আজো প্রবাহমান ঐতিহাসিক ধামরাই রথ

ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথ নিয়ে পল্লীকবি জসীমউদদীন লিখেছিলেন, ‘ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর, কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।’
ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথযাত্রা। ছবি: সংগৃহীত

ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথ নিয়ে পল্লীকবি জসীমউদদীন লিখেছিলেন,

'ধামরাই রথ, কোন অতীতের বৃদ্ধ সুত্রধর,

কতকাল ধরে গড়েছিল এরে করি অতি মনোহর।

সূক্ষ্ম হাতের বাটালি ধরিয়া কঠিন কাঠেরে কাটি,

কত পরী আর লতাপাতা ফুল গড়েছিল পরিপাটি।

রথের সামনে যুগল অশ্ব, সেই কত কাল হতে,

ছুটিয়া চলেছে আজিও তাহারা আসে নাই কোন মতে।'

ঐতিহ্যবাহী রথের মেলায়। ছবি: সংগৃহীত

বলা হয়, রাজধানী হিসেবে ঢাকার যতো বয়স, ধামরাই রথের বয়সও প্রায় তেমনই। ১০৭৯ বঙ্গাব্দে যে রথের সূচনা, আজ সাড়ে ৩০০ বছর পেরোলেও ঐতিহ্যের ধুলায় এখনো প্রবাহমান ধামরাই রথযাত্রা।

আজ শুক্রবার ছিল রথযাত্রার দিন। প্রতি বছরের মতো এ বছরও লাখো মানুষের ঢল নেমেছিল ধামরাইয়ের রথযাত্রায়।

রথের মেলায় মুখরিত ধামরাই যেন এক উৎসবের নগরী। ছবি: সংগৃহীত

কেবল হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই নন, ধামরাই রথযাত্রা ছেয়েছে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনে।

পূণ্যার্থী, ভক্ত থেকে সাধারণ মানুষ—কে ছিলেন না সেখানে। বাবার কাঁধে চেপে এসেছে ছোট্ট শিশুও। শুধু তাই নয়, বাংলা প্রবাদের 'রথ দেখা কলা বেচা' মানুষের সংখ্যাও নেহায়েত কম ছিল না।

বাংলা পঞ্জিকার প্রতি বছরের আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে পালিত হয় রথযাত্রা। আজ থেকে ঠিক ৯ দিন পরে আগামী ৯ জুলাই পালিত হবে উল্টো রথযাত্রা।

বাবার কাঁধে চেপে রথযাত্রায় ছোট্ট শিশু। ছবি: সংগৃহীত

একই সঙ্গে চলবে মাসব্যাপী রথের মেলা।

ধামরাই রথযাত্রা এতোটাই বিস্তৃত ও ঐতিহ্যবাহী যে ধামরাই রথের মতো এতো সুপ্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রথের ইতিহাস বাংলার আর কোথাও পাওয়া যায় না।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ধামরাইতে বালিয়াটির জমিদারদের অর্থায়নে ৬০ ফুট উঁচু রথ নির্মিত হলেও মুক্তিযুদ্ধের সময় সেই ঐতিহাসিক  রথটি পুড়িয়ে দিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসরেরা।

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনী পুড়িয়ে দিয়েছিল ধামরাইয়ের প্রাচীন এই রথটি। ছবি: এপি আর্কাইভের সৌজন্যে

পরবর্তীকালে বিখ্যাত দানবীর এবং সমাজসেবক রণদা প্রসাদ সাহার প্রতিষ্ঠিত কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাষ্টের অর্থায়নে নির্মিত হয় বর্তমানের ধামরাই রথটি।

ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথের সূচনা হয়েছিলো ১০৭৯ বঙ্গাব্দে। ধামরাই রথযাত্রা শুরুর পিছনেও রয়েছে সুপ্রাচীন এক ইতিহাস। এই রথযাত্রার সূচনা হয়েছিল স্থানীয় যশো মাধব মন্দিরকে কেন্দ্র করে।

কথিত আছে, একবার পাল বংশের রাজা যশোপাল হাতির পিঠে চড়ে বেড়াতে যান ধামরাইয়ের শিমুলিয়ার কাছে এক গ্রামে। রাস্তায় চলতে চলতে হঠাৎ রণস্থান নামক স্থানে একটি উঁচু লাল মাটির ঢিবি দেখতে পেয়ে রাজাকে বহনকারী হাতিটি থেমে যায়। হাতির মাহুতের বহু চেষ্টা সত্ত্বেও কিছুতেই হাতিটি আর এগোচ্ছিল না।

‘রথ দেখা ও কলা বেচা’। ছবি: সংগৃহীত

শত চেষ্টাতেও রাজার মাহুত যখন হাতিটিকে সামনে নিতে পারলেন না, তখন রাজা ভীষণ অবাক হলেন। রাজা যশোপাল তখন হাতি থেকে নেমে গ্রামবাসীকে লাল মাটির ঢিবিটি খননের নির্দেশ দেন। একপর্যায়ে সেই মাটির ঢিবিতে একটি সুরক্ষিত মন্দির আছে বলে ধারনা করা হলো।

পরবর্তীতে রাজার নির্দেশে সেই মাটির ঢিবির গভীরে সুরু মন্দির পাওয়া যায়। একই সঙ্গে পাওয়া যায় মাধবের‌ মূর্তি।‌

কথিত আছে, সেখানে মাধবের বউও ছিল। খনন কার্য চলাকালে মাধবের বউয়ের দেহ আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে কেটে গেলে দ্রুত বউ আরও গভীরে চলে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে যায়।‌

মাধবের মূর্তিটি এনে পরবর্তীতে ধামরাইয়ের পণ্ডিত রামজীবন রায়কে মাধব মূর্তি নির্মাণ করার আদেশ দেন রাজা। পরবর্তীতে রাজা যশোপালের সঙ্গেই নাম মিলিয়ে স্থাপিত হয়েছিল শ্রী যশোমাধবের বিগ্রহ, যা পরে মন্দিরে রূপান্তরিত হয়।‌ শ্রী যশোমাধবের মন্দিরকে কেন্দ্র করেই ১০৭৯ বঙ্গাব্দে সূচনা হয়েছিল যশোমাধবের রথযাত্রা ও মেলা।

৩৫০ বছর পেরোলেও বিন্দুমাত্র কমেনি ধামরাই রথযাত্রার জৌলুস। পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতার পরেও থেমে যায়নি ঐতিহ্যবাহী ধামরাই রথযাত্রা। আজ ৩৫০ বছরে পা দেওয়া ধামরাই রথ দিনে দিনে হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Create right conditions for Rohingya repatriation: G7

Foreign ministers from the Group of Seven (G7) countries have stressed the need to create conditions for the voluntary, safe, dignified, and sustainable return of all Rohingya refugees and displaced persons to Myanmar

2h ago