অবশেষে বিজয়

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকা তখন বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা। বাড়ির ছাদ বা রাজপথ—সব জায়গা ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে মুখরিত। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে মানুষ।
আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বাহিনীর মেজর হায়দার এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর (পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড) লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরার সঙ্গে লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ঢাকা তখন বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা। বাড়ির ছাদ বা রাজপথ—সব জায়গা 'জয় বাংলা' স্লোগানে মুখরিত। স্বাধীনতার স্বাদ পেয়ে একে অন্যকে জড়িয়ে ধরছে মানুষ।

সেই শীতের সন্ধ্যায় হাবিবুল আলমসহ একদল মুক্তিযোদ্ধা মতিঝিলে হোটেল পূর্বাণীতে গিয়ে পৌঁছান। ঘড়িতে তখন প্রায় সন্ধ্যা ৫টা ১৫ মিনিট।

সেদিনের কথা স্মৃতিচারণ করে ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য হাবিবুল আলম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ঢাকার অস্ট্রেলিয়ান কাউন্সিলরের কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তা আমাদের দেখে বললেন, ভালো করেছ! অভিনন্দন!'

তার সেই অভিনন্দনের অর্থ ছিল পাকিস্তানি ৯৩ হাজার দখলদার বাহিনীর প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী ততক্ষণে আত্মসমর্পণ করেছেন।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকায় পাকিস্তানি সেনা বহর ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোতে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে সফলভাবে দুর্ধর্ষ অপারেশন চালানোর জন্য তখন ক্র্যাক প্লাটুন সুপরিচিত একটি নাম।

'অস্ট্রেলিয়ার সেই কর্মকর্তাকে জবাবে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি, তোমাদের এবিসি (অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং করপোরেশন) বাংলাদেশের সমর্থনে ভালো কাজ করেছে।'

এর কিছুদিন আগেই মুগদাপাড়ায় গিয়েছিলেন হাবিবুল আলম। মুগদাপাড়া তখন ঢাকা শহরের বাইরের এলাকা। সেখান থেকে তিনি এই দিনটির জন্য অধীর হয়ে অপেক্ষায় ছিলেন।

দেশের ৫১তম বিজয় দিবসের আগে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মুহুর্মুহু জয় বাংলা স্লোগানের তখন আমরা মন্ত্রমুগদ্ধ। অসাধারণ ছিল সেই অনুভূতি। বুঝতে পারলাম আমরা অবশেষে স্বাধীন হয়েছি।

রেডিও, টেলিভিশনে প্রথম ঘোষণা

আলমসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য, তখনো বেশ কিছু কাজ বাকি ছিল। ১৬ ডিসেম্বর রাতে তারা জানতে পারেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মোতায়েন করা কিছু স্নাইপার নারিন্দা এলকায় গুলি চালিয়ে সমস্যা সৃষ্টি করছে।

তিনি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে নারিন্দায় ছুটে যান। স্নাইপারদের সঠিক অবস্থান চিহ্নিত করে তাদের একজনকে হত্যা করেন। 

'ওই অপারেশনের সময় আমি জানতে পারি, আমাদের মিত্র ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টা থেকে সাড়ে ৮টার দিকে ঢাকার রেডিও স্টেশন থেকে আমাদের বিজয়ের প্রথম ঘোষণা দেবে', স্মরণ করেন হাববুল আলম। যিনি এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পরিবার ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। 

টিভিতে মেজর হায়দারের মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি নির্দেশনা।

তিনি তার বই 'ব্রেভ অফ হার্ট'-এ লিখেছেন, 'আমি বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম, ভাবছিলাম একজন বিদেশি আমাদের রাজধানী থেকে আমাদের গণমাধ্যম ব্যবহার করে প্রথম ঘোষণা দেবে। আমাদের জন্য এর চেয়ে অপমানজনক আর কিছুই হতে পারে না।'

সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, 'সে সময় আমাদের দেশের নেতারা প্রবাসে থাকায় এবং সেনাবাহিনীর শীর্ষ নেতারা ঢাকায় না থাকায় বিষয়টিকে তাদের নিজেদের হাতে নিতে হয়।' 

তারা সিদ্ধান্ত নেয়, ২ নম্বর সেক্টরের ভারপ্রাপ্ত সেক্টর কমান্ডার মেজর এ টি এম হায়দার রেডিওতে বিজয়ের ঘোষণা দেবেন।

তিনি বলেন, 'আমাদের দ্রুত সেখানে যাওয়ার দরকার ছিল এবং তার জন্য একটি গাড়ির দরকার। আমরা নারিন্দায় সংসদের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার গাড়ি পেয়ে গেলাম। আমি গাড়িটি স্টার্ট দিই।'

আলম তার সহকর্মী ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ফতেহ আলী চৌধুরীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন এবং শাহাদাত চৌধুরীর সঙ্গেও যোগাযোগ করেন, যাতে পরবর্তী ঘোষণার জন্য হায়দারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন।

টিভিতে বিজয়ের ঘোষণা দিচ্ছেন মেজর হায়দার।

'আমাদের মধ্যে অনেকে সকাল সাড়ে ৫টার মধ্যে রেডিও স্টেশনে পৌঁছেছিলেন, যাতে ঘোষণার জন্য সেটি প্রস্তুত থাকে। আমরা একজন বয়স্ক লোককে পেয়েছিলাম, যিনি আমাদের রেডিওর প্রাক্তন আঞ্চলিক পরিচালক শামসুল হুদার সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি স্টেশন থেকে কাছেই ইস্কাটন রোডে থাকতেন।'

হাবিবুল আলম বলেন, 'ফতেহকে নিয়ে হুদার বাড়িতে পৌঁছানোর পর, আমি ট্রিগার হ্যাচে আঙুল দিয়ে আমার চাইনিজ পিস্তলটি টেবিলের ওপর রাখি এবং সকাল ৮টার মধ্যে রেডিও স্টেশনটি চালু করতে তার সহযোগিতা চাই।'

হুদা কয়েকটা ফোন করার পর বলেন, হয়ে যাবে।

তিনি মিত্র বাহিনীর মনোযোগ অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য একটা ভালো পরামর্শও দিয়েছিলেন, 'যদি আপনার মিত্র বাহিনীর সঙ্গে দেখা হয়, তাহলে তাদের বলতে পারেন যে রেডিও রিসিভারে ব্যবহৃত ক্রিস্টালগুলো মিরপুর ট্রান্সমিশন সেন্টারে আছে এবং সেগুলো পেতে হলে একজনকে খুঁজে বের করতে হবে।'

সকাল ৭টার দিকে রেডিও স্টেশনে ফিরে তারা দেখতে পান হায়দার ও শাহাদাত ইতোমধ্যেই সেখানে পৌঁছে গেছেন এবং তাদের সঙ্গে রয়েছে সাংবাদিক কাদের মাহমুদ ও একলাস আহমেদ। শাহাদাত ও কাদের মিলে হায়দারের বক্তব্য লেখেন।

প্রবেশপথে তখন কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে মোতায়েন করা হয়। যাতে সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত কেউ সেখানে প্রবেশ করতে না পারে।

মেজর হায়দার, হাবিবুল আলম ও জিল্লুর রহিম

স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বীর প্রতীক খেতাব পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুল আলম বলেন, 'সকাল ৮টা ১০ মিনিটের দিকে স্টেশন থেকে সম্প্রচার শুরু হয়। ফতেহ বাংলায় ঘোষণা করেন যে, মেজর হায়দার সকাল ৮টা ১৫ মিনিটের দিকে ঘোষণা করবেন।'

বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া ঘোষণায় হায়দার বলেন, 'দেশ স্বাধীন হয়েছে এবং বাঙালিরা এখন স্বাধীন দেশের নাগরিক।' পরে তিনি দেশের সব মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণকে তাদের নিরাপত্তার জন্য আরও কিছু নির্দেশনা দেন।

ঘোষণার কাজ শেষ হলে তিনি সাদেক হোসেন খোকা ও তার দলের সদস্যদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে স্টেশন ত্যাগ করেন।

বিকেলে মেজর হায়দার টিভি থেকেও একই ধরনের ঘোষণা দেন। ঘোষণার বিষয়ে রাষ্ট্র পরিচালিত টেলিভিশনের তৎকালীন পরিচালক এজাজ আহমেদকে ফোন করেছিলেন ফতেহ।

মেজর হায়দার, শাহাদাত, ফতেহ, হাবিবুল ও আরেক মুক্তিযোদ্ধা আফিকুর রহমান বিকেল ৪টা থেকে সাড়ে ৪টার মধ্যে স্টেশনে পৌঁছান।

হাবিবুল আলম বলেন, 'আফিকুর ইংরেজি ঘোষণার জন্য চিত্রনাট্য প্রস্তুত করেন এবং সবকিছু সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়।' 

কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে মুক্ত হন চুল্লু

রেডিও ঘোষণার পর ফতেহ ও আলম ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য মাসুদ সাদিক চুল্লু ও আবদুস সামাদকেও উদ্ধার করেন। যারা আগস্টের শেষের দিকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছে গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ছিলেন।

দুই নম্বর গ্রিল গেটে তারা দেখতে পান ফর্সা চেহারার একজন লোক অন্য বন্দিদের পেছন থেকে এগিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং তিনি ছিলেন চুল্লু।

'আমরা আনন্দে চিৎকার করে উঠি এবং আমাদের গাল বেয়ে অশ্রু বয়ে যায়।… চুল্লু ভাই আমাদের বলেছিলেন যে, সামাদ ভাইও সেখানে আছেন এবং আমরা তাকেও বের করে আনি।' হাবিবুল আলম তার বইটিতে লিখেছেন।

তিনি আরও বলেন, 'নির্বাসনে থাকা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য একটি নথিতে সই করি আমি।'

১৯৭১ সালের ৩০ আগস্টে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় চুল্লুকে। যেখানে তার একটি অপারেশন করার কথা ছিল।

চুল্লুর গ্রেপ্তারের একদিন আগে তার সহকর্মী ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য বদিউল আলম বদি, শফি ইমাম রুমি, আব্দুল হালিম চৌধুরী জুয়েল ও মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হন। দুর্ভাগ্যবশত, তারা আর তাদের পরিবারের কাছে ফিরে আসেননি।

ছবি সৌজন্যে: হাবিবুল আলমের বই 'ব্রেভ অব হার্ট' থেকে।

ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মুনীর মমতাজ

Comments

The Daily Star  | English

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

10h ago