খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ আফতাবুল কাদের,বীর উত্তম

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)
ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব, নেতৃত্ব প্রদর্শনের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তর খেতাবে তার সনদ নম্বর ২১।
১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২ মাসের ছুটিতে দেশে আসেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের। ১৯ ফেব্রুয়ারি খালাতো বোনের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকার বাড়িতেই ছিলেন আফতাব। নারকীয় গণহত্যার চিত্র দেখে পরদিন সিদ্ধান্ত নেন, তিনি আর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যাবেন না। ২৮ মার্চ তিনি ঢাকা ছেড়ে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে।
১৩ এপ্রিল দুপুরে মেজর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেন ক্যাপ্টেন আফতাব। মেজর জিয়া তাকে অষ্টম বেঙ্গলের সাথে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়ে মহালছড়িতে ডিফেন্স নিতে বলেন। এই যুদ্ধ শেষে ক্যাপ্টেন আফতাব অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলকে নিয়ে ফেনীর ছাগলনাইয়ার শুভপুর প্রতিরক্ষায় অবস্থান নেন। এর পরপরই পাকিস্তানি বাহিনী সিদ্ধান্ত নেয় শুভপুরে হেলিকপ্টার থেকে ছত্রী সেনা নামানোর।
শুভপুরে যখন পাকিস্তানি ছত্রী সেনা নামানো হচ্ছিল, তখন গ্রামবাসীর সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা এক সেনাকে ধরে ফেলেন। শুভপুর থেকে রামগড়ে ফিরে এসে ৫০০ তরুণকে নিয়ে আফতাব গড়ে তোলেন প্রশিক্ষণ ক্যাম্প। প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় প্রায়ই আফতাব বলতেন, 'একজন পাকিস্তানি সেনাকে খতম করার অর্থ হলো এ দেশের অন্তত এক লাখ নিরীহ মানুষ ও নারীকে নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা করা।'
এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় পাকিস্তানি বাহিনীকে রাঙ্গামাটিতে অবস্থান নেওয়ার অনুরোধ জানালে পাকিস্তানি সেনারা ১৫ এপ্রিল রাঙ্গামাটি শহরে যায়। এ খবর পেয়ে ১৬ এপ্রিল ক্যাপ্টেন আফতাবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা খাগড়া রেস্ট হাউজে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাদের ওপর হামলা চালান। এই হামলায় পাকিস্তানি বাহিনীর ২০ সেনা নিহত হয়।
২৩ এপ্রিল ২ কোম্পানি পাকিস্তানি সেনা রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হলে মেজর শওকত আলীর নির্দেশে তাদের প্রতিরোধ করার জন্য অগ্রসর হন ক্যাপ্টেন আফতাব। বুড়িঘাট থেকে রওনা দিয়ে ক্যাপ্টেন আফতাবদের লঞ্চটি যখন একটি দ্বীপে পৌঁছে, তখনই পাকিস্তানি বাহিনীর একটি লঞ্চ তাদের ওপর আক্রমণ চালায়। অতর্কিত আক্রমণে প্রথমে খানিকটা পিছু হটলেও ক্যাপ্টেন আফতাবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী ঘুরে দাঁড়ায়। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনারা পিছু হটে।
মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সুবিধাজনক জায়গায় না থাকায় যুদ্ধ শেষেই মহালছড়ির উদ্দেশে রওনা দেন ক্যাপ্টেন আফতাব। পাকিস্তানি বাহিনীও তাদের শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। প্রথমে তারা মিজোরামের ২টি বিদ্রোহী গ্রুপকে নিজেদের দলে সংযুক্ত করল। পাকিস্তানি বাহিনী বুঝতে পারে, রামগড়ই এই অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর হেডকোয়ার্টার। তাই তারা রামগড় হেড কোয়ার্টারের দিকে অগ্রসর হতে শুরু করে।
কালুরঘাট থেকে পশ্চাদপসরণের পর অষ্টম বেঙ্গলের একটি দল কাপ্তাই রাঙ্গামাটি হয়ে মহালছড়িতে পৌঁছায়। সেখানে পৌঁছে রামগড়ের অবস্থানকে নিরাপদে রাখার জন্য প্রতিরক্ষা অবস্থান নিয়ে হেড কোয়ার্টার স্থাপন করে তারা। ক্যাপ্টেন আফতাব এবং ক্যাপ্টেন চৌধুরী খালিকুজ্জামানও ঘাঘরাতে একটি ক্যাম্প স্থাপন করেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর ২টি কোম্পানি এরই মধ্যে রাঙ্গামাটি থেকে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হয়ে কচুছড়িতে পৌঁছায়। তাদেরকে প্রতিরোধ করার জন্য মহালছড়ি হেডকোয়ার্টার থেকে মেজর শওকত আলী ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজকে নির্দেশ দেন। তখন ক্যাপ্টেন আফতাব এবং লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তাদের কোম্পানি থেকে বেশ কিছু সেনা নিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলা চালালে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা হতাহত হয়। এদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর অন্য আরেকটি দল চেঙ্গী নদী দিয়ে নানিয়ারচর বাজার হয়ে মহালছড়ির দিকে অগ্রসর হয়।
২৬ এপ্রিল গোয়েন্দার মাধ্যমে মেজর মীর শওকত আলী পাকিস্তানি বাহিনীর মহালছড়ি আক্রমণের মূল যুদ্ধ সম্পর্কে জানতে পারেন এবং শত্রুর বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য পরদিন ভোরে হাবিলদার তাহেরের নেতৃত্বে একটি রেকি পেট্রোল পাঠান। হাবিলদার তাহেরও শত্রু সম্বন্ধে প্রাপ্ত সংবাদ নিশ্চিত করেন। জানা যায়, পাকিস্তানি বাহিনী চেঙ্গী নদী ও নানিয়ারচর বাজার হয়ে মহালছড়ি আক্রমণের পরিকল্পনা করছে।
পাকিস্তানি বাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিরোধ করতে মহালছড়ির ডাক বাংলোতে অবস্থিত টেকনিক্যাল হেডকোয়ার্টার থেকে মেজর শওকতের নির্দেশে ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের, ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান ও লেফটেন্যান্ট মাহফুজ তাদের বাহিনী নিয়ে পেছনে চলে আসেন। এরপর ক্যাপ্টেন আফতাব মহালছড়ি-নানিয়ারচর সড়ক অবরোধের জন্য এবং ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামান নানিয়ারচর বাজারে একটি পাহাড়ের উপর স্ব স্ব কোম্পানি নিয়ে অবস্থান নেন। লেফটেন্যান্ট মাহফুজকে পাশের বাজারে রিজার্ভ হিসেবে রাখা হয়।
২৭ এপ্রিল সকাল থেকেই মহালছড়ির অবস্থা থমথমে ছিল। সকাল ৯টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের এক কোম্পানি সেনা এবং মিজো ব্যাটালিয়নের প্রায় ১ হাজার মিজো বিদ্রোহী নানিয়ারচর এলাকায় অবস্থানরত অষ্টম বেঙ্গলের ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামানের ওপর হামলা শুরু করে। এ সময় লেফটেন্যান্ট মাহফুজের নির্দেশে তার রিজার্ভ দলটি ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামানের দলের দিকে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে যায়। কিন্তু লেফটেন্যান্ট মাহফুজের দলটি ঘটনাস্থলে পৌঁছানোর আগেই পাকিস্তানি বাহিনী খালিকুজ্জামানের অবস্থানের চারপাশ ঘিরে ফেলে। শুরু হয় প্রচণ্ড যুদ্ধ।
এই অবস্থায় লেফটেন্যান্ট মাহফুজের প্লাটুনের কভারিং ফায়ারের মাঝখান দিয়ে ক্যাপ্টেন খালিকুজ্জামানের কোম্পানি কিছুটা পিছিয়ে আসতে থাকে। প্রায় ৩ ঘণ্টা যুদ্ধের পর মুক্তিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে আসে। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনী মহালছড়ি ঘাঁটিতে ৩ ইঞ্চি মর্টার ফায়ার শুরু করেছে। পাকিস্তানি বাহিনী গোলা ছুড়লে মুক্তিবাহিনীর চতুর্দিক ধোঁয়ায় ঢেকে যায়। আর মিজোদের আক্রমণ ছিল প্রচলিত আক্রমণের বাইরে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রচণ্ড বিভ্রান্তিতে পড়ে যান।
বিষয়টি খেয়াল করে পাকিস্তানি বাহিনীও প্রচলিত আক্রমণের বাইরে অন্যভাবে আক্রমণ শুরু করে। গোপনে পাকিস্তানি বাহিনী হেলিকপ্টারযোগে দ্বিতীয় কমান্ডো ব্যাটালিয়নের আরও এক কোম্পানি সেনা নামিয়ে দেয় মিজো বাহিনীর সঙ্গে। সঙ্গে মিজোদের আরও বেশ কয়েকটি দলও চলে আসে। এই দলগুলো পাহাড় ও জঙ্গলের আড়ালে সুবিধাজনক জায়গায় অবস্থান নেয়। পাহাড় থেকে তারা শুধু যে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরক্ষা অবস্থান দেখতে পাচ্ছিল তা নয়, গুরুত্বপূর্ণ মহালছড়ির রাস্তাও দেখতে পাচ্ছিল।
ফলে পুরো এলাকা পাকিস্তানিদের আওতার মধ্যে চলে আসে। পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধ চালানোর জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ না থাকায় এবং প্রয়োজনীয় রসদ ও গোলাবারুদ ফুরিয়ে যাওয়ায় ২ কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা মহালছড়িতে ব্যাপক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। প্রথমদিকে মুক্তিবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানিদের হতাহতের সংখ্যা বাড়লেও পরে পাকিস্তানিরা ঘুরে দাঁড়ায়।
দুপুর ৩টায় ক্যাপ্টেন আফতাবের নেতৃত্বাধীন দলটি মহালছড়ি এসে পৌঁছায়। ক্যাপ্টেন আফতাবের বাহিনীর প্রতিরোধের মুখে মিজো বাহিনী প্রথম অবস্থায় পিছু হটতে শুরু করলে পাকিস্তানিরা বেপরোয়া হয়ে উঠে। পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা ছিল প্রায় ৪ গুণ। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললে আফতাবুল কাদেরের সহযোদ্ধারা তাকে পিছু হটার পরামর্শ দেন।
কিন্তু ক্যাপ্টেন আফতাব পিছু না হটে সহযোদ্ধা শওকত, ফারুক ও ২ ইপিআর সেনাকে নিয়ে ৩টি এলএমজির অবিরাম গুলিবর্ষণের মধ্য দিয়ে কোণঠাসা করে ফেলেন শত্রুদের। এই চরম মুহূর্তে হঠাৎ এক মুক্তিযোদ্ধার এলএমজির ফায়ারিং বন্ধ হয়ে গেলে শতাধিক মুক্তিযোদ্ধার জীবন বিপন্ন হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। অস্থির হয়ে উঠেন ক্যাপ্টেন আফতাব। মেরামতের জন্য দ্রুত অস্ত্রটি তার কাছে নিয়ে আসার নির্দেশ দেওয়ার পর মেজর শওকত আলীর আসতে দেরি হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন আফতাব তখন নিজে ক্রলিং করে এগিয়ে যেতেই কয়েকটি গুলি এসে তার পেটের বাম পাশে এবং ডান বাহুর নিচে লাগে। এই অবস্থায়ও মেশিনগান ধরে ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাব।
বৃষ্টির মতো গোলাগুলির মধ্যেই গুরুতর আহত আফতাবকে পাহাড় থেকে নামিয়ে একটু নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসেন শওকত, ফারুক ও ইপিআরের ড্রাইভার আব্বাস। তীব্র গোলাগুলির মধ্যেই ড্রাইভার আব্বাস তাকে জিপে তুলে রামগড়ের দিকে রওনা দেন। পথেই শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করেন ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদের।
শহীদ আফতাবুল কাদের ইকবালের জন্ম ১৯৪৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর দিনাজপুর শহরে। তাদের পৈত্রিক নিবাস ছিল লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ থানার তেওড়ি গ্রামে। তার পরিবার থাকতেন পুরান ঢাকার ফরিদাবাদ এলাকার লালমোহন পোদ্দার লেনে। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে ময়মনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং আনন্দমোহন কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ করেছিলেন তিনি। এরপর তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে।
সেই বছরই পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন আফতাবুল কাদের। ২ বছর পর ১৯৬৯ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আর্টিলারি কোরে কমিশনপ্রাপ্ত হন তিনি। এরপর ১৯৭০ সালে হায়দারাবাদ ক্যান্টনমেন্টে ৪০ ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টে ক্যাপ্টেন হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন আফতাবুল কাদের, বীর উত্তম।
তথ্যসূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস: সেক্টর -১
মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের বীর উত্তম/ লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীর প্রতীক
আহমাদ ইশতিয়াক
Comments