অপারেশন জ্যাকপট: মুক্তিযুদ্ধের বিপজ্জনক ও সফলতম অপারেশন
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তো বটেই পৃথিবীর ইতিহাসেও অন্যতম শ্রেষ্ঠ নৌ অপারেশনগুলোর একটি বলা হয়ে থাকে অপারেশন জ্যাকপটকে। অপারেশন জ্যাকপট ছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে নৌ কমান্ডোদের এক মরণকামড়। দেশপ্রেমে মরিয়া হয়ে সে বিপজ্জনক ও আত্মঘাতী অপারেশন কেবল হানাদারদের বুকে কাঁপনই ধরায়নি, সাড়া ফেলে দিয়েছিলো গোটা পৃথিবী জুড়ে।
শুরুর আগের ঘটনা
মুক্তিযুদ্ধে মার্চের শুরুর দিকে ফ্রান্সের তুলন বন্দরের সাবমেরিন ডকইয়ার্ড থেকে খানিকটা দূরে পাকিস্তানি সাবমেরিনারদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিলো পাকিস্তানি সাবমেরিন পি এন এস ম্যাংরোতে। সেই ৪১ জন সাবমেরিনারদের মধ্যে ১৩ জন ছিলেন বাঙালি অফিসার। আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যমে ২৫ মার্চের গণহত্যার কথা যখন সেই ১৩ বাঙালি অফিসার শুনলেন তখন তারা সাবমেরিনে। আর সেই সাবমেরিনের গোপন নথি ও জরুরি সংবাদ সিন্দুকের নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন বাঙালি সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী।
তুলন বন্দরের সাবমেরিন ডকইয়ার্ডে যখন তাদের সাবমেরিন ভিড়ল তখন ৪৫ জন ক্রুর পাসপোর্ট নিজের আয়ত্বে নিয়ে নেন আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী। আর তখন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার পরিকল্পনা করেন। তার এই পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাওয়ায় গোপনে তিনি ও আরও ৭ বাঙালি সাবমেরিনার রহমতউল্লাহ, সৈয়দ মোশাররফ হোসেন, শেখ আমানউল্লাহ, আহসানউল্লাহ, আবদুর রকিব মিয়া, আবদুর রহমান আবেদ ও বদিউল আলম তথ্য জানা সেই পাকিস্তানি এক গোয়েন্দাকে খুন করে পালান। এরপর তারা প্যারিস, স্পেনের লিওন ও ইতালির রোম হয়ে ৯ এপ্রিল দিল্লিতে এসে পৌঁছান।
নতুন করে বাড়লো পরিধি
দিল্লিতে আসার পর সিদ্ধান্ত হয় এই নৌ কমান্ডোরা নৌ অপারেশনে যুক্ত হবেন। এরপর আট জনের সঙ্গে আরো ১২ জনকে একত্র করে ২০ জনের একটি গেরিলা দল গঠন করে ভারতে বিশেষ ট্রেনিং দেয়া হয়।
ট্রেনিংয়ের জন্য গোপন ক্যাম্প
মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর নির্দেশে ২৩ মে নৌ-কমান্ডো সেক্টর খোলার পর বাছাইকৃত গেরিলাদের ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যে একটি গোপন ক্যাম্প খোলা হয় পলাশীর স্মৃতিসৌধের পাশে ভাগীরথী নদীর তীরে। এই ট্রেনিং ক্যাম্পের সাংকেতিক নাম দেয়া হয়েছিল সি-২ পি (C-2 P)। এখানে ট্রেনিং দেয়ার উদ্দেশ্যে অন্যান্য সেক্টরের বিভিন্ন শিবির থেকে মে মাসের শুরুর দিকে প্রায় ৩০০ জন বাছাইকৃত যোদ্ধা সংগ্রহ করা হয়েছিল। ট্রেনিং ক্যাম্পে এদের কী ধরনের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে সে বিষয়টি এতই গোপনীয় ছিল যে, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যেও শুধুমাত্র যার এলাকায় অপারেশন চালানো হবে তিনি ছাড়া আর কেউ এ সম্পর্কে জানতেন না।
ট্রেনিং শুরু হওয়ার আগেই বাছাইকৃত যোদ্ধাদের বলে দেওয়া হয় যে এটি একটি সুইসাইডাল অপারেশন বা আত্মঘাতী যুদ্ধ। তাই অপারেশনের সময় যে কোনো মূল্যে অপারেশন সফল করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনে তাদের প্রাণ দিতে হতে পারে। তাই প্রশিক্ষণের শুরুতেই প্রত্যেক প্রশিক্ষণার্থীদের ছবিসহ একটি সম্মতিসূচক পাতায় স্বাক্ষর নেয়া হয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, 'আমি দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বিসর্জন দিতে সম্মত হয়েই এই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছি, আর যুদ্ধে আমার মৃত্যু ঘটলে কেউ দায়ী থাকবে না।'
যেমন ছিল ট্রেনিং
নৌ-কমান্ডোদের ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় নেভাল অফিসার কমান্ডার এম এন সামানত, ট্রেনিং দেয়ার দায়িত্বে ছিলেন লে. কমান্ডার জি এম মার্টিস। একই সঙ্গে আরও ভারতীয় ২০ জন প্রশিক্ষক ও বাঙালি সেই ৮ জন সাবমেরিনার।
ট্রেনিংয়ে ছিল দুটি অংশ। প্রথমটিতে সবাইকে প্রয়োজনীয় স্থলযুদ্ধ শিখতে হতো। যেমন- গ্রেনেড নিক্ষেপ, এক্সপ্লোসিভের ব্যবহার, স্টেনগান রিভলবার চালানো, আন-আর্মড কমব্যাট (খালি হাতে যুদ্ধ)।
দ্বিতীয়টি জলযুদ্ধের ট্রেনিং- বুকে ৫-৬ কেজি ওজনের পাথর বেঁধে সাতার, চিৎ সাতার, কোনো মতে পানির উপরে নাক ভাসিয়ে একটানা অনেকক্ষণ সাঁতার, পানিতে সাঁতরে এবং ডুব সাতার দিয়ে লিমপেট মাইন ব্যবহার, স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতার, জাহাজের কেবল ভাঙা ইত্যাদি কঠিন সব প্রশিক্ষণ দেয়া হতো তীব্র খরস্রোতা ভাগীরথী নদীতে। এসময় শীত ও বর্ষায় একটানা ৪৮ ঘণ্টা পানিতে থাকার অভ্যাস করানো হয়েছিল। প্রায় টানা তিন মাস ট্রেনিং এর পর আগস্টের প্রথম সপ্তাহে তাদের ট্রেনিং শেষ হয়।
অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনা
প্রশিক্ষণের শেষদিকে এসে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজানো হতে থাকে। একই সাথে একই সময়ে দুই সমুদ্র বন্দর ও দুই নদী বন্দরে আক্রমণ চালানোর জন্য চার সেক্টরের পরিকল্পনার সমন্বয় ঘটানো হয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচকে চার স্থানে আক্রমণের উদ্দেশ্যে মোট চারটি দলে ভাগ করা হয়েছিল। ৬০ জনের ২টি দল এবং ২০ জনের আরও ২টি দল। চারটি দলের চার জন দলনেতা ঠিক করে দেয়া হয়েছিল। দলনেতাদের অপারেশন পরিচালনার জন্য শিখিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিশেষ গোপনীয় পদ্ধতি যা টিমের অন্যান্য সদস্যদের কাছে গোপন রাখা হয়েছিল।
ঠিক করা হয়েছিল সাবমেরিনার আবদুল ওয়াহেদ চৌধুরী ৬০ জন কমান্ডো নিয়ে চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের জাহাজ আক্রমণ করবেন। নৌ-কমান্ডো আমিনুর রহমান খসরু ২৬০ জন কমান্ডো (যার মধ্যে ৬০ জন নৌ কমান্ডো ও ২০০ জন সি আন্ড সি কমান্ডো) নিয়ে মংলা সমুদ্র বন্দর, সাবমেরিনার বদিউল আলম ২০ জন কমান্ডো নিয়ে চাঁদপুর নদী বন্দর ও সাবমেরিনার আবদুর রহমান ২০ জন কমান্ডো নিয়ে নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর আক্রমণ করবেন।
অপারেশনের সংকেত
ঠিক করা হয় দুটি গান অপারেশনের সংকেতের জন্য প্রচার করা হবে। একটি কলকাতা আকাশবানীর পক্ষ থেকে পূর্বাঞ্চলীয় শ্রোতাদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠানে সকাল ৬টা থেকে ৬:৩০ মিনিট অথবা রাত ১০:৩০ মিনিট থেকে রাত ১১টায়। এই ফ্রিকোয়েন্সির নাম ও গান দুটি শুধু প্রতিটি দলের কমান্ডাররাই জানতেন।
প্রথম সংকেত ছিল পঙ্কজ মল্লিকের গাওয়া "আমি তোমায় শুনিয়েছিলাম যত গান" এর অর্থ হলো ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আক্রমণ করতে হবে বা আক্রমণের সময় কাছাকাছি। আর দ্বিতীয় সংকেত সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গাওয়া গান 'আমার পুতুল আজকে প্রথম যাবে শ্বশুরবাড়ি' গানটি। দ্বিতীয় সংকেত যার অর্থ আক্রমণের জন্য ঘাঁটি ত্যাগ করবেন। অর্থাৎ সুস্পষ্ট নির্দেশ আক্রমণ করতেই হবে।
যেমন ছিল চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অপারেশন
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর অপারেশনের জন্য ১৮০ জন থেকে ৬০ জনে নিয়ে আসা দলকে ৩টি গ্রুপে ভাগ করা ছিল। মাজহারউল্লাহ গ্রুপ আবদুল ওয়াহিদ, ফারুক ই আজম গ্রুপের কমান্ডার শাহ আলম এবং আবু তাহের গ্রুপের কমান্ডার রশিদ আহম্মদ।
১৪ আগস্ট রাতে রশিদ আহম্মদ গ্রুপ রামগড় পথে, শাহ আলম এবং ওয়াহিদ গ্রুপ বিভুঁইয়া ঘাট দিয়ে চলতে লাগলেন। ভোরে তারা পৌঁছালেন মীরসরাইয়ের বড়তাকিয়া বাজারে। তারপর খানিকটা জিরিয়ে সমিতির হাটে যাত্রা। সমিতির হাটে এসে যখন পৌঁছালেন তখনই বেজে উঠলো প্রথম গান 'আমি তোমায় যত শুনিয়ে ছিলেম গান, তার বদলে আমি চাই নে কোনো দান'।
তারপর দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলেন তারা। এদিকে রশীদ আহমেদের গ্রুপের খবর পেয়ে যায় পাকিস্তানি হানাদারেরা। রশিদ ভেবেছিলেন পাকিস্তানিদের সেনা ১৪ জন তাই লোহারপুলের কাছাকাছি উঁচু পুকুর পাড় থেকে এলএমজিতে ব্রাশ ফায়ার শুরু করলেন। ঘণ্টাখানেক চললো প্রচণ্ড গোলাগুলি। তারপর ফিরে এলেন আবুল কাশেমের বাড়িতে। এতে অপারেশন জ্যাকপট থেকে রশীদের গ্রুপ পিছিয়ে গেল।
বাকি দুই গ্রুপের ৪০ জন নৌ-কমান্ডো সদরঘাট হয়ে ভাড়া করা ছয়টি সাম্পানে কর্ণফুলী পেরিয়ে দোনার খাল দিয়ে আসেন খামার বাড়ির শেল্টারে ১৪ আগষ্ট সন্ধ্যায়। সাধারণ পোশাকের কারণে সন্দেহ করেনি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।
১৫ আগস্ট দিনের বেলা সামান্য কজন সাম্পান যাত্রী, মাঝি, জেলে সেজে কর্ণফুলীর নদীর তীর ঘুরে ১ নং থেকে ১৭ নং জেটি পর্যন্ত নোঙর করা ছোটবড় জাহাজ, তেলের ট্যাঙ্কার টার্গেট করে রেকি করেন।
সর্বশেষ বেতার সংকেত এলো ১৫ আগস্ট রাতে, মানে আগামী ১২ ঘণ্টায় অপারেশন করতে হবে। রাত ১২টা থেকে ২টার সময় জাহাজের ডিউটির বদল সেরা সময়। খেয়ে দেয়ে রাত ১১ টায় সবাই বালুচরের শেল্টার ত্যাগ করেন, দূরত্ব অনুসারে টার্গেট বরাবর নদীতীরে সবাই একসঙ্গে পৌছাতে পারবে না তাই সকলকে নিজস্ব সময় দিয়ে দেওয়া হয় যাতে মাইন লাগিয়ে নিরাপদ দূরত্বে সবাই সরে যেতে পারেন। তাদের অপারেশনের টার্গেট ঠিক করা হয়েছিল এম.ভি আল আব্বাস ১০,০৪১ টন, এমভি আল হরমুজ ৯,৯৯০ টন, ওরিয়েন্টাল বার্জ ৬,২৭৬ টন, বিদেশি জাহাজ ২টি, নেভাল জেটির সামনে বার্জ ১টি, গুপ্তাখালের মুখের সামনে বার্জ ২টি, বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছড়িয়ে থাকা কয়েকটি বার্জ ও কয়েকটি অয়েল ট্যাঙ্কার।
প্রথমে ঠিক করা হয়েছিল টার্গেট হবে ২২টি যা পরবর্তীতে হয় ১২টি। প্রতিজন একটি করে ৬ কেজি ওজনের লিম্পেট মাইন গামছার সাথে পেটে বেঁধে, সাঁতারের জন্য পায়ে ফিন্স পড়ে ভাসমান জাহাজের ৪/৫ ফুট নিচে মাইন লাগানো হয়, আর সঙ্গে শেওলা উঠানোর জন্য একটা করে ছুরি। শ্বাস নেবার জন্য কোনো মাস্ক ছিল না।
ভারতীয় নৌ কমান্ডোরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া নৌ কমান্ডো কীভাবে হয়? তারা ধারণা করেছিলেন এই অপারেশনে প্রায় সব কমান্ডো মারা যাবেন। কিন্তু উল্টো বুদ্ধি বের করেছিলেন নৌ কমান্ডোরা। মাত্রাতিরিক্ত স্রোতের মাঝেও অক্সিজেন মাস্ক ছাড়া মাইন লাগিয়ে তীরে ফেরত এলেন, বহুবিধ কারণে অনেক মাইন ৬০ মিনিটের আগেই ফেটে যায়, রাত ১টা ৪০ থেকে ২ টার মধ্যে মাইন ফাটা শুরু হয়।
প্রচণ্ড বিস্ফোরণে একেকটি মাইন ফাটছে আর একদিকে জয় বাংলার ধ্বনি। একেকটি জাহাজ ডুবছে জলের মধ্যে, আর পুরো আকাশ আগুনের লেলিহান শিখায় লালে লাল। পাকিস্তানি হানাদার সেনারা গুলি ছুঁড়ছে কিন্তু কিছুই করার নেই ততক্ষণে যে ফলাফল গুনছেন চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধারা।
যেভাবে হয়েছিল মংলা সমুদ্র বন্দর অপারেশন
২৭ জুলাই ৬০ জন নৌ- কমান্ডো ও ২০০ জন বাংলাদেশি সি আন্ড সি বিশেষ কমান্ডো দল আমিনুর রহমান খসরুর নেতৃত্বে ভারতের কানিং মাতলার বন্দর থেকে মংলা অপারেশনের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেছিলেন। সুন্দরবনের গভীর জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কমান্ডো দলটি ১৩ আগস্ট সন্ধা ৬টায় মংলা বন্দরে পৌঁছায়।
২৬০ জনের কমান্ডো দলটি মংলা বন্দর ও ডাংমারি বিলের পেছনে, পরিত্যক্ত জমিদার বাড়িতে অবস্থান নিয়েছিল। সেখান থেকে মংলার দূরত্ব ডাংমারি বিলের মাঝ দিয়ে ৬ মাইল, নৌকায় পৌঁছোতে সময় লাগে ১ ঘণ্টা। ১৫ আগস্ট রেডিওতে অ্যাকশন গান বাজার পর ঠিক রাত ১২টায় কমান্ডোরা ১৫টি নৌকায় মংলা বন্দরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন। মংলায় পৌঁছানোর শেষ সময় নির্ধারিত ছিল রাত দুইটা কিন্তু গাইডের ভুলে কমান্ডোরা অনেক পরে মংলা বন্দরে পৌঁছেছিলেন ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের সব নদী ও সমুদ্র বন্দরে অপারেশন শেষ।
এ অপারেশন শুধু মাত্র জীবনের ঝুঁকিই নয় বরং এই অপারেশন ছিল অপারেশন জ্যাকপটের অপারেশনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিপজ্জনক অপারেশন। কিন্তু সব বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে ভোর সাড়ে ৪টায় মংলা অপারেশন শুরু হয়, অপারেশন চলাকালে ২০০ জন সি আন্ড সি বিশেষ কমান্ডো দল, হেভি মেশিন গান, মেশিনগানসহ ৩ জনের ছোট ছোট দল করে, ৬৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে নৌ-কমান্ডোদের ছাউনি দিতে (কভারিং দিতে) মংলা বাঁধের পিছনে অবস্থান নিয়েছিলেন।
অপারেশন চলাকালে, সি আন্ড সি কমান্ডো দলের উপ-কমান্ডার রাজা ও খিজির জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নৌ-কমান্ডোদের সহযোগিতায় মেশিনগান নিয়ে পশুর নদীতে নেমে আসেন। সময়ের অভাবে শুধুমাত্র ২৪ জন নৌ-কমান্ডো এ অভিযানে অংশ নিতে পেরেছিলেন। ৬টি উপদলে বিভক্ত হয়ে ২৪ জন নৌ-কমান্ডো ৬টি বিদেশি জাহাজে মাইন লাগায়, ভোর ৬:৩০ মিনিট থেকে নৌ-কমান্ডোদের লাগানো মাইন বিকট শব্দ করে ফাটতে শুরু করে। ৩০ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তান বিমান বাহিনীর ৪টি বিমান মংলা বন্দরের উপরে ঘুরতে দেখা যায়।
এই অপারেশনে আক্রান্ত জাহজগুলির মধ্যে একটি সোমালীয়, একটি মার্কিন, ২টি চীনা, ১টি জাপানি ও ১টি পাকিস্তানি জাহাজ ছিল। এ অপারেশনে আক্রান্ত মোট ৬টি বিদেশি জাহাজই ধ্বংস হয় এবং ৩০ হাজার টন গোলা-বারুদ ও যুদ্ধের সরঞ্জাম সহকার ধীরে ধীরে পশুর নদীতে ডুবে যায়। এই অপারেশনে আমিনুর রহমান, খসরু ও আরও ২ জন নৌ- কমান্ডো এ অপারেশনে মংলা বন্দরের অতিরিক্ত বাধা পার হয়ে ৭,০০০ টনের সমরাস্ত্রবাহী সোমালীয় জাহাজ এস,এস, লাইটং ধ্বংস করেন।
এই অপারেশনে দুইজন মুক্তিযোদ্ধা নিখোঁজ হন, ধারণা করা হয় তারা স্রোতের টানে ভেসে গেছেন অথবা তারা শহীদ হয়েছেন।
যেমন ছিল চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশন
অপারেশন জ্যাকপটের চাঁদপুর নদী বন্দর অপারেশনে ১৮ জন নৌ-কমান্ডো অংশ নিয়েছিলেন। এ গ্রুপের ১৮ জনকে তিন জন করে মোট ৬টি ছোট দলে ভাগ করা হয়েছিল। এই অভিযানে মাইন বিস্ফোরণে ২টি স্টিমার, গমবাহী একটি জাহাজসহ ছোট বড় আরো অনেকগুলো নৌযান ধ্বংস করেছিলেন নৌ কমান্ডোরা।
যেমন ছিল নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশন
অপারেশন জ্যাকপটের নারায়ণগঞ্জ নদী বন্দর অপারেশনে মোট ৪টি জাহাজ ও বেশ কয়েকটি নৌযান নৌ কমান্ডোরা ধংস করেছিলেন। শহরের মাঝে এ অপারেশনে মোট ২০ জন কমান্ডো অংশ নেন।
অপারেশন জ্যাকপটের ফলাফল
অপারেশন জ্যাকপটের এই অপারেশনগুলোতেই প্রায় ৫০৮০০ টনের মোট ২৬টি জাহাজ পুরোপুরিভাবে ধ্বংস করেছিলেন নৌ কমান্ডোরা। আর ক্ষতিগ্রস্ত জলযানের সংখ্যা বহু। ১৬ আগস্টের অপারেশনের পর, সব কমান্ডো ভারতে ফেরত গিয়েছিলেন।
সূত্র:
মুক্তিযুদ্ধে নৌ-অভিযান/ কমান্ডো মোঃ খলিলুর রহমান
Witness to surrender/ Siddiq Salik
বাঙালির জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম/ ডা. মাহফুজুর রহমান
Comments