রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে

ইউক্রেনে রাশিয়া খুব শিগগির আগ্রাসন চালাতে পারে, এই আশংকায় পুরো অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় আছেন। এমন কিছু ঘটলে তা ইউক্রেনের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষ ও দুর্দশার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

ইউক্রেনে রাশিয়া খুব শিগগির আগ্রাসন চালাতে পারে, এই আশংকায় পুরো অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় আছেন। এমন কিছু ঘটলে তা ইউক্রেনের ৪ কোটি ৪০ লাখ মানুষকে দীর্ঘমেয়াদী সংঘর্ষ ও দুর্দশার দিকে ঠেলে দিতে পারে।

তবে ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে এ ধরনের কোনো উদ্যোগ শুধু ২ দেশের সীমান্তে সীমাবদ্ধ থাকবে না বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

তাদের আশংকা, এ সংঘর্ষ গোটা পূর্ব ইউরোপজুড়ে অনিশ্চয়তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বিঘ্নিত হতে পারে পণ্যের সরবরাহ, যার প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ইউরোপে পশ্চিমের দেশগুলোর প্রভাব ও তাদের বিশ্বাসযোগ্যতার প্রতি একটি সুস্পষ্ট চ্যালেঞ্জ হতে পারে রাশিয়ার আগ্রাসন।

তবে চাইলে এসব আশংকা এড়ানো যেতে পারে। ইউক্রেন সরকার বড় আকারের আগ্রাসনের ঝুঁকিকে পাত্তা দিচ্ছে না। গত ২৮ জানুয়ারি বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সংবাদ সম্মেলনের বক্তব্যে তা পরিষ্কার হয়েছে। রাজধানী কিয়েভে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি বলেন, 'আমি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট এবং আমার কার্যক্রম ইউক্রেন ভিত্তিক। আমার ধারণা আমি অন্যদের চেয়ে খুঁটিনাটি বিষয়গুলো বেশি ভালো জানি।'

ইউক্রেনের প্রশাসনিক কর্মকর্তারা সব মহলের সঙ্গে যোগাযোগ করে বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনের জন্য একটি কূটনৈতিক সমাধান খুঁজছেন, জানান তিনি।

ইতোমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বারবার সতর্ক করছে, দেশটি যুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে।

প্রায় ৮০ মিনিটের সংবাদ সম্মেলনে জেলেনস্কি জানান, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সতর্ক বাণীর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন না যে রাশিয়ার আগ্রাসন 'আসন্ন', তবে তিনি ইউক্রেনের গোয়েন্দা বিভাগের বরাতে জানান, তারা ভাবছেন রাশিয়া মূলত তাদের ওপর এক ধরনের মনস্তাত্বিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা চালাচ্ছে।

বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া যদি আগ্রাসনের পথে পা দেয় তাহলে সেটি কী ধরনের আগ্রাসন হবে, তা আগে থেকে বোঝা প্রায় অসম্ভব। বেলারুশে যুক্তরাজ্যের সাবেক রাষ্ট্রদূত নাইজেল গৌল্ড ডেভিস বলেন, 'আধুনিক যুগে যেকোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহের পরিণাম ভয়াবহ হতে পারে, তবে এই ভয়াবহতা বেশ কয়েকটি ধাপে হবে।'

বিশ্লেষকরা একমত যে এই ক্ষেত্রে ন্যাটোর পক্ষ থেকে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এর ওপর নির্ভর করবে আগ্রাসনের প্রভাব ঠিক কী হবে এবং তা কত দিন ধরে চলতে পারে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সংবাদ সংস্থা সিএনএনকে জানান, রাশিয়ার পক্ষে থেকে যেকোনো ধরনের আগ্রাসনের 'পরিণতি ভয়ংকর' হবে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন জানান, পরিস্থিতির বিবেচনায় ন্যাটোর পক্ষ থেকে বাড়তি উদ্যোগ নেওয়া হলে যুক্তরাজ্য সেখানে অংশগ্রহণ করবে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁ জানান, যেকোনো আগ্রাসনের জন্য পুতিনকে অনেক বড় মূল্য চুকাতে হবে।

তবে বিশ্লেষকরা ভাবছেন, বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া নির্ভর করবে ইউক্রেনের সীমান্তে রাশিয়া কতটুকু জোরেশোরে প্রবেশ করবে তার ওপর। অনেক পর্যবেক্ষক আশাবাদী, সর্বাত্মক যুদ্ধ প্রতিহত করা যাবে।

প্রথমবার ইউক্রেনের সীমানায় রাশিয়ার সৈন্যবাহিনী মোতায়েনের পর থেকেই বিশ্লেষকরা দেশটির অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য সামরিক আগ্রাসনের প্রভাব নিয়ে আশংকা জানিয়েছেন।

ইউক্রেনের কৃষি উৎপাদনে যেকোনো ধরনের বিঘ্ন আসলে তা বৈশ্বিক খাদ্য সরবরাহের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলবে।

আন্তর্জাতিক শস্য কাউন্সিলের পূর্বাভাষ অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে বিশ্বের ৬ ভাগের ১ ভাগ ভুট্টা আমদানির উৎস হবে ইউক্রেন। দেশটি ইতোমধ্যে শস্য রপ্তানির দিক দিয়ে বিশ্বের প্রথম ৪টি দেশের মধ্যে অবস্থান করছে। অর্থাৎ, দেশটির কৃষি উৎপাদনে যেকোনো ধরনের বিঘ্ন সারা বিশ্বের অনেক দেশেই খাদ্য সরবরাহে সমস্যা তৈরি করতে পারে।

তবে এরচেয়েও বড় প্রভাব পড়তে পারে জ্বালানি সরবরাহের ওপর। রাশিয়া আগ্রাসনের পথে আগালে পশ্চিমা বিশ্ব দেশটির বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে। যার প্রভাব পড়বে জ্বালানির ওপর।

গৌল্ড ডেভিস জানান, ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম প্রধান জ্বালানি সরবরাহকারী দেশ এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশে জ্বালানি প্রবাহের ট্রানজিট দেশ। সেখানে যেকোনো ধরনের সংঘর্ষ জ্বালানির বাজারের ওপর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে।

রাশিয়া ইউরোপীয় ইউনিয়নের ৩০ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাসের চাহিদা মেটায়। রাশিয়া থেকে আসা গ্যাসের সরবরাহ জ্বালানি উৎপাদন এবং মধ্য ও পূর্ব ইউরোপের বাড়িগুলোতে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানি সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সি (আইইএ) ইতোমধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে তারা ইউরোপে গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে মলদোভাসহ বেশ কিছু দেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে।

জ্বালানির মূল্যস্ফীতি ইতোমধ্যে ইউরোপের লাখো পরিবারকে বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। ব্যাংক অব আমেরিকার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যের গ্রাহকদের ঘর উষ্ণ ও আলোকিত রাখার জন্য আগের তুলনায় বছরে ৭৯০ পাউন্ড (১ হাজার ৭৫ ডলার) বেশি দিতে হবে।

বাইডেন প্রশাসন যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ইউরোপের জ্বালানি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বিভিন্ন ধরনের বিকল্প পন্থা খুঁজছে। গত মঙ্গলবারে দেশটির জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তারা জানান, তারা গ্যাস স্বল্পতা ও বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বড় ধরনের প্রভাবের আশংকা করছেন।

যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, পোল্যান্ড, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও ন্যাটোর প্রতিনিধিদের মধ্যে একটি ভার্চুয়াল বৈঠকের পর ইউরোপিয়ান কমিশন একটি বিবৃতি প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, রাশিয়া যদি আরও আক্রমণাত্মক ভূমিকা অবলম্বন করে, তাহলে বিভিন্ন খাতের ওপর সুনির্দিষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে। বর্তমানে নিষেধাজ্ঞার খুঁটিনাটি নির্ধারণ নিয়ে কাজ চলছে।

বাইডেন মার্কিন সংবাদ সংস্থা সিএনএনকে জানান, তিনি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন।

বিশ্লেষকরা আশা করছেন একটি বিস্তৃত আকারের 'নিষেধাজ্ঞা প্যাকেজ' আরোপ করা হবে, যেটি রাশিয়ার প্রধান ব্যাংক, তেল ও গ্যাস খাত এবং প্রযুক্তি আমদানি খাতের ওপর বড় আকারের প্রভাব ফেলবে। তবে শুধু রাশিয়া নয়, ইউরোপ ও বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও এ ধরনের উদ্যোগের প্রভাব পড়বে।

ট্রাম্প প্রশাসনে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বেসামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সচিব ন্যাথান সেলস জানান, যখনই কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তখন সেটি লক্ষ্যবস্তুর জন্য বেশ ব্যয়বহুল একটি বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।

বিশেষজ্ঞরা জানান, রাশিয়ার সামরিক অভিযানের প্রভাব ছড়িয়ে পড়বে সারা বিশ্বে। কেউ কেউ ভাবছেন, রাশিয়া যদি কোনো ভাবে নিজেদেরকে বিজয়ী হিসেবে দেখাতে পারে, তাহলে অন্য অনেক দেশও সীমান্ত সংঘাতে জড়িয়ে পড়ার জন্য উৎসাহিত হবে।

গৌল্ড ডেভিস জানান, চীন নিবিড়ভাবে পশ্চিমের উদ্যোগগুলোর দিকে নজর রাখবে এবং এ অঞ্চলের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নেবে। অন্য একজন বিশেষজ্ঞ জানান, তাইওয়ানের মানুষরাও শিক্ষা নেব। বস্তুত যেকোনো দেশ, যাদের নিকটতম প্রতিবেশী কোনো শক্তিশালী রাষ্ট্র, এ ঘটনাপ্রবাহ থেকে শিক্ষা নেবে।

মার্কিনরা ইউক্রেন সংকটে কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে, তার ওপর নির্ভর করবে আগামী কয়েকটি প্রজন্ম দেশটিকে কোন দৃষ্টিতে দেখবে।

যদি রাশিয়া সফল হতে পারে, তাহলে সারা বিশ্বের 'একনায়করা যুক্তরাষ্ট্রের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন', যোগ করেন ন্যাথান সেইলস।

দুর্বিনীত রাষ্ট্রের উদাহরণ হিসেবে তিনি উত্তর কোরিয়া ও ইরানের কথা উল্লেখ করেন, যারা এ ধরনের ফলাফলের সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। তবে তিনি আশা করেছেন, ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্র শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া দেখাবে, যা রাশিয়াকে পিছু হটতে বাধ্য করবে এবং দিনের শেষে তারা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা অক্ষুণ্ণ রেখে এ পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে।

তবে দীর্ঘ মেয়াদে রাশিয়ার সঙ্গে সমস্যা চলতে থাকলে পুরনো আরেকটি বিতর্ক আবারও সামনে আসতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে মার্কিনরা একটি বিষয় নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত—তারা কী 'বৈশ্বিক পুলিশের' ভূমিকা পালন করবে (যেটি বাইডেন প্রশাসন অবলম্বন করতে চাইছে) না কেবল মার্কিন স্বার্থ জড়িত আছে, এরকম বিষয়ের দিকে নজর রাখবে।

২০২১ এর ১৭ ডিসেম্বর রাশিয়া একটি খসড়া নিরাপত্তা চুক্তি প্রকাশ করে, যেখানে তারা দাবি জানায়, ইউক্রেন সহ সাবেক-সোভিয়েত রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত কিছু দেশকে ন্যাটোর সদস্যপদ দেওয়া যাবে না, এবং ন্যাটোকে মধ্য ও পূর্ব ইউরোপে মোতায়েন করা অতিরিক্ত সেনা ও অস্ত্র প্রত্যাহার করে নিতে হবে।

খসড়া নথিতে 'একে ওপরের অঞ্চলের ওপর আক্রমণ করতে পারবে', এরকম সব এলাকায় মার্কিন ও রাশিয়ার যুদ্ধজাহাজ ও বিমান মোতায়েন করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করারও দাবি জানানো হয়। একইসঙ্গে রাশিয়ার সীমান্তের কাছে (ইউক্রেনে) ন্যাটোর সামরিক মহড়া আয়োজনের ওপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের দাবি জানানো হয়।

এই নথিগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। তবে তারা বেশিরভাগ দাবিই নাকচ করেন।

একই সময়ে রাশিয়া ইউক্রেনের সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় ১ লাখ সৈন্য মোতায়েন করে। তখন থেকেই এ অঞ্চলে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ার আসন্ন আগ্রাসনের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব কী হতে পারে, সে ব্যাপারে এখনও কোনো নিশ্চয়তা নেই, তবে সব মহল থেকে নিবিড়ভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে এবং সবাই অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে পরবর্তী ধাপের জন্য।

Comments

The Daily Star  | English

Desire for mobile data trumps all else

As one strolls along Green Road or ventures into the depths of Karwan Bazar, he or she may come across a raucous circle formed by labourers, rickshaw-pullers, and street vendors.

15h ago