মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: আবদুস সালেক চৌধুরী,বীর উত্তম

আবদুস সালেক চৌধুরী,বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের ১১তম পর্বে রইল এ আবদুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে আবদুস সালেক চৌধুরী ছিলেন ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সালদা নদী সাব সেক্টরের কমান্ডার। অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ১২।

১৯৭১ সালের মার্চে আবদুস সালেক চৌধুরী চাকরি করতেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। সে সময় তিনি কর্মরত ছিলেন ঢাকা সেনানিবাসে। ২২ এপ্রিল তিনি পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। প্রাথমিক পর্যায়ে খালেদ মোশাররফ, বীর উত্তমের অধীনে কুমিল্লা অঞ্চলে যুদ্ধ করেন আবদুস সালেক চৌধুরী। পরে সেক্টর গঠিত হলে আবদুস সালেক চৌধুরীকে ২ নম্বর সেক্টরের সালদা নদী সাব সেক্টরের অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সালদা নদী সাব সেক্টর এক অসামান্য স্থান দখল করে আছে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ রণাঙ্গন বলা হয় সালদা নদী সাব সেক্টরকে। এ  সাব সেক্টর গঠিত হয়েছিল তৎকালীন কুমিল্লার শালদা নদী এলাকা, নয়নপুর, বুড়িচংসহ বেশ কিছু এলাকা নিয়ে। এর মোট আয়তন ছিল ২০০ বর্গ কিলোমিটার। মুক্তিযুদ্ধের বিখ্যাত এই রণাঙ্গন মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনী ২ পক্ষের কাছেই ছিল এক চ্যালেঞ্জের নাম। সালদা নদী সাব সেক্টর সামরিক দিক থেকেও ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। আবদুস সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী  পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে এই অঞ্চলে প্রথম যুদ্ধ করে জুলাই মাসে। সবশেষ অপারেশন হয় ১৫ নভেম্বর।

সালদা নদী সাব সেক্টরে ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গলের আলফা কোম্পানি, ইপিআরের একটি এক্স কোম্পানি এবং গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অংশ নিয়েছিলেন। 

মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এই অঞ্চলে যথোপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব ভীষণভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছিল। ২৫ জুলাই মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ গড়ে তোলেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীও পাল্টা জবাব দিয়ে ব্যাপক গোলাবর্ষণ করে। ফলে ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। ২৬ জুলাই এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পাকিস্তানি বাহিনী মনোয়ারা ব্রিজের দিকে পিছু হটতে শুরু করে। মনোয়ারা ব্রিজের কাছে গিয়ে তারা প্রতিরক্ষা ব্যূহ তৈরি ও ব্রিজ মেরামত করতে গেলে আবদুস সালেক চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা ২৭ জুলাই তাদের উপর ফের আক্রমণ করে। প্রায় ৩ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ব্যাপক ক্ষতি হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ১০ আগস্ট মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীর নির্দেশে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের চারদিক ঘিরে ফেলে এবং থেমে থেমে প্রচণ্ড আক্রমণ গড়ে তোলে। এ সময় মুক্তিবাহিনী ও পাকিস্তানি বাহিনীর মধ্যে টানা ৪ দিন গোলাবর্ষণ চলে। এই যুদ্ধের ফলে পাকিস্তানি বাহিনী সালদা নদী এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ৪ দিনব্যাপী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬০ জন সেনা নিহত হয়। তখন পাকিস্তানি বাহিনী ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দিকে পালিয়ে যায়।

নয়নপুর বাজার ছিল সালদা নদী সাব সেক্টরের অধীনে। সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের কাছেই নয়নপুর বাজার।  সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন এলাকাতে পাকিস্তানি সেনাদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর বড় ধরনের সংঘর্ষ হয়। এ সময় সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে। সালদা নদী স্টেশন ছিল ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান। কারণ এই স্টেশনের সঙ্গেই ঢাকা-চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগ ছিল। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সালদা নদী স্টেশন দখলে করতে চাইলেন।

এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ৩৩ বেলুচ রেজিমেন্টের প্রায় এক ব্রিগেড সেনা কুটি ও কসবা এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করে অবস্থান নেয়। সালদা নদীর দক্ষিণেও ৩০ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট অবস্থান নেয়। মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী সালদা নদী অতিক্রম করে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পশ্চিমে গোডাউন সংলগ্ন এলাকায় অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা সালদা নদীর উত্তরে অবস্থান নেয়। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানি নিয়ে নয়নপুর সড়কে অবস্থান নেন। ক্যাপ্টেন পাশা আর্টিলারি বাহিনী নিয়ে ছিলেন মন্দভাগেই। সুবেদার জব্বার তার মর্টার সেকশন নিয়ে বাঁকের পেছনে সাপোর্ট সেকশন হিসেবে রইলেন।

সকাল সাড়ে ৬টায় ক্যাপ্টেন এ এম পাশার আর্টিলারি ফায়ারের মাধ্যমে শুরু হয় আক্রমণ। এরপর মুক্তিবাহিনী চতুর্দিক থেকে আক্রমণ গড়ে তোলে। পাকিস্তানি বাহিনীও বুড়িচং, কসবা, কুটি ও চানলার দিক থেকে ফায়ার করতে শুরু করে। ক্যাপ্টেন আশরাফ তার কোম্পানি নিয়ে নয়নপুরে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর চাপ অব্যাহত রাখেন। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতায় পাকিস্তানি বাহিনী নয়নপুর ছেড়ে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের ঘাঁটিতে আশ্রয় নেয়। এ সময় ক্যাপ্টেন গাফফারও তার বাহিনী নিয়ে নয়নপুর ব্রিজের কাছে পৌঁছে যান। 

পাকিস্তানি বাহিনী তখন অনেকটা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী ও ক্যাপ্টেন গাফফার ভাবলেন, যে করেই হোক পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করাতেই হবে। ফলে মেজর সালেক আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দেন। কিন্তু ঠিক তখনই গোলাবারুদ ফুরিয়ে যায় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীর।  পরিস্থিতি প্রচণ্ড বিপজ্জনক হলেও আবদুস সালেক চৌধুরী সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন। এক পর্যায়ে তিনি মন্দভাগে ফিরে আসেন।  এই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনী সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশন দখল না করতে পারলেও নয়নপুর দখল করে নেয়, যা মুক্তিবাহিনীর জন্য অসামান্য এক সাফল্য ছিল। এই যুদ্ধের পর সালদা নদী স্টেশনের পুরো দায়িত্ব দেওয়া হয় ক্যাপ্টেন আবদুল গাফফার হালদারকে।

মুক্তিযুদ্ধের সেপ্টেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে মেজর খালেদ মোশাররফকে ২ নম্বর সেক্টরের সৈনিকদের পুনর্গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। নির্দেশ আসে কে ফোর্স গঠনের। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাব সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে মেলাঘরে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, চতুর্থ বেঙ্গলের এ কোম্পানি ও বি কোম্পানির অবশিষ্ট সৈনিক দিয়ে ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট গঠন করা হবে। মেজর সালেককে এই ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। মেজর সালেককে সেনাসহ বিলোনিয়াতে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। দশম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে রাজনগর সাব সেক্টরে পুনর্গঠন ও পুনর্বিন্যাস করা হবে বলে পরিকল্পনা করা হয়। এরপর ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীকে।

২৩ অক্টোবর মেজর আইনউদ্দিনের সঙ্গে কসবা অপারেশনে গিয়ে কমলা সাগরে পাকিস্তানি বাহিনীর শেলের আঘাতে ২ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার ও কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ গুরুতর আহত হন। তখন কে ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরীকে।

এ সময় মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়কত্ব ছেড়ে দেন ক্যাপ্টেন জাফর ইমামকে। ২ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার হন মেজর এটিএম হায়দার। এরপর মেজর আবদুস সালেক চৌধুরী কে ফোর্সের অধীনে থাকা অঞ্চলগুলোতে বিখ্যাত সব যুদ্ধে নির্দেশনা  দিয়েছিলেন।

আবদুস সালেক চৌধুরীর জন্ম ১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকার দোহারের হাতুরপাড়া গ্রামে। সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে মাধ্যমিক এবং নটরডেম কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর ১৯৬৫ সালে তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে। প্রথম বর্ষে থাকাকালেই যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে।  পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন পান ১৯৬৭ সালে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কর্মরত ছিলেন তিনি। ১৯৭২ সালের ১৯ নভেম্বর মারা যান আবদুস সালেক চৌধুরী, বীর উত্তম।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর ২

বাংলাপিডিয়া

 

আহমাদ ইশতিয়াক

 [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Ten non-banks lose Tk 1,079cr in H1

Bangladesh has 35 NBFIs, of which 23 are listed. 16 have published their half-yearly data so far, seven are yet to report.

10h ago