দেশে দেশে ঈদ

'ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ!' কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই অমর সৃষ্টিই যেন দীর্ঘ ১ মাস সিয়াম সাধনার পর পবিত্র ঈদুল ফিতরের আনন্দকে বাড়িয়ে তোলে দ্বিগুণ করে। মাসব্যাপী রোজা রাখার পর ইসলাম ধর্মাবলম্বী মানুষ পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেন। তবে অঞ্চলভেদে, স্থানভেদে ঈদ পালনেও আছে বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা।
চলুন জেনে নেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কীভাবে উদযাপিত হয় ঈদ-
বাংলাদেশ

বাংলাদেশে ঈদ উদযাপন হয় আড়ম্বরপূর্ণভাবে। নতুন পোশাক পরে পুরুষেরা ঈদগাহে নামাজ পড়তে যান, নামাজ শেষে বন্ধু, আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী সবার সঙ্গে 'ঈদ মুবারক' বলে কোলাকুলি করে থাকেন। মেয়েরা ঈদের আগের রাতে হাত রাঙায় মেহেদির রঙে। বাড়িতে রান্না হয় মজাদার সব খাবার। নানাজাতের সেমাই, পায়েস, এছাড়া হালিম, চটপটি, ফুচকাও আজকাল ঈদের খাবারে রাখা হচ্ছে। ভারী খাবার হিসেবে পোলাও, কোর্মা, মুরগির রোস্ট ও বিরিয়ানির প্রচলন আছে। বাড়ির বয়স্করা পরিবারের ছোট সদস্যের 'ঈদি' বা 'সালামি' দিয়ে থাকেন। ঘরে ঘরে সবাই ঈদের শুভেচ্ছা জানানোর মাধ্যমে ঈদ হয়ে ওঠে পাড়া-প্রতিবেশীদের খবর নেওয়ার অন্যতম মাধ্যম।
বাংলাদেশে একক পরিবারের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকলেও ঈদের ছুটিগুলোতে পরিবারের সবাইকে নিয়ে ঈদ করার প্রবণতা দেখতে পাওয়া যায়। এজন্য ঈদের সময় রাস্তায় যানজট হয় অন্যান্য সময়ের চেয়ে অনেক বেশি।
ভারত, পাকিস্তান

ভারত, পাকিস্তানের ঈদ উদযাপনের রীতি অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। ভারতে ঈদের দিন স্কুল-কলেজ, ইউনিভার্সিটি, সরকারি অফিস আদালত এমনকি কিছু কিছু দোকান-পাট ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ থাকে। রাষ্ট্রীয়ভাবে একদিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। ঈদগাহ ও বড় বড় জামে মসজিদগুলোতে ঈদের জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। বড়দের সালাম দিয়ে ছোটরা পেয়ে থাকে ঈদের সালামি। খাবারের মধ্যে থাকে মাংস, পোলাও, রুটি, পরোটার মতো মজাদার ও মুখরোচক সব খাবার।
পাকিস্তানে ঈদের দিন সকালে পরিবারের সবাই এক হয়ে বিভিন্ন ধরনের মিষ্টি বা মিষ্টিজাতীয় খাবার, ঐতিহ্যবাহী শির-কোরমা দিয়ে নাশতা করে। টিভির পর্দায় সারাদিন ঈদ ঘিরে থাকে নানা আয়োজন। অনেকে পার্ক, মনোরম স্থান ও সাগর তীরে ঘুরতে যায়।
সৌদি আরব

সৌদি আরবে ঈদুল ফিতর উদযাপিত হয় ভিন্নভাবে। ঈদের দিন পুরুষেরা 'কান্দর' নামের সাদা পোশাক পরিধান করেন মাথায় দেয় 'গাহফিহ' নামের টুপি। নারীরা এই দিনে 'থাউব' নামের বিশেষ পোশাক পরে থাকেন। ঈদের দিন সৌদি মুসলিমরা বাজার থেকে বেশি পরিমাণে চাল কিনে আনেন। আর তা বাড়ির প্রবেশ দরজার বাইরে রেখে দেয়। যাতে অসহায় ও অভাবগ্রস্ত মানুষ তা নিয়ে প্রয়োজন মেটাতে পারেন। এছাড়াও এই দিনটিতে গরিবদের মাঝে খাবার বিতরণ করা হয়। ঈদ উপলক্ষে দেশটিতে তিন দিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের নামাজ শেষে বাড়িতে বিশেষ খাবার রান্না হয়।
তুরস্ক

সাংস্কৃতিক প্রাচুর্য্য ও ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ তুরস্কে অত্যন্ত জমকালো উপায়ে ঈদ উদযাপন হয়ে থাকে। ঈদের দিনকে তুর্কীরা 'রামাদান বেরামি' বা রামাদান উৎসব ও 'সেকার বেরামি' বা মিষ্টির উৎসব বলে আখ্যায়িত করেন। শিশুরা ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য বাড়ি বাড়িতে ঘুরে বেড়ায়, এ সময় তাদের 'টার্কিস ডিলাইট', 'বাকলাভা' সহ অন্যান্য মিষ্টি খেতে দেওয়া হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে শিশুদের আনন্দ দেওয়ার জন্য 'শ্যাডো পাপেট শো'র ব্যবস্থা করা হয়। এ ছাড়া, ঈদের নামাজ, কোলাকুলি, ঈদ সালামি, কবর জিয়ারত তো আছেই। বড়দের ডান হাতে চুম্বনের মাধ্যমে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করা হয়।
ইন্দোনেশিয়া

বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম দেশ ইন্দোনেশিয়া। ঈদের দিনকে ইন্দোনেশিয়ায় বলা হয় 'হারি রায়া ঈদুল ফিতরি'। এ দিনটি 'লেবারান' হিসেবেও পরিচিত। ঈদের দিনে তারা বিগত বছরের কৃতকর্মের জন্য আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুদের কাছে ক্ষমা চায়। ঈদের এই বিশেষ দিনটিতে নারীরা পরে 'কেবায়া কুরঙ্গ' আর পুরুষরা পরে 'বাজু কোকো', যা সে দেশের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। ঈদের দিন বিশেষ খাবার হিসেবে তারা কেতুপাত, দোদোল, লেমাং নামের বিভিন্ন খাবার রান্না করেন। ঘর সাজাতে তারা 'পেলিটাস' বা প্রদীপ জ্বালিয়ে থাকেন।
মালয়েশিয়া

ঈদের দিন মালয়েশিয়ার মুসলমানরা সে দেশের ঐতিহ্য অনুযায়ী ওপেন হাউস পালন করে অর্থাৎ এদিন যে কেউ কারো বাড়িতে অতিথি হয়ে আসতে পারেন। মুখরোচক বিভিন্ন ধরনের খাবার রান্না হয় ঘরে ঘরে। খাবার তালিকায় থাকে মাংসের তৈরি 'রেনডাং', কাবাব বা 'কেটুপাত', 'ডোডল' বা এক ধরনের মিষ্টি। এ ছাড়াও সে দেশের বিশেষ ঐতিহ্য বাঁশের মধ্যে রান্না করা ভাত, যা 'লেমাং' নামে পরিচিত। এ ছাড়া ঈদের নামাজ, কুশল বিনিময়, সালামি দেওয়া, কবর জিয়ারত তো আছেই।
মিশর

ঈদ উদযাপনে পিরামিডের দেশ মিশর যেন অন্যান্য দেশের চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে। এখানে ঈদ উদযাপন করা হয় টানা চার দিন। আর এই পুরো সময়টা জুড়ে মজাদার সব মাছের রান্না ঈদ উৎসবকে করে তোলে আরও প্রাণবন্ত। নীলনদের দেশ মিশরের অন্যতম একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার হলো 'ফাতা' যা ভাত, মাংস, পেঁয়াজ, ভিনেগার সবকিছুর মিশ্রণে রান্না করা হয়। ফাতার পাশাপাশি 'কাহক' নামের আরেকটি দারুণ জনপ্রিয় কুকি বা বিস্কুট ছাড়াও মিশরীয়দের ঈদ একেবারেই জমে না।
আফগানিস্তান

ঈদের দিনে আফগানরা অতিথিদের খেতে দেন 'জালেবি' নামের এক বিশেষ খাবার। আর 'তখম জাঙ্গি' আফগানদের ঈদ উদযাপনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 'তখম জাঙ্গি' হলো পুরুষেরা ফাঁকা ময়দানে একত্রিত হয়ে একজন আরেকজনের দিক সিদ্ধ ডিম ছোড়া। ছোটরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করে। এ সময় তারা বলতে থাকেন, 'খালা ঈদেত মোবারক'। সিএনএনের খবর অনুযায়ী, আফগানিস্তানে যখন তালেবানরা ব্যাপক আক্রমণ শুরু করেছিল, তখনো আফগানিরা ঈদের দিন ঠিকই ডিম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ঐতিহ্য বজায় রেখেছেন।
ইরাক

রমজান এবং ঈদের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিটি উৎসবে ইরাকিরা খেজুরের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। 'ক্লাইচা' নামের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার ইরাকে খুব প্রচলিত যা না থাকলে ইরাকিদের কোনো অনুষ্ঠানই পূর্ণতা পায় না। ক্লাইচা মূলত এক ধরনের কুকি যা বাদাম, খেজুর এবং গুলকন্দ দিয়ে বানানো হয়।
রাশিয়া
বিশ্বের সর্ববৃহৎ আয়তনের দেশ রাশিয়ায় ঈদ উদযাপন হয় ভাবগাম্ভীর্য আর আড়ম্বরপূর্ণভাবে। ঈদের দিন ঈদগাহে বসে নামাজ শেষে দেশবাসী ও মুসলিম জাহানে শান্তির জন্য দোয়া-মোনাজাত করা হয়। প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়া হয় উপহার দেওয়া-নেওয়ার মাধ্যমে। তাছাড়া একসঙ্গে ঘুরতে যাওয়া, সময় কাটানো তো আছেই।
ঈদের বিশেষ খাবার হিসেবে গরুর মাংসের রয়েছে আলাদা কদর। এই দিনে তারা 'মানতি' নামের একধরনের খাবার খায় যা মাখানো আটার ভেতর ভেড়া বা গরুর মাংসের কিমার পুর দিয়ে ভাপানো হয়। পরিবেশন করা হয় মাখন এবং সাওয়ার ক্রিম দিয়ে। এ খাবার সে দেশে খুবই জনপ্রিয়। এছাড়াও তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে হরেক রকমের মিষ্টান্ন।
সোমালিয়া

সোমালিয়ানদের কাছে ঈদ মানেই লোভনীয় সব মনোহর খাবার। সোমালিয়ার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি 'হালভো' খুবই জনপ্রিয় যা বানানো হয় তেল, চিনি, কর্নস্টার্চ এবং হরেক রকমের মসলা মিশিয়ে। সোমালিয়ানরা ঈদের অনুষ্ঠানে হালভো থাকবেই থাকবে।
চীন
এশিয়ার অন্যতম প্রভাবশালী এ দেশটির মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা জিনজিয়ান ও নিংজিয়া প্রদেশে ঈদ উপলক্ষ্যে তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হয়। অন্যান্য প্রদেশেও সরকারি ছুটি থাকে একদিন করে। এই দিনে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় সরকারিভাবে ভেড়ার মাংস সরবরাহ করা হয়। ঈদের দিন তারা জিয়াং নামের এক ধরনের বিশেষ খাবার খায় যা ভাজা আটা ও ময়দা দিয়ে তৈরি করা হয়। স্যুপ অথবা ভাত দিয়ে এটি খাওয়া হয়। এখানে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় মসজিদে। এমনকি দিনটির সম্মানার্থে রাস্তায় টোল পর্যন্ত আদায় করা হয় না। তাছাড়া সাংস্কৃতিক বিপ্লবের সময় নিহতদের জন্য বিশেষ প্রার্থনার ব্যবস্থাও করা হয় ঈদের দিন।
Comments