মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম

মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল মোহাম্মাদ আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা।)

শহীদ লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে প্রথম বাঙালি শহীদ অফিসার। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ২৬।

১৯৭১ সালের মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কর্মরত ছিলেন। ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান ছিল যশোরে। একাত্তরের মার্চ মাসে মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন ছিলেন যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ১৫ মাইল দূরে জগদীশপুর এলাকায় কালেকটিভ প্রশিক্ষণে।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে সম্ভাব্য ভারতীয় আগ্রাসনের কথা বলে ১ম ইস্ট বেঙ্গলের আক্রমণাত্মক ক্ষমতা কমিয়ে ফেলার জন্য যশোর ক্যান্টনমেন্টের বাইরে বেনাপোল সীমান্ত এলাকার জগদীশপুর গ্রামে পাঠানো হয়। জুন মাস নাগাদ এই ব্যাটেলিয়নটির পাকিস্তানের শিয়ালকোট ক্যান্টনমেন্টে দুই বছরের জন্য বদলি হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। তাই ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে ব্যাটেলিয়নের অর্ধেক সেনাকে ছুটিতে পাঠিয়ে বাকি ৩৫০ সেনাকে ক্যান্টনমেন্টের বাইরে মোতায়েন রাখা হয়েছিল। প্রশিক্ষণে থাকাকালীন সময়ে রেডিও শোনা ও পত্রিকা পড়ার সুযোগ না থাকায় তারা বাইরের খবর পেতেন না।

এই ব্যাটেলিয়নের সিও ছিলেন লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল। টু আই সি ছিলেন পাঞ্জাবি অফিসার মেজর ইকবাল কোরেশি। সিও ছাড়াও দুজন বাঙালি অফিসার ছিলেন ব্যাটেলিয়নে। তারা ছিলেন আলফা কোম্পানির কমান্ডার ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মেদ, এবং চার্লি কোম্পানির প্লাটুন কমান্ডার সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট মোহাম্মাদ আনোয়ার হোসেন। বাকি অফিসারেরা সবাই ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি।

১৪ মার্চ মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের আত্মীয় ওয়াকার হাসান (পরবর্তীতে মেজর এবং বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত) তাকে যশোরে দেখতে গিয়েছিলেন। তখন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন একদিনের ছুটি নিয়ে যশোরে এসে তার সঙ্গে দেখা করেন এবং দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে প্রশিক্ষণে থাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর নারকীয় ও পৈশাচিক গণহত্যা সম্পর্কে অন্ধকারে ছিলেন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন।

২৯ মার্চ বেলা ১২টায় ১০৭ নম্বর ব্রিগেডের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুরদানি প্রশিক্ষণরত বাঙালি অফিসারদের বাঙালি সেনাদের নিয়ে যশোরে পৌঁছাতে বলেন। এরপর ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহম্মদ, লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সেনাদের নিয়ে জগদীশপুর থেকে যশোর অভিমুখে রওনা দেন। এদিন রাত ১২টায় যশোর ক্যান্টনমেন্টে এসে পৌঁছান ক্যাপ্টেন হাফিজ, লেফটেন্যান্ট আনোয়ার ও ব্যাটেলিয়নের বাঙালি সেনারা।

৩০ মার্চ ব্রিগেডিয়ার আব্দুর রহিম দুরদানি ব্যাটেলিয়ন অফিসে যান এবং ব্যাটেলিয়নের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিলকে বলেন, '১ম ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটেলিয়নকে নিরস্ত্র করা হয়েছে এবং বাকিদের সকল অস্ত্রশস্ত্র ও জমা দিতে হবে।' ব্রিগেডিয়ার দুরদানি ব্যাটেলিয়নের অস্ত্রাগারে সব অস্ত্র জমা করে চাবিগুলো নিজের হাতে নিয়ে নেন।' মুহূর্তের মধ্যে এই খবর ব্যাটেলিয়নের বাঙালিদের সেনাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। ব্রিগেডিয়ার দুরদানি চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত ব্যাটেলিয়নের সেনারা তৎক্ষণাৎ 'জয় বাংলা' স্লোগান তুলে অস্ত্রাগারের তালা ভেঙে অস্ত্র তুলে নিয়ে মুহূর্তের মধ্যেই পজিশন নিয়ে নেন।

ইস্ট বেঙ্গলের বিদ্রোহের খবর শুনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সেনারা বাঙালি সেনাদের উপর ত্রিমুখী আক্রমণ চালায়। এসময় বেশ কিছু বাঙালি সেনারা ক্লান্ত অবস্থায় ঘুমিয়ে পড়েছিলেন, তাদেরকে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনী। মধ্য রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর এমন হামলায় ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেফটেন্যান্ট আনোয়ারের নেতৃত্বে বাঙালি সেনারাও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। এসময় লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল জলিল ছিলেন বাঙালি কমান্ডিং অফিসার। তিনি বিদ্রোহী বাঙালি সেনাদের নেতৃত্ব দিতে অস্বীকার করেন এবং অফিসে বসে থাকেন। তখন ক্যাপ্টেন হাফিজউদ্দিন আহম্মেদ ও লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন হামলা প্রতিহত করতে সেনাদের পুনর্গঠিত করেন।

এদিন সকাল ৮টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত পাকিস্তানি ২৫ বেলুচ রেজিমেন্ট ও ২২ ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের সেনারা উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ দিক থেকে বেশ কয়েকবার আক্রমণ চালায় বাঙালি সেনাদের উপরে। পশ্চিম দিক দিয়ে আক্রমণ না করলেও পশ্চিমের খোলা মাঠ দিয়ে অবিরাম বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ চালাচ্ছিল তারা। কিন্তু প্রতিবারই বাঙালি সেনাদের প্রতিরোধের মুখে সম্পূর্ণ দখল নিতে পারছিল না পাকিস্তানি বাহিনী। পাকিস্তানিরা পরিকল্পিত উপায়ে আক্রমণ চালিয়েছিল। কয়েক ঘণ্টা ধরে চলা এই যুদ্ধে বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা শহীদ হন। এক পর্যায়ে গোলাগুলি কমে আসলে ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ বাঙালি সেনাদের গোলাবারুদ তখন ফুরিয়ে আসছিল। তারা ঠিক করেন পশ্চিম দিক দিয়েই কভারিং ফাইটের সাহায্যে ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তারা বের হবেন এবং চৌগাছায় মিলিত হবেন। এরপর মুক্তিযোদ্ধারা ফায়ার অ্যান্ড মুভ পদ্ধতিতে বেরিয়ে যেতে থাকেন। লেফটেন্যান্ট আনোয়ার ও একই পদ্ধতিতে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ পাকিস্তানি বাহিনীর ছোঁড়া মেশিনগানের গুলি এসে লাগে লেফটেন্যান্ট আনোয়ারের কোমরে ও পিঠে। তিনি তখনই লুটিয়ে পড়েন। শহীদ হন লেফটেন্যান্ট আনোয়ার হোসেন বীর উত্তম।

শহীদ লেফটেন্যান্ট মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেনের জন্ম ১৯৪৭ সালের ৫ মে চাঁদপুর জেলার শাহরাস্তি উপজেলার সোনাইমুড়ি গ্রামে। ১৯৬৫ সালে ফৌজদারহাট ক্যাডেট থেকে ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েট পাশ করার পরে সেনা বৃত্তির অধীনে তিনি ভর্তি হন ইস্ট পাকিস্তান ইউনিভার্সিটি অব ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজিতে। (বর্তমানে বুয়েট) সেখানে এক বছর অধ্যয়নের পর মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। পাকিস্তানের কাকুল মিলিটারি একাডেমি থেকে ১৯৭০ সালের ২৯ মার্চ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে কমিশন লাভ করেন তিনি। এরপর তাকে সে বছরের এপ্রিল মাসে পোস্টিং দেওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্টে ১০৭ ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডের অধীনে ১ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে ।

সূত্র:

রক্তেভেজা একাত্তর/ মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র নবম খণ্ড।

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
chief adviser yunus confirms election date

Election in February

Chief Adviser Prof Muhammad Yunus last night announced that the general election will be held before Ramadan in February 2026, kickstarting the process of handing over the power to an elected government.

5h ago