‘রাশিয়া যত একঘরে হবে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক তত শক্তিশালী হবে’

মস্কোয় রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেরগেই শোইগুর সঙ্গে মিয়ানমারের কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং। ছবি: রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইল ফটো

ক্রমাগত আন্তর্জাতিক অবরোধ-নিষেধাজ্ঞায় 'একঘরে' হয়ে পড়া পরাশক্তি রাশিয়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার উন্নয়নশীল মিয়ানমারের সঙ্গে ঘনিষ্ট সম্পর্ক গড়ে তুলছে। এই সম্পর্কের মূলে আছে অবরোধক্লিষ্ট মিয়ানমারকে মস্কোর সামরিক সহায়তা।

গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে আগ্রাসন চালানোয় রাশিয়ার ওপর ক্রমাগতভাবে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা নেমে আসছে। এর আগের বছর ফেব্রুয়ারির প্রথম দিনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপরও রয়েছে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা।

এমন পরিস্থিতিতে ক্রমশ বন্ধুহীন হয়ে পড়ছে রাশিয়া ও মিয়ানমার। তাই একে অপরের সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করছে অসম শক্তির দেশ ২টি। চেষ্টা করছে 'ঐক্যের মাধ্যমে নিজেদের অবস্থান শক্তিশালী করার'।

এ কথা সবাই জানেন যে মিয়ানমার বহু বছর ধরেই প্রতিবেশী চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলছে। এ সম্পর্ক এতো গভীর যে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চীনের সরাসরি সহায়তার কারণে মিয়ানমারে আন্তর্জাতিক অবরোধ তেমন কাজে আসছে না।

এখন দেখা যাচ্ছে চীনের পাশাপাশি মিয়ানমারের দিকে হাত বাড়িয়েছে রাশিয়াও।

ইউক্রেনে হামলার পর রাশিয়া বৈশ্বিক অর্থ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর মিয়ানমার যেন মস্কোর কাছে এক 'সোনার হরিণ'। রাশিয়া চাচ্ছে প্রতিটি অঞ্চলে তার 'বন্ধু' থাকুক বা অবস্থান শক্ত হোক।

সেই হিসেবে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বন্ধুরাষ্ট্র মিয়ানমারের প্রতি 'সুনজর' দিচ্ছে ক্রেমলিন।

মিয়ানমারে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কুচকাওয়াজে কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং। ২৭ মার্চ ২০২২। ছবি: এপি

আজ রোববার মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরা এ তথ্য জানিয়ে বলেছে, মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সাধারণত দেখা যায় দেশটির কমান্ডার ইন চিফ মিন অং হ্লাইং ৪ চাকার খোলা গাড়িতে চড়ে জাঁকজমকপূর্ণ কুচকাওয়াজে অংশ নেওয়া সেনাদের পরিদর্শন করছেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে দেশব্যাপী সহিংস আন্দোলনের পরও জেনারেলরা প্রতি বছরের মতো জৌলুশপূর্ণ আয়োজনে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন করেছিলেন।

এ বছর দিবসটি উদযাপনের প্রাক্কালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনেছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা গতকাল মিয়ানমারের বিমান বাহিনী ও সেখানে অস্ত্র সরবরাহকারীদের বিরুদ্ধে নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।

সার্বিক অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এসব নিষেধাজ্ঞা আমলে নিচ্ছে না।

আজকের দিনটিকে উদযাপনের জন্য মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ধারণা করা হচ্ছে এবারের আয়োজনেও রাশিয়া থাকবে সম্মানিত অতিথি হিসেবে।

ফরাসি সংবাদমাধ্যম ফ্রান্স টুয়েন্টি ফোর জানিয়েছে, মিয়ানমারের সেনাপ্রধান সামরিক কুচকাওয়াজের অনুষ্ঠানে 'অভ্যুত্থানবিরোধীদের নিমূল' করার প্রতীজ্ঞা করেছেন।

মিয়ানমারে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত বিশেষ দূত টম অ্যান্ড্রুজ গণমাধ্যমকে বলেন, 'রাশিয়ার সঙ্গে মিয়ানমারের ঘনিষ্ঠ ও গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। মিয়ানমারে রাশিয়া নিয়মিত অস্ত্র সরবরাহ করছে। মিয়ানমারের সেনা কর্মকর্তারা অস্ত্র সংগ্রহ করতে মস্কো যাচ্ছেন। সেখানে রুশ কর্মকর্তা ও অস্ত্র সরবরাহকারীদের সঙ্গে বৈঠক করছেন।'

গত বছর রাশিয়ার উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী আলেক্সান্ডার ফোমিন মিয়ানমারের সামরিক কুচকাওয়াজে এসেছিলেন। রুশ বৈমানিকরা নতুন যুদ্ধবিমান নিয়ে মহড়ায় অংশ নিয়েছিলেন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনকে সমর্থন দেওয়া হাতে গোণা কয়েকটি দেশের অন্যতম মিয়ানমারে রুশ ও চীনা অস্ত্র সরবরাহের গতি কমতে দেখা যায়নি। গত বছর সেনা অভ্যুত্থানের পর বন্ধুরাষ্ট্র সার্বিয়া দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশটিতে অস্ত্র সরবরাহ সাময়িকভাবে স্থগিত করে।

সেনা অভ্যুত্থানের আগ পর্যন্ত বেলারুশ, ভারত, পাকিস্তান, ইউক্রেন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইসরায়েল তাদের সামরিক সরঞ্জাম মিয়ানমারে বিক্রি করতো।

স্টকহোমভিত্তিক আন্তর্জাতিক শান্তি গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, মিয়ানমারে সেসব দেশের অস্ত্র বিক্রি বেড়েছিল ২০১৮-১৯ সালে। তবে অভ্যুত্থানের আগে তা কমে আসে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, সব দেশই যে মিয়ানমারের সঙ্গে সম্পর্ক সীমিত করেছে তা নয়। জাপান এখনো মিয়ানমারের কর্মকর্তা ও ক্যাডেটদের প্রশিক্ষণ দিয়ে যাচ্ছে।

ঘনিষ্ঠ বন্ধু রাশিয়া

আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়, যদিও মিয়ানমারের ভাণ্ডারে অনেক দেশের অস্ত্র আছে, তবুও রাশিয়া এখনো মিয়ানমারের শীর্ষ প্রতিরক্ষা অংশীদার।

মানবাধিকার সংগঠন জাস্টিস ফর মিয়ানমার'র (জেএফএম) আজ প্রকাশিত অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, রাশিয়ার ১৯ প্রতিষ্ঠান মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহ করছে। সংগঠনটি সেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

মিয়ানমারে অস্ত্র সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের শীর্ষে আছে রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান রসটেক। এই প্রতিষ্ঠানের অধীনে ১৫ প্রতিষ্ঠান ও ৭০ অংশীদার কাজ করে। এসব প্রতিষ্ঠান ও অংশীদার মিয়ানমারে যুদ্ধবিমান, সামরিক হেলিকপ্টার ও ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও যন্ত্রাংশ সরবরাহ করছে।

রসটেকের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রসোবোরনএক্সপোর্টের প্রধান গত জুলাইয়ে বলেছিলেন, তারা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে 'ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা' বজায় রেখে চলছেন।

চলতি মাসের শুরুতে রাশিয়ার সামরিক প্রতিনিধি দল মিয়ানমারে অস্ত্র প্রদর্শনীতে যোগ দিয়েছিল। মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, 'সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য' রসোবোরনএক্সপোর্টের জ্যেষ্ঠ নির্বাহীর সঙ্গে তাদের সেনা কর্মকর্তারা বৈঠক করেছেন।

সংবাদমাধ্যমে আরও বলা হয়, রাশিয়া ও বেলারুশসহ ইউরোশিয়ার দেশগুলোর সংগঠন ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নের সদস্যরা গত সপ্তাহে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোয় সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তারা 'দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সেবা' বাড়াতে আলোচনা করেছেন।

সূত্রের বরাত দিয়ে আলজাজিরা জানায়, রসটেকের অন্তত ৩ কর্মকর্তা এখন মিয়ানমারে অবস্থান করছেন। জেএফএম'র মুখপাত্র ইয়াদানার মং সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছেন, 'মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জন্য রসটেক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। তারা যুদ্ধবিমান ও হেলিকপ্টারসহ অস্ত্র ও যন্ত্রাংশ বিক্রি করছে। এসব দিয়ে মিয়ানমারের সেনারা দেশজুড়ে নির্বিচারে বোমা হামলা চালাচ্ছে।'

'একে অপরকে প্রয়োজন'

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ইউক্রেনে আগ্রাসনের কারণে রাশিয়ার মনোযোগ সেদিকে নিবিষ্ট থাকলেও মস্কো চায় মিয়ানমারের সঙ্গে সামরিক সহযোগিতা অটুট থাকুক।

প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংগঠন জ্যানস'র এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের প্রধান জন গ্রিভাত বলেছেন, 'রাশিয়া যতই এক ঘরে হয়ে পড়বে মিয়ানমারের সঙ্গে তার সম্পর্ক ততই শক্তিশালী হবে। সরবরাহ বিঘ্নিত হলে রাশিয়া চেষ্টা করবে মিয়ানমারে যন্ত্রাংশ তৈরির কারখানা করতে।'

প্রতি বছর মিয়ানমারের প্রায় আড়াইশ কোটি ডলারের সামরিক বাজেটের ৫০০ মিলিয়ন খরচ হয় অস্ত্র কেনায়।

গ্রিভাত আরও বলেন, 'ডলারের বিনিময়ে মিয়ানমার সামরিক যন্ত্রাংশ কিনতে পারছে না বলে দেশটির মূল্যবান পাথর ও কাঠকে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের সম্ভাবনা অনেক বেশি।'

'রাশিয়া ও মিয়ানমার একে অপরকে ছাড়তে পারবে না। যেকোনো আঙ্গিকে তারা সম্পর্ক বজায় রাখবে। একে অপরকে তাদের প্রয়োজন। তারা একসঙ্গে শক্তিশালী হয়ে উঠবে। রাশিয়া থেকে মিয়ানমার নেবে সামরিক সরঞ্জাম আর মিয়ানমার থেকে রাশিয়া নেবে কাঁচামাল।'

রাশিয়া ও মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি আরও বলেন, 'একে একে সব বন্ধু সরে গেলে যে বন্ধু পাশে থাকে তার গুরুত্ব অনেক বেড়ে যায়।'

Comments