মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম

শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ,বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

মুক্তিযুদ্ধে কামালপুর যুদ্ধে শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ছিলেন জেড ফোর্সের প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানির কমান্ডার। যুদ্ধের ময়দানে তাকে ডাকা হতো রিয়েল টাইগার নামে। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব, নেতৃত্ব ও ত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। তার সনদ নম্বর ২৩।  

মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ছিলেন পাকিস্তানের ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে কর্মরত। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি ও ৪ বাঙালি অফিসার পাকিস্তানের শিয়ালকোটের মারালা সীমান্তের খরোস্রোতা মুনাওয়ার তায়ী নদী অতিক্রম করে প্রচণ্ড ঝুঁকি নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। এ সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজসহ বাকিদের সঙ্গে অস্ত্র বলতে ছিল কেবল পিস্তল।

সীমান্ত অতিক্রম করে বিএসএফের ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে দিল্লি হয়ে কলকাতায় পৌঁছান তারা। সেখানে জেনারেল ওসমানী এই ৫ জনকে বরণ করে নেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ আগে প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে কর্মরত থাকায় তাকে তার ইচ্ছে অনুযায়ী প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োগ দেওয়া হয়।

মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে প্রথম, তৃতীয় ও অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিয়ে জেড ফোর্স গঠনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন জেড ফোর্স কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান  কনভেনশনাল  ওয়্যার বা প্রচলিত ধারার যুদ্ধ করার পরিকল্পনা করেন। প্রথম ইস্ট বেঙ্গলকে জামালপুরের ধানুয়া কামালপুরের বিওপি দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়। 

অপারেশন কামালপুরকে বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বিপজ্জনক ও দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ। ৩১ জুলাই কামালপুরের প্রথম যুদ্ধ হয়। মুক্তিযুদ্ধে এটিই ছিল প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ।  

কামালপুর বিওপি ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। সেখানে বালুচ রেজিমেন্টের ১ প্লাটুন সেনা, ৭০ উইং রেঞ্জার্স ইউনিটের ১ প্লাটুন ও রাজাকারদের ১ প্লাটুন সদস্য ছিল। কামালপুর বিওপিতে আক্রমণের আগে ২৮ জুলাই বিকেলে কৃষকের ছদ্মবেশে রেকি করেন ব্রাভো কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ, সুবেদার আলী হোসেন, ফয়েজ ও সিদ্দিক।

একই রাতে ডেল্টা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, লেফটেন্যান্ট আবদুল মান্নান, সুবেদার হাই, হাসেম ও নায়েক সফি রেকি করতে যান। অন্ধকারে  ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ পাকিস্তানি লিসনিং পোস্টের কাছে যেতেই এক পাকিস্তানি সেনা 'হল্ট' বলে চিৎকার দিয়ে উঠে।  

ওই সময় লিসনিং পোস্টে ২ পাকিস্তানি  সেনা সদস্য ছিল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ তখন এক সেনাকে জড়িয়ে ধরে মাটিতে ফেলে দেন। এসময় সুবেদার হাই গুলি করেন। মুহূর্তেই ২ পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। হঠাৎ আক্রমণ ও ২ সেনার নিহত হওয়ার পর পাকিস্তানি বাহিনী পূর্ণ সতর্ক হয়ে যায়। তারা ভেবেছিল, এটি ভারতীয় বাহিনীর কাজ। মুক্তিবাহিনী এ ধরনের হামলা করবে তা তাদের ভাবনার বাইরে ছিল। ভারতীয় বাহিনী ফের আক্রমণ করতে পারে ভেবে ঢাকা থেকে  বিপুল সংখ্যক সেনা পাঠানোর অনুরোধ করলে পরদিন জেনারেল নিয়াজীর নির্দেশে  দ্বিগুণ সেনা ও অত্যাধুনিক অস্ত্র  পাঠানো হয় বিওপিতে।  

এরপর ২ দফা রেকি শেষে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ, ক্যাপ্টেন হাফিজ রেকির তথ্য উপস্থাপন করলে ৩০ জুলাই বিকেলে রেজিমেন্ট অধিনায়ক মেজর মঈনুল হোসেন চূড়ান্ত যুদ্ধের নির্দেশ দেন। আক্রমণের সময় ঠিক হয় ৩১ জুলাই রাত সাড়ে ৩টা। ঠিক হয়, আক্রমণ শুরু হবে কামালপুর বিওপির খোলা মাঠের পাশ থেকে। প্রথম আক্রমণ করবেন ক্যাপ্টেন হাফিজ ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানি।

৩০ জুলাই সূর্যাস্তের আগেই মুক্তিযোদ্ধারা ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক সচল করে মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে যাত্রা শুরু করেন। পথে বৃষ্টির কারণে মুক্তিযোদ্ধাদের চলার গতি কমে যায়। এফইউপিতে পৌঁছাতে তাই কিছুটা দেরি হয় তাদের। রাত সাড়ে ৩টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা পজিশনে যাওয়ার আগেই ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি কোনো সংকেত ছাড়াই গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান আঁচ করতে পারে এবং গোলা নিক্ষেপ শুরু করে। অথচ পরিকল্পনা ছিল, ক্যাপ্টেন হাফিজ এফইউপিতে পৌঁছে নির্দেশ দিলে তবেই ভারতীয় মাউন্টেন ব্যাটারি গোলাবর্ষণ শুরু করবে। 

পাকিস্তানিদের আচমকা হামলায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। কিন্তু ভারতীয় বাহিনীর গোলার অবস্থান নির্ণয় করতে পেরে পাকিস্তানি সেনারা বাঙ্কারে অবস্থান নেওয়ায় গোলাতে কোন কাজ হচ্ছিল না। ফলে ব্রাভো ও ডেল্টা কোম্পানির পক্ষে শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে হামলা করা অসাধ্য হয়ে পড়ে। ক্যাপ্টেন হাফিজের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানি শত্রু বাঙ্কার অভিমুখে আক্রমণ শুরু করে।  পাকিস্তানি সেনারা তখন মুক্তিযোদ্ধাদের সরাসরি দেখতে পাচ্ছিল। এরই মধ্যে  হঠাৎ বিকল হয়ে পড়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়্যারলেস নেটওয়ার্ক। সংকেতের কারণে  আর্টিলারি ফায়ার বন্ধও সম্ভব হচ্ছিল না। তীব্র গোলাগুলি ও পাল্টা গোলা বর্ষণের তীব্র আওয়াজে শুধু চিৎকারের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষাও কঠিন হয়ে পড়ে।

এমন পরিস্থিতির মধ্যে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের ডেল্টা কোম্পানি ও  ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো কোম্পানি ও মুক্তিযোদ্ধারা ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে এফিউপিতে পৌঁছানোর চেষ্টা করেন। ভয়াবহ যুদ্ধে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। সাময়িকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের  আক্রমণের গতি থেমে যায়। এই অবস্থায়  ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ অসাধারণ নেতৃত্ব দেন।  সেনাদের  মনোবল ফিরিয়ে আনতে অনুপ্রেরণা দিতে থাকেন তিনি।

ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের প্রেরণায় মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে হারানো মনোবল ফিরে আসে। বিপুল বিক্রমে ঘুরে দাঁড়ান মুক্তিযোদ্ধারা। সালাউদ্দিন মমতাজ ২০-২৫ জনকে নিয়ে বিওপির কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে যান। মেগাফোনে  সুবেদার হাইয়ের প্লাটুনকে ডানদিকে যাওয়ার নির্দেশ দেন তিনি। আক্রমণের শুরুতে সুবেদার হাইয়ের প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ছিল ৪০ জন। আর এই পর্যায়ে এসে তার প্লাটুনে মুক্তিযোদ্ধা ১৫ জনের মতো। মাইনের আঘাতে নায়েক শফির হাত উড়ে গেছে। অগ্রসরমান মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনকে বারবার পিছু হটার জন্য অনুরোধ করতে থাকেন।

এ সময় ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের সামনে পাকিস্তানি সেনাদের ছোড়া  কয়েকটি গোলা বিস্ফোরিত হয়। শহীদ হন তিনি।

শহীদ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজের জন্ম ১৯৪৫ সালের ১২ জুলাই ফেনী সদর থানার উত্তর চাড়িপুর গ্রামের মুক্তারবাড়িতে। দেবীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি তার। এরপর ফেনী সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মেট্রিক পাস করেন। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে তিনি কিছুদিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লাহোর দয়াল সিং কলেজে পড়াশোনা করেন। শেষে ফেনী কলেজ থেকে আইএসসি পাস করেন। এই কলেজে বিএসসি অধ্যয়নকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন তিনি।

১৯৬৭ সালে ২৭ আগস্ট কাকুলের পাকিস্তানি মিলিটারি একাডেমি থেকে ১২৪ জন ক্যাডেটের মধ্যে তিনি তৃতীয় স্থান দখল করে কমিশন পেয়েছিলেন। এরপর তার পোস্টিং হয় প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। ১৯৬৭ সালের ২৭ আগস্ট থেকে ১৯৭১ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিনি প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে নিয়োজিত ছিলেন। পাকিস্তানের মারিতে স্কুল অফ মিলিটারি ইনটেলিজেন্সে কোর্স শেষ করার পরে ১৯৭১ সালের ৩ মে তাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৪৩ বেলুচ রেজিমেন্টে বদলি করা হয়।    

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ব্রিগেড ভিত্তিক ইতিহাস

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: ১০ম খণ্ড

 

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Health Sector Reform Commission submits report to Yunus

Reform commission for universal primary healthcare

Also recommends permanent independent commission to govern heath sector

1h ago