চিরকালের যোদ্ধা জিয়াউদ্দিন তারিক আলী

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী (১৯৪৫-২০২০) ছবি: ইরেশ জাকের

যখন জাতীয় সংগীত গাইতেন তখন তার চোখ জলে ভরে উঠত। অনেকটা নীরব অশ্রুপাতের মতো। কেন তার চোখ বেয়ে জল গড়াত অনেকেরই সেই কৌতূহল ছিল। একবার অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, 'কেন আপনি পুরো জাতীয় সংগীতটা গাইতে পারেন না?' জবাবে বলেছিলেন 'জাতীয় সংগীত গাওয়ার সময় আমার চোখের সামনে ভেসে উঠে লাখো মানুষের মৃত্যু, সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর জীবন দেওয়া, আরও কত মানুষের ত্যাগের সেই চিত্র।'

চোখের সমস্যার কারণে যেতে পারেননি মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনে। ভারী চশমা বাধা হয়ে দাঁড়াতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি অপ্রতিরোধ্য। যার দৃশ্য আমরা দেখতে পাই তারেক মাসুদের নির্মিত প্রামাণ্য চিত্র মুক্তির গান-এ। ছিপছিপে একটা ছেলে, চোখে ভারী চশমা। দেশের জন্য তার কী আবেগ, কী ভালোবাসা! তিনি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে চান কিন্তু চোখে ভারী চশমা তাই তাকে সুযোগ দেওয়া হয় না। তিনি তাই তার দলের সবাইকে নিয়ে গান গেয়ে গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করে যাচ্ছেন।

মার্কিন চলচ্চিত্র নির্মাতা লিয়ার লেভিন মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশ মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার দলের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সংগ্রহ করেছিলেন ২০ ঘণ্টার ফুটেজ। দীর্ঘ দুই দশক তা ছিল বাক্সবন্দী। পরবর্তীতে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের প্রচেষ্টায় তা দর্শকদের কাছে আসে।

জিয়াউদ্দিন তারিক আলীকে নিয়ে ড. জাফর ইকবাল লিখেছিলেন, 'আমি এখনও স্পষ্ট শুনতে পাই তারিক আলী "তোরা ঢাকার শহর রক্তে ভাসাইলি" গানটি শেখানোর সময়, "ও বাঙালি ও..." বলে একটা টান দিচ্ছেন, একটি গান যে কত দরদ দিয়ে গাওয়া যায় সেটি আমি তাকে দেখে জেনেছিলাম। তিনি যে "বাঙালি" বলার সময় পুরো দরদ ঢেলে দিতেন তার কারণ তিনি যে শুধু গানের লিরিকটি বলছেন তা নয়। তারিক আলী তার বিশ্বাসের কথা বলছেন, তার স্বপ্নের কথা বলছেন, তার ভালোবাসার কথা বলছেন। তিনি ছিলেন পুরোপুরি বাঙালি, তার চাইতে বেশি বাঙালি হওয়া সম্ভব কি না আমি জানি না।' 

আশির দশকে জিয়াউদ্দিন তারিক আলী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। সে সময় পেশাগত জীবনে তিনি যেমন সফল ছিলেন তেমনি পেশা জীবনের বাইরে তার সমস্ত ধ্যানজ্ঞান জুড়ে ছিল এই দেশ। নব্বইয়ের দশকে তিনি চলে দেশে চলে আসেন। ১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ সেগুনবাগিচায় একটি সাবেকী ভবন ভাড়া নিয়ে শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের। আট জন ট্রাস্টির মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। সেই ছোট্ট বাড়ি থেকে আজকের আগারগাঁওয়ের দুই বিঘা আয়তনের সুবিশাল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থাপনা। এর সব কিছুতেই জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর স্পর্শ আছে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের পেছনে ছিল একজন জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর স্বপ্ন, চিন্তা, একাগ্রতা আর অনন্য নিষ্ঠা। তার সম্পূর্ণ প্রকৌশলী মনন মেধা আর চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। শেরে বাংলা নগরে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থায়ী ঠিকানা নির্মাণে তিনি ছিলেন প্রধান সমন্বয়ক। 

জিয়াউদ্দিন তারিক আলী ছিলেন ভীষণ রবীন্দ্র অনুরাগী। রবীন্দ্র সংগীতকে তিনি আত্মায় ধারণ করতেন। রবীন্দ্র দর্শনকেই জীবনের পাথেয় করে নিয়েছিলেন। জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের তিনি ছিলেন অন্যতম উদ্যোক্তা। ছিলেন ছায়ানটের নির্বাহী সদস্যও। তারুণ্যের প্রথমভাগে তিনি গান শিখেছিলেন বুলবুল ললিত কলা একাডেমিতে। তিনি যে কতটা অসাম্প্রদায়িক ও মানবদরদী ছিলেন তা লিখে শেষ করা সহজ নয়। শারদীয় দুর্গোৎসব তো বটেই বনানী পূজা মণ্ডপের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। 

২০০১ সালে যখন রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা হলো তখনই রুখে দাঁড়ায় সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন। এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন অজয় রায়। তার মৃত্যুর পর সভাপতি ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। 

গণ মানুষের অধিকারে আর দেশের সমস্ত গণ আন্দোলনে জিয়াউদ্দিন তারিক আলী ছিলেন অগ্রভাগে। কখনো প্রত্যক্ষভাবে কখনোবা পরোক্ষভাবে। মুক্তিযুদ্ধ হোক বা সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী আন্দোলন—ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর অধিকার, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অধিকারে তিনি ছিলেন আজীবন সোচ্চার।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর ধর্মীয় সংখালঘুদের উপর অত্যাচার ও নিপীড়নের প্রতিবাদে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের নেতৃত্বে সৃষ্টি হলো 'বাংলাদেশ রুখে দাঁড়াও' নামের সংগঠনের। এই সংগঠন সৃষ্টি তো বটেই আহ্বায়ক ছিলেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী। তিনি পাশে দাঁড়িয়েছিলেন হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে। রামু, সাতকানিয়া ঘুরে তিনি সাহস জুগিয়েছিলেন অসহায় মানুষকে।

তার পুরোটা জীবন ছিল দেশের তরে নিবেদিত। চেয়েছিলেন মরণোত্তর দেহদান করতে। কিন্তু করোনা আক্রান্ত হয়ে তার প্রয়াণ হওয়ায় এই ইচ্ছেটি পূরণ হয়নি। কিন্তু যে স্বপ্নের বুনন আর ইচ্ছের প্রতিফলন আজীবন করেছেন জিয়াউদ্দিন তারিক আলী বাংলাদেশ তা ভুলবে না। তার স্মরণিকা হিসেবে তো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আছেই। যে স্বপ্নের সূচনা হয়েছিল শরণার্থী শিবির থেকে রণাঙ্গনে অনুপ্রেরণা আর মুক্তির গানে। 

জন্মদিনে জিয়াউদ্দিন তারিক আলীর প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Rickshaw-puller picked up from Dhanmondi 32 gets bail

There is no legal bar for him to walk out of jail, his lawyer Advocate Farzana Yasmin Rakhi told The Daily Star

53m ago