

ন্যাটোর সচিব জেনারেল ইয়েন্স স্টল্টেনবার্গ গত বৃহস্পতিবারে জানিয়েছেন, মার্কিন-রাশিয়া স্নায়ুযুদ্ধের পর এটাই রাশিয়ার সবচেয়ে বড় আকারের সৈন্য মোতায়েনের ঘটনা। মোতায়েন করা সৈন্যদের বেশ বড় একটি অংশ কিয়েভ থেকে মাত্র ২ ঘণ্টা গাড়ি চালানোর দূরত্বে অবস্থান নিয়েছে।

প্রোপাগান্ডা যুদ্ধ

ইউক্রেনের জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা শহরজুড়ে বিভিন্ন ভবনের জানালাগুলোর সঙ্গে বসানো প্লাইউডের তৈরি কাঠামোতে হাজারো রাউন্ড গুলিবর্ষণ করে মহড়া করছেন।

অ্যাপার্টমেন্ট ব্লকের উঁচুতে স্থাপিত লক্ষ্যবস্তুর দিকে অব্যর্থ বুলেট চালাচ্ছেন একজন স্নাইপার। বরফে আচ্ছাদিত খোলা জায়গায় মর্টারের শেল ছুঁড়ে মারা হচ্ছে। একটি সাঁজোয়া গাড়ি রোডব্লক পেরিয়ে একটি দালানের দোতলায় লুকিয়ে থাকা আক্রমণকারীদের উদ্দেশে ছুটে যাচ্ছে।

এসবই যেন যুদ্ধ প্রশিক্ষণের আড়ালে হলিউডি সিনেমার প্রদর্শনী কিংবা কাল্পনিক তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর নির্মিত কোনো ভিডিও গেমসের দৃশ্য। 

৩৫ বছরেরও বেশি সময় আগে, ভ্লাদিমির লেনিন পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র বিস্ফোরিত হয়ে ছড়িয়ে পড়া তেজস্ক্রিয়তার কারণে পুরো এলাকার মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়। বিস্ফোরণে ৩১ জন মানুষের মৃত্যু হয় এবং আরও কয়েক লাখ মানুষ তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সংস্পর্শে আসেন। দীর্ঘমেয়াদী স্বাস্থ্য সমস্যায় মৃতের সংখ্যা ২ লাখেরও বেশি বলে অনুমান করা হয়।

২০২২ সালে ইউক্রেন তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেখার জন্য সারা বিশ্বের গণমাধ্যমগুলোকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে।

ইউক্রেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ডেনিস মোনাস্টিরস্কি সাংবাদিকদের জানান, নিরাপত্তা বাহিনী চেরনোবিল মহড়ার সদ্ব্যবহার করে সবাইকে দেখাচ্ছে, ইউক্রেনের নগরভিত্তিক যুদ্ধ কৌশল কতটা অত্যাধুনিক হয়েছে।

এই যুদ্ধ কৌশলের প্রদর্শনীকে যতটা না প্রস্তুতি মনে হচ্ছে, তার চেয়ে একে রাশিয়ার প্রোপাগান্ডার জবাব হিসেবেই বেশি যুতসই মনে হচ্ছে।

সংকটের শুরু

রাশিয়া বারবার ন্যাটোকে এ সংকটের জন্য দায়ী করে গেছে। তাদের যুক্তি, পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর শক্তি বৃদ্ধি ও সম্প্রসারণ পুরো অঞ্চলের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি। ইতোমধ্যে, রাশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন প্রোপাগান্ডামূলক ভিডিও বানিয়ে ছড়িয়ে দিচ্ছে। যেখানে দেখা যাচ্ছে, বড় বড় ট্যাংক সর্বোচ্চ গতিতে বরফ ঢাকা পাহাড়ি অঞ্চলের মধ্য দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আর বোমারু বিমান দক্ষিণ বেলারুশের সামরিক ঘাঁটির ওপর উড়ছে।

এখনো ইউক্রেনের প্রতি রাশিয়ার হুমকি ঠিক কতটুকু, তা অনিশ্চিত। এ বিষয় নিয়ে প্রচুর তর্ক-বিতর্ক করছেন বিশেষজ্ঞরা, কিন্তু কারও কাছেই নেই সঠিক উত্তর।

ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকেই মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন ও তার প্রশাসনের অন্যান্য কর্মকর্তারা বলে আসছেন, যেকোনো মুহূর্তে ইউক্রেনে আক্রমণ করতে পারে রাশিয়া। তবে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা এটি মেনে নেননি এবং তারা বলছেন এ ধরণের আতংক সৃষ্টিকারী ভাষার ব্যবহার তাদের অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলছে।

ছবি: সংগৃহীত

চেরনোবিলের সামরিক মহড়া পর্যবেক্ষণের পর প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওলেকসি রেজনিকভ মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনকে জানান, উভয় পক্ষের (ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র) কাছেই একই তথ্য আছে। কিন্তু অনুমান ও পূর্বাভাসের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য।

ইতোমধ্যে হোয়াইট হাউজ থেকে জানানো হয়েছে, তারা আর 'যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ' বা 'আক্রমণ আসন্ন'-এর মতো ভাষা ব্যবহার করবেন না। কারণ এ ধরনের ভাষা ব্যবহার নিয়ে আপত্তি এসেছে। তাদের মতে, আক্রমণ আসন্ন বললে বোঝা যায় পুতিন ইতোমধ্যে ইউক্রেন আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন।

তবে ইউক্রেনের কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, বেলারুশে রাশিয়ার সামরিক শক্তিমত্তার প্রদর্শনী চিন্তিত হওয়ার মতো একটি বিষয়।

সবশেষ পরিস্থিতি

ইউক্রেন, বেলারুশ ও রাশিয়া—এই ৩ দেশের সীমান্ত যেখানে মিশেছে, সে এলাকায় বসবাসকারী ইউক্রেনের নাগরিকদের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে তেমন কোনো দুচিন্তা নেই। তারা ভাবছেন, পুতিন কখনোই বেসামরিক এলাকার ওপর আক্রমণ চালাবেন না। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় তারা সাম্প্রতিক সময়ের ঘটনাগুলোকে 'রাজনীতির খেলা' বলে আখ্যায়িত করেন। তারা 'এসব' নিয়ে ভাবেন না বলেও জানান।

ইতোমধ্যে স্যাটেলাইট থেকে ধারণ করা ছবিতে বেলারুশের বিভিন্ন অংশ, পূর্ব রাশিয়া ও ক্রিমিয়াতে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ার প্রমাণ পাওয়া গেছে। মাক্সার এবং অন্যান্য স্যাটেলাইট ইমেজ সেবাদাতারা জানিয়েছে, গত ২-৩ মাসে ইউক্রেনের সীমান্তের ১৫০ মাইলের মধ্যে রাশিয়ার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও সৈন্যদের ঘাঁটির কলেবর বাড়ানো হয়েছে।

আকাশপথ ও প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা প্রতিষ্ঠান রোচ্যাং কনসাল্টিংয়ের রাশিয়া ও বেলারুশ বিষয়ক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক কনরাড মুজাইকা জানিয়েছেন, তিনি বিশ্বাস করেন ইউক্রেনের আশেপাশে ৭৪ থেকে ৭৬টি রাশিয়ান ব্যাটেলিওন ট্যাকটিকাল গ্রুপ (বিটিজি) রয়েছে।

প্রতিটি বিটিজিতে সাধারণত প্রায় ১ হাজার সৈন্য থাকে। তাদের সঙ্গে সহায়তাকারী ইউনিটও থাকে।

মুজাইকা একটি লিখিত বক্তব্যে আরও জানান, প্রায় ১৫ থেকে ২০ বিটিজি সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছে।

পুতিন জানিয়েছেন, তারা আক্রমণ করতে চান না। তবে বাইডেন বলছেন, যেকোনো মুহূর্তে আক্রমণ আসতে পারে, আর ইউক্রেনের কর্মকর্তারা পুরো বিষয়টিকে হালকা করার চেষ্টা করছেন।

সারা বিশ্ব এখন মেতে আছে নানারকম জল্পনা-কল্পনায় এবং বরাবরের মতো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর সবার নজর।

 

Comments

The Daily Star  | English

High Temperature Days: Barring miracle, record of 76yrs breaks today

At least 23 days of this month were heatwave days, which equals the record set in 2019 for the entire year.

11h ago