মুক্তিযুদ্ধ

অসীমে মুক্তির পথিক আলতাফ মাহমুদ

ছোটবেলায় দুষ্টুমি করে কাঁঠাল গাছের বাকলে নিজের নাম লিখেছিলেন 'ঝিলু দ্য গ্রেট'। কে জানতো সেদিনের সেই ছোট্ট ঝিলুর হাতেই গড়ে উঠবে প্রভাতফেরীর গান, কে জানতো সেই ঝিলুই দিনে দিনে হয়ে উঠবেন বাংলা সুরের মহীরুহরূপে।
শহীদ আলতাফ মাহমুদ। ছবি: সংগৃহীত

ছোটবেলায় দুষ্টুমি করে কাঁঠাল গাছের বাকলে নিজের নাম লিখেছিলেন 'ঝিলু দ্য গ্রেট'। কে জানতো সেদিনের সেই ছোট্ট ঝিলুর হাতেই গড়ে উঠবে প্রভাতফেরীর গান, কে জানতো সেই ঝিলুই দিনে দিনে হয়ে উঠবেন বাংলা সুরের মহীরুহরূপে।

মুক্তিযুদ্ধে তার বাসা হয়ে উঠবে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের নিরাপদ ভাণ্ডার হিসেবে। কে জানতো সেই ঝিলুই টর্চার সেলে মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সহযোদ্ধাদের অভয় দিয়ে বলবেন, 'তোমরা সবকিছু অস্বীকার করবে। আমি স্বীকার করেছি, সমস্ত দায় আমার। তোমাদের কোনো দোষ নেই।' সেই ঝিলু দ্য গ্রেট বাংলা গানের কিংবদন্তি সুরকার শহীদ আলতাফ চৌধুরী।

আলতাফ চৌধুরীর জন্ম বরিশালের মুলাদীর পাতারচর গ্রামে। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে জয়ন্তী নদী। ঝিলুদের বাড়িটা পরিচিত ছিল নাজেম মিয়ার বাসা নামে। নাজেম মিয়া হাওলাদার হলেন ঝিলুর বাবা। ছোটবেলায় গানের পাশাপাশি দারুণ ছবিও আঁকতেন ঝিলু। ছবি আঁকা ছিল তার অন্যতম নেশা। আনমনে আওড়ে যেতেন গানের কলি। এই গানগুলো মুখস্ত ছিল ঝিলুর। কেবল তাই নয়, সুরেলা কণ্ঠে দারুণ কোরআন তেলাওয়াতও করতেন।

একবার সারা বাড়ির দেয়ালে ঝিলু দ্যা গ্রেট লিখেছিলেন ঝিলু। কাঁঠাল গাছে খোদাই করে লেখাটি বাবার চোখ এড়ায়নি। নাজেম মিয়া বললেন, 'গাছে খোদাই কইরা আর গানবাজনা কইরা কি আর ঝিলু দ্যা গ্রেট হওন যায় রে? পড়াশোনা না করলে তুই কোনোদিনও গ্রেট হইতে পারবি না। সারাদিন খালি টইটই কইরা ঘুইরা বেড়ানো!'

তখন মুখে জলের ছিটে দিচ্ছিলো ঝিলু। ওখান থেকেই বললো, 'আমি ঝিলু দ্যা গ্রেট হইয়াই দেখামু।' 

আলতাফ মাহমুদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়েছিল গ্রামের স্থানীয় প্রাইমারি স্কুলে ১৯৩৮ সালে। এরপর বরিশাল জেলা স্কুল থেকে ম্যাট্রিক, বিএম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। এরপর চিত্রকলায় পড়তে চলে গিয়েছিলেন তিনি কলকাতা আর্ট স্কুলে। সেখানেই রাজনীতি সচেতন হয়ে ওঠা তার।

সংগীতে আলতাফ মাহমুদের হাতেখড়ি হয় প্রখ্যাত বেহালাবাদক সুরেন রায়ের কাছে। এরপর গণসংগীতে যাত্রা শুরু। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট প্রথম প্রহরে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি পাকিস্তানবরণ অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। তারও দুই বছর পরে বরিশালের অশ্বিনী কুমার টাউন হলে কৃষকদের এক সমাবেশে তিনি গেয়েছিলেন গণনাট্য সংঘের বিখ্যাত গান 'ম্যায় ভুখা হুঁ'।

আলতাফ মাহমুদ ঢাকায় আসেন ১৯৫০ সালে। সে বছরই যোগ দিয়েছিলেন ধূমকেতু শিল্পী সংঘতে। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু হয় 'মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করিল ভাষা বাঁচাবার তরে' গানটি দিয়ে। এই গানটির গীতিকার ছিলেন মোশাররফ উদ্দিন। সুরকার হিসেবে আলতাফ মাহমুদ অমরত্ব লাভ করেন ১৯৫৩ সালে আব্দুল গাফফার চৌধুরীর বিখ্যাত একুশের গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটি দিয়ে। অবশ্য এই গানটির তিনি ছিলেন দ্বিতীয় সুরকার। প্রথমে এই গানটির সুর দিয়েছিলেন তৎকালীন যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক সুরকার আব্দুল লতিফ।

সংগীত পরিচালক হিসেবে আলতাফ মাহমুদের যাত্রা শুরু হয়েছিল কুমিল্লা সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনে 'পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ' প্রযোজিত নৃত্যনাট্য 'কিষাণের কাহিনী' ও 'মজদুর' এ সংগীত পরিচালনার মধ্য দিয়ে। এরপরের বছরই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের সময়ে তার গাওয়া দুটি বিখ্যাত গান দারুণ জনপ্রিয়তা পায়। গানগুলো গাওয়ার জন্য তার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয়েছিল। গান দুটি ছিল 'মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা', ও ' মোরা কি দুঃখে বাঁচিয়া রবো'। একসময় তিনি গড়লেন পাকিস্তান গণনাট্য সংঘ। আলতাফ মাহমুদের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৫৮ সালে করাচি থেকে। এই রেকর্ডের সুরকার গীতিকার দুটোই ছিলেন তিনি। তার আগে একবার অস্ট্রিয়া যেতে গিয়ে তার পাসপোর্ট বাতিল হয়েছিল, যার ফলে তাকে করাচিতে থাকতে হয়েছিলো। ১৯৬৫ সালে তিনি শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন প্রখ্যাত সঙ্গীতজ্ঞ দেবু ভট্টাচার্যের। এসময় উচ্চাঙ্গ সংগীতে তিনি তালিম নিয়েছিলেন ওস্তাদ কাদের খাঁ'র কাছে। চলচ্চিত্রের গানে আলতাফ মাহমুদের হাতেখড়ি হয় নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'কার বৌ' চলচ্চিত্র দিয়ে। সে বছরই তিনি জহির রায়হানের বিখ্যাত 'বেহুলা' চলচ্চিত্রেও সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন। একই বছর সুফিয়া কামালের মধ্যস্থতায় বিয়ে হয়েছিল তার। ৬৯' এর গণ অভ্যুত্থানেও বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজের ব্যানারে রাজপথের আন্দোলনে শামিল ছিলেন আলতাফ মাহমুদ।

আলতাফ মাহমুদ ছিলেন গণমানুষের শিল্পী। প্রতিটি গণআন্দোলনে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন মানুষের পাশে। সেসব আন্দোলনে গানই ছিল হাতিয়ার। গান করেছেন তিনি গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গঞ্জ থেকে বন্দর, নগরে, রাজপথে। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই বরিশালে কৃষকদের জনসভায় 'ম্যায় ভুখা হুঁ' গান পরিবেশনের মধ্য দিয়ে যে যাত্রার সূচনা তারপর 'একুশের গান', 'মন্ত্রী হওয়া কি মুখের কথা', ১৯৭০ এর ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর 'এ ঝঞ্ঝা মোরা রুখবো'র মতো অসামান্য সব গানের মধ্য দিয়ে নাড়া দিয়েছিলেন মানব হৃদয়কে। আর তার অসীম ত্যাগের চির স্বাক্ষর তো আমরা পেয়েছি মুক্তিযুদ্ধেই।

মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের ৩৭০ আউটার সার্কুলার রোডের বাসা হয়ে উঠেছিল মুক্তিযোদ্ধাদের অন্যতম গোপন ক্যাম্প। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন আলতাফ মাহমুদ। তার সুরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অজস্র দেশাত্মবোধক গান প্রচারিত হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা তার বাড়িতে নিরাপদে অস্ত্র রাখতো। তার পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য অর্থও সংগ্রহ শুরু করেছিলেন আলতাফ মাহমুদ। 

৩০ আগস্ট ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আলতাফ মাহমুদের ৩৭০, আউটার সার্কুলার রোড রাজারবাগের বাসায় যায়। ওই বাসা থেকে আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে  আটক করা হয় আবুল বারাক আলভী, আলতাফ মাহমুদের চার শ্যালক লিনু বিল্লাহ, দিনু বিল্লাহ, নুহে আলম বিল্লাহ, খাইরুল আলম বিল্লাহসহ ছয় জনকে। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও নাখালপাড়ার ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন এমপি হোস্টেলের মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে তাদের উপর চালানো হয় পৈশাচিক নির্যাতন।

ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা ও শিল্পী আবুল বারাক আলভী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আলতাফ ভাইয়ের বাসায় ঢুকতেই তারা বললো 'মিউজিক ডিরেক্টর সাব কৌন হ্যায়?' আলতাফ ভাই বললেন, 'আমি'। তখন তাকে মারতে মারতে মাটি খুঁড়ে বের করা হয়েছিল অস্ত্র। মার্শাল কোর্টে যখন তাকে তোলা হলো তখন তার মধ্যে কোনো ভাবান্তর ছিল না। অথচ আমরা সবাই ভীষণ আতংকিত। তিনি যেন বুঝেই গিয়েছিলেন তার গন্তব্য। আলতাফ ভাই বলেছিলেন, "আমার সঙ্গে যারা এসেছে, আমি ছাড়া আর কেউই অস্ত্রের ব্যাপারে কিছু জানে না।" তিনি সবাইকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন।'

দ্য ডেইলি স্টারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহও একই কথা বলেন। আলতাফ ভাই বলেছিলেন 'সব দায় আমার। ওরা কিছুই জানে না।' আর আমাদের কাছে এসে বললেন, 'তোমরা সবাই অস্বীকার করবে। আমি বলেছি সমস্ত দায় আমার। তোমাদের কোনো দোষ নেই।'

সূত্র-

সুরের বরপুত্র শহীদ আলতাফ মাহমুদ/ দিনু বিল্লাহ

 

Comments

The Daily Star  | English
World Press Freedom Day 2024

Has Bangladesh gained anything by a restrictive press?

The latest Bangladesh Bank restriction on journalists is anti-democratic, anti-free press and anti-public interest.

8h ago