রমনা কালী মন্দির হত্যাযজ্ঞ

‘এ কোন সকাল রাতের চেয়েও অন্ধকার’

তৎকালীন রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুসলিম ছাত্রবাস জগন্নাথ হলে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়, হত্যা করে বহু ছাত্র-শিক্ষককে।

সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের কাছে রমনা কালী মন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রমের আশপাশের পরিস্থিতি ছিল ভয়ানক অস্বস্তিকর। জগন্নাথ হল থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দ ও ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যার খবর শুনে সেখানে বসবাসরত প্রায় ৭৫টি হিন্দু পরিবারের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক দেখা দেয়।

পরদিন সকাল ১১টার দিকে যখন পাকিস্তান সেনারা রমনা রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মন্দিরে এসে উপস্থিত হয়, তখন আতঙ্ক চরমে পৌঁছে। তারা পরিবারগুলোকে কোথাও না যাওয়ার নির্দেশ দেয়। কেননা ওই এলাকায় সেসময় কারফিউ চলছিল।

এর ১৫ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ ২৬ মার্চ দিবাগত রাত ২টার দিকে পাকিস্তানি সেনাদের আরেকটি দল মন্দিরে ঢুকে পড়ে। শুরুতেই তারা মন্দির এলাকার বৈদ্যুতিক সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এরপর সার্চলাইট মেরে পুরো এলাকা আলোকিত করে।

পরে ডেকে আনে মন্দিরের পুরোহিত স্বামী পরমানন্দকে। জোর করে কলেমা পাঠ করায়।

রমনা কালী মন্দিরে হত্যাযজ্ঞের অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী শংকর লাল ঘোষ দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তানিরা পুরোহিতকে জিজ্ঞেস করেন- তুমি হিন্দু না মুসলিম?'

'স্বামী পরমানন্দ যখন পাকিস্তানি সেনাদের জানান, তিনি মন্দিরের পুরোহিত। এরপর তাকে জোর করে কালেমা পাঠ করানো হয়। এখানেই শেষ হয়নি, এরপর তারা তাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করে। সবশেষে তার মৃত্যু নিশ্চিতে চালানো হয় গুলি', যোগ করেন তিনি।

আরেক প্রত্যক্ষদর্শী দিলীপ দাসের বয়স তখন আনুমানিক ১২ বছর। পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের মধ্যে মা তাকে নিয়ে মন্দিরের পকেট গেট দিয়ে পালিয়ে যাওয়ায় তিনি প্রাণে বেঁচে যান। তবে সেদিন তিনি বাবা ও দুই বোনকে হারান।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সেসময় বিবাহিত হিন্দু নারীরা হাতের শাঁখা ভেঙে ফেলেন। মুছে ফেলেন স্বামীর দীর্ঘায়ু কামনা করে সিঁথিতে টানা সিঁদুরও। জীবন বাঁচাতে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ' স্লোগান দিতে থাকেন মন্দিরের বাসিন্দারা। অনেকেই মন্দিরের বিভিন্ন স্থানে পালাতে চেষ্টা করলে সেখান থেকেও তাদের খুঁজে বের করে ধরে আনে পাকিস্তানি সেনারা।

দিলীপ দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জোরপূর্বক মন্দিরের পুরুষদের এক লাইনে ও নারীদের আরেক লাইনে দাঁড় করায়। এরপরই ব্রাশফায়ার শুরু করে। সবশেষে মন্দির ও আশ্রমে আগুন ধরিয়ে দেয়।'

শংকর লাল ঘোষও পুরুষদের সেই লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন। মর্মন্তুদ সেই রাতের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, 'আমার মাথার পাশ দিয়ে গুলি চলে যাওয়ার সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর কখন জ্ঞান ফিরেছে জানি না। জ্ঞান ফিরলে দেখি চারপাশে নিথর সব দেহ পড়ে আছে। টের পাই, আমার ডান হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলির নিচে গুলি লেগেছে। সেই ক্ষত আমি আজও বয়ে বেড়াচ্ছি।'

দুই বছরের বাচ্চা মেয়েকে কোলে নিয়ে জীবন বাঁচাতে ছুটেছিলেন বেলি রানী। দেওয়াল টপকে প্রাণে বেঁচেছিলেন তিনি। পরে হাইকোর্টের একটি নির্মাণাধীন ভবনে গিয়ে আশ্রয় নেন।

ওই ঘটনায় বেলি রানী হারিয়েছিলেন স্বামী শৌর্য দাস ও আরও দুই নিকটাত্মীয়কে।

তিনি ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রাতে নিরাপদ আশ্রয়ে থেকে সকালে ফিরে এসে ছাইয়ের মধ্যে খুঁজছিলাম স্বামীর শেষ চিহ্ন। তবে তার কিছুই মেলেনি। শুধু ছাইভস্ম ছাড়া আর কিছু্ই পাইনি।'

বাংলাপিডিয়ার মতে, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দক্ষিণ পাশে প্রায় ৩০০ বছর আগে রমনা কালী মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়।

এ মন্দিরে হত্যাযজ্ঞের শিকার হওয়াদের স্বজনরা ২০০০ সালে বিচারপতি কে এম সোবহানকে প্রধান করে গণতদন্ত কমিশন গঠন করেন। এ কমিশন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে শহীদদের সংখ্যা নিরূপণ ও কারণ অনুসন্ধানের জন্য গঠন করা হয়।

কমিশনের প্রতিবেদনে নিহতের সংখ্যা ৫০ এবং মন্দিরের সামনের স্মৃতিফলকে নাম আছে ৬১ জনের। তবে কমিশন জানায় যে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে, নিহতের সংখ্যা ৮৫ থেকে ১০০ এর মধ্যে হবে।

গণতদন্ত কমিশনের প্রাথমিক রিপোর্টে আরও বলা হয়, রমনা কালী মন্দিরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনারা মূর্তির দিকে এক ধরনের বিস্ফোরক ছুঁড়ে দেয়। কারও কারও মতে গোলাবর্ষণ করা হয়। ফলে মূর্তিসহ মন্দিরের পেছনের অংশ উড়ে যায়। মন্দির ও আশ্রম ধ্বংস করা হয়।

ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রকাশিত 'বাংলাদেশ ডকুমেন্টস'র (পরবর্তীতে দ্য ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড-ইউপিএল থেকে প্রকাশিত) প্রথম খণ্ডে বলা হয়, মার্কিন সিনেটর উইলিয়াম বি সেক্সবেকে লেখা এক চিঠিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত চিকিৎসক ডা. জন ই রোহডে রমনা কালী মন্দিরের হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ সিনেটে দেওয়া ভাষণে সেক্সবে এ হত্যাযজ্ঞের কথা উল্লেখ করেন।

রোহডে চিঠিতে লেখেন, ২৯ মার্চ আমরা ঢাকা রমনা রেসকোর্সের কেন্দ্রস্থলে প্রায় আড়াইশ লোকের একটি প্রাচীন হিন্দু গ্রাম রমনা কালীবাড়িতে দাঁড়িয়ে মেশিনগানের গুলিবিদ্ধ পুরুষ, নারী ও শিশুদের মরদেহের স্তূপ দেখেছিলাম।

আরেক মার্কিন সিনেটর গর্ডন অ্যালট ১৪ জুলাই সিনেটে তার ভাষণে জানান, দেশভাগের আগেও রমনা কালী মন্দির সাম্প্রদায়িক সংঘাত এড়াতে পেরেছিল।

তিনি বলেন, ২৯ মার্চ কালীবাড়িতে পোড়া ও মেশিনগানের গুলিবিদ্ধ মরদেহের স্তূপ দৃশ্যমান ছিল। পুরো গ্রাম পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

এখনো মেলেনি স্বীকৃতি

রমনা কালী মন্দির হত্যাযজ্ঞের শহীদদের স্বীকৃতি এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য গঠিত কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিপুল রায় ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে গণহত্যা সংক্রান্ত আলোচনায় রমনা কালী মন্দির এবং মা আনন্দময়ী আশ্রমে গণহত্যা খুব কমই আলোচনায় আসে।'

এই হত্যাযজ্ঞে দাদা ও বড় ভাইকে হারানো বিপুল বলেন, 'মন্দির হত্যাকাণ্ডের শহীদদের কাউকেই রাষ্ট্র "মুক্তিযুদ্ধের শহীদ" হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি।'

তারা স্বীকৃতি চেয়ে বিভিন্ন প্রতিবাদ কর্মসূচি ও সংবাদ সম্মেলন করেছেন, কিন্তু সবই বৃথা গেছে বলে জানান বিপুল।

'২০১৯ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আমাদের দাবি উত্থাপনের জন্য তার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু আমরা এখনো সেই সাক্ষাত পাইনি। আমরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি পূরণের জন্য অনুরোধ করছি', বলেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও সরকারি তদন্ত কমিশনের অন্যতম সদস্য মুনতাসির মামুন ডেইলি স্টারকে বলেন, 'রমনা হত্যাকাণ্ডে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের মুক্তিযুদ্ধের শহীদের স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। যাদের নাম ফলকে আছে, তাদের অন্তত স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।'

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ২ ধরনের- একটি গণশহীদ এবং অন্যটি যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাত বরণকারী শহীদ এবং যুদ্ধক্ষেত্রের শহীদদের পরবর্তীতে গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।'

'সরকার গণশহীদদের তালিকা তৈরির কথা ভাবছে। আমরা যদি তালিকা তৈরি করি, অবশ্যই রমনা কালী মন্দিরে প্রাণ হারানো ব্যক্তিদের নাম অন্তর্ভুক্ত করব', যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

US bomber jets leave UK base; Iran launches 'Fattah-1 missiles' towards Israel

Israel and Iran attacked each other for a sixth straight day on Wednesday, and Israeli air power reigns over Iran, but needs US for deeper impact

10h ago