মুক্তিযুদ্ধ

খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা: শহীদ সিপাহী আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম

সিপাহী আনোয়ার হোসেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৪৭।
শহীদ সিপাহী আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম। ছবি: সংগৃহীত

(মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে দ্য ডেইলি স্টারের পক্ষ থেকে খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়ে বিশেষ আয়োজন 'মুক্তিযুদ্ধের খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা'। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সাধারণত আমরা ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠের বীরত্ব সম্পর্কে জানি। কিছুটা আড়ালে ঢাকা পড়ে যান আমাদের বাকি খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধারা। দ্য ডেইলি স্টার উদ্যোগ নিয়েছে সেই জানা ও অজানা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়মিত প্রকাশ করার। ক্রমানুসারে বীর উত্তম খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাঁথা নিয়েই চলছে ধারাবাহিক এই আয়োজন। পর্যায়ক্রমে বীর বিক্রম, বীর প্রতীক মিলিয়ে সর্বমোট ৬৭২ জন মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বগাঁথা প্রকাশ করবে দ্য ডেইলি স্টার। আমাদের আজকের পর্বে রইল শহীদ সিপাহী আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম'র বীরত্বগাঁথা)

সিপাহী আনোয়ার হোসেন লালমনিরহাটের পাটগ্রাম যুদ্ধে শহীদ হন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য বীরত্ব ও আত্মত্যাগের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত করা হয়। বীর উত্তম খেতাবে তার সনদ নম্বর ৪৭।

১৯৭১ সালের শুরুতে আনোয়ার হোসেন দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের রংপুর উইংয়ে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তার পদ ছিল সিপাহী। রংপুরে ছিল ইপিআরের ১০ নম্বর উইং হেডকোয়ার্টার। এই উইংয়ের উইং কমান্ডার ছিলেন অবাঙালি। ২ জন সহকারী উইং কমান্ডারের মধ্যে ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন ছিলেন বাঙালি। এই কোম্পানির অধীনে ছিল ৫টি কোম্পানি ও একটি সাপোর্ট প্লাটুন। কোম্পানিগুলো ছিল চিলমারী,  মোগলহাট, পাটগ্রাম, জয়মনিরহাটে। হেডকোয়ার্টার উইংয়ে ছিল একটি কোম্পানি। 

২৫ মার্চ রাতে দেশের অন্যান্য স্থানের মতো রংপুরেও পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা শুরু করে। রাত ১২টার পর পাকিস্তানি সেনারা রংপুরের বাঙালি ইপিআরের ওপর আক্রমণ চালায়। সারারাত গোলাবর্ষণ চলে। ২৬ মার্চ বিকেলে সহকারী উইং কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উদ্দিন তিস্তা নদী অতিক্রম করে টোগরাইহাট চলে যান।

২৭ মার্চ রাত ৮টার দিকে রংপুর ক্যান্টনমেন্টে থাকা পাকিস্তানি সেনারা বাঙালি ইপিআর সেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় সুবেদার ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে  সিপাহী আনোয়ার হোসেনসহ বাঙালি ইপিআর সদস্যরা গুলি ছুড়তে ছুড়তে ব্যারাক থেকে বের হয়ে ৫ মাইল দূরের একটি গ্রামে অবস্থান নেন।

২৮ মার্চ কালীগঞ্জ থানার এমসিএ করিমউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন সুবেদার ফজলুর রহমান। করিমউদ্দিনের সঙ্গে ৩০ জন ছাত্র যোগ দেন। এরপর আরও ৩০০ আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র-জনতা একটি বাহিনী গঠন করে। এ সময় থানা থেকেও ১৫০টি রাইফেলও সংগ্রহ করা হয়।

২৮ মার্চ ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ বাঙালি কোম্পানি কমান্ডার, মহকুমা প্রশাসক, রাজনৈতিক নেতাসহ সুবেদার ও হাবিলদারদের নিয়ে টোগরাইহাটে এক সভা করেন। এই সভায় সিপাহী আনোয়ার হোসেনও ছিলেন। সভায় বিভিন্ন কোম্পানিতে থাকা অবাঙালি ইপিআর সদস্যদের বন্দী করে বাঙালি ইপিআর সদস্যদের রংপুরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।   

২৮ মার্চ ইপিআর ক্যাম্পে ১০০ বাঙালি ইপিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফলে ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি সেনারা এ হামলায় পূর্বপরিকল্পনা মতো যোগ দিতে ব্যর্থ হয়। রংপুর উইং হেডকোয়ার্টার থেকে যেসব বাঙালি ইপিআর সদস্য পালাতে ব্যর্থ হন, তারা হয় পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দী হন, না হয় নৃশংস হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। এরপর ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ তার হেডকোয়ার্টার করেন কুড়িগ্রামে। সিপাহী আনোয়ার হোসেনকে পাটগ্রাম সাব সেক্টরে নিযুক্ত করা হয়।

এপ্রিলের মধ্যভাগ থেকে লালমনিরহাট এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান জোরদার হতে থাকে। পাকিস্তানি বাহিনী একের পর এক মুক্তিবাহিনীর অবস্থান দখল করতে থাকে। এপ্রিলের প্রথম দিকে কুলাঘাটে মুক্তিবাহিনীর শক্ত অবস্থান থাকলেও, ক্রমেই এই এলাকার বিভিন্ন জায়গা পাকিস্তানি বাহিনীর দখলে চলে যায়। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা বিক্ষিপ্তভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালাতে থাকে। ২৬ এপ্রিল সিপাহী আনোয়ার হোসেনসহ ইপিআরের সেনারা কুলাঘাটে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর গেরিলা আক্রমণ চালালে ২ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

মোগলহাট ছিল লালমনিরহাট মহকুমার সদর থানার গুরুত্বপূর্ণ ইউনিয়ন। ভারতীয় সীমান্তবর্তী এই এলাকাটির পাশেই ছিল ধরলা নদী। মোগলহাটে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান। এই অবস্থান থেকে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিতই অপারেশন চালাচ্ছিল। জুন মাসের শেষে এবং জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে পাকিস্তানিদের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণের গতি জোরদার করেন।

চিলমারী, উলিপুর, মোগলহাট, পাটগ্রাম, বুড়িমারীসহ উত্তরাঞ্চলের রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ অব্যাহত রাখেন।

২ জুলাই রাতে সিপাহী আনোয়ার হোসেনসহ মুক্তিযোদ্ধারা গিতালদহ ঘাঁটি থেকে ধরলা নদী পার হয়ে মোগলহাটের পাশে ঘন জঙ্গলে অবস্থান নেন এবং পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর হামলার জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতেন। ৩ জুলাই  ভোরে পাকিস্তানি বাহিনী এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় অ্যামবুশের আওতায় এলে মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ৭-৮ জন সেনা নিহত হয়।  

৪ জুলাই দুপুরে গীতালদহ থেকে ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা ধরলা নদী অতিক্রম করে বিকেল ৫টার দিকে ৩ দিক থেকে মোগলহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ করেন। অতর্কিত এই আক্রমণে পাকিস্তানি বাহিনী মোগলহাট ছেড়ে পালিয়ে যায়। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর ১০-১২ জন সেনা নিহত হয়।  

মুক্তিবাহিনী এ সময় মোগলহাটে ঢুকে পাকিস্তানি বাহিনীর অবশিষ্ট সেনাদের খুঁজতে থাকে। তখন পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে এ সময় ২ মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রশিদ ও আবু বকর শহীদ হন এবং মাইনের আঘাতে মুক্তিযোদ্ধা শামসুল কিবরিয়া গুরুতর আহত হন। এরই মধ্যে মুক্তিবাহিনী পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। এক পর্যায়ে পাকিস্তানি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়।  

পাটগ্রাম সাব সেক্টরের বুড়িমারীতে মুক্তিবাহিনীর একটি প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল।  বুড়িমারীতে আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে একদল মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্ত এলাকা বলে পাকিস্তানি বাহিনী নিয়মিতই বুড়িমারীতে মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থানের ওপর আক্রমণ চালাচ্ছিল।

১০ জুলাই পাটগ্রাম দখলের জন্য পাকিস্তানি বাহিনী হাতিবান্ধা থেকে গিয়ে বুড়িমারীতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ চালায়। প্রথমে ইপিআরের সেনা মোহন মিয়া ও  বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ তীব্র আকার ধারণ করলে আনোয়ার হোসেন এলএমজি নিয়ে ক্রলিং করে একাই পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানের কাছে গিয়ে মুখোমুখি ব্রাশফায়ার করতে থাকেন। এতে ১৫-২০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়।

আনোয়ার হোসেন জীবনের মায়া ছেড়ে আরও আক্রমণের জন্য ব্রাশফায়ার করতে করতে সামনে এগিয়ে যেতে থাকেন। এ সময় পাকিস্তানি বাহিনীর এক ঝাঁক গুলি এসে লাগে তার শরীরে। সেখানেই শহীদ হন সিপাহী আনোয়ার হোসেন, বীর উত্তম।

এরপর মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বিত আক্রমণের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী ফের হাতিবান্ধার দিকে পালিয়ে যায়। পরে শহীদ সিপাহী আনোয়ার হোসেনকে পাটগ্রামের বাউরাবাজারের পাশে জম গ্রামের মসজিদের পাশে দাফন করা হয়।

শহীদ আনোয়ার হোসেনের জন্ম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার গোপিনাথপুর গ্রামে। ১৯৬৫ সালে তিনি ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসে যোগ দেন। ১৯৬৮ সালে তাকে দিনাজপুর ইপিআর সেক্টরের রংপুর উইংয়ে বদলি করা হয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ৬

১৯৭১ উত্তর রণাঙ্গনে বিজয়/ আখতারুজ্জামান মণ্ডল

 

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments