ইতিহাস
মুক্তিযুদ্ধ

বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে যে শিল্পীর হাতে একাত্তরে উঠেছিল অস্ত্রও

সংগীত ছিল তার কাছে নেশার মতো। সেতার থেকে গিটার, তবলা থেকে বেহালা, বাঁশি থেকে মাউথ অর্গান যন্ত্র সংগীতে তার ছিল অসাধারণ দখল। আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে কাজ করতেন তিনি। তিনি ছিলেন সুরকার আলতাফ মাহমুদের সার্বক্ষণিক সহচর। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন।
বাদ্যযন্ত্র ছিল সৈয়দ হাফিজুর রহমানের নিত্যসঙ্গী। ছবি: সংগৃহীত

সংগীত ছিল তার কাছে নেশার মতো। সেতার থেকে গিটার, তবলা থেকে বেহালা, বাঁশি থেকে মাউথ অর্গান যন্ত্র সংগীতে তার ছিল অসাধারণ দখল। আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে কাজ করতেন তিনি। তিনি ছিলেন সুরকার আলতাফ মাহমুদের সার্বক্ষণিক সহচর। কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি ছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের দুর্ধর্ষ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা। বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন। নিখুঁতভাবে মাইনের ফাঁদ পাততে পারতেন। তিনি সৈয়দ হাফিজুর রহমান। যার হাত দিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছিল। এর মধ্যে ঢাকার আসাদ গেটে হানাদারদের সামরিক কনভয়ে মাইন পাতা, সাইন্স ল্যাবরেটরি, গ্রিন রোড পেট্রোল পাম্প, দোয়েল চত্বরের কাছে মাইন বিস্ফোরণসহ এমন অসংখ্য দুঃসাহসিক অপারেশন। এমনও রাত গেছে যে রাতে তিনি ঢাকায় ৬টি জায়গায় মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন।

ভাইদের সঙ্গে সৈয়দ হাফিজুর রহমান। ছবি: সংগৃহীত

সৈয়দ হাফিজুর রহমানের জন্ম নানার বাড়ি খুলনার মুন্সিপাড়ায় ১৯৩৮ সালের ২৮ নভেম্বর। অবশ্য তার বেড়ে ওঠা যশোর শহরের পোস্ট অফিস পাড়ায় তাদের বাড়িতে। যশোর জেলা স্কুলে ম্যাট্রিক এবং এম এম কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েটেই তার পড়াশোনার ইতি। এরপর খুলনায় নানার বাড়ির কাছে গড়ে তুলেছিলেন ললিতকলা নামের একটি গানের স্কুল। স্কুলে পড়া অবস্থাতেই সংগীতে হাতেখড়ি হয়েছিল সৈয়দ হাফিজুর রহমানের। কলেজে থাকাকালীন সময়ে নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গাইতেন হাফিজুর রহমান। একসময় চলে গেলেন করাচি। সেখানে গিয়ে পেয়েছিলেন প্রখ্যাত সংগীত পরিচালক ও গীতিকার দেবু ভট্টাচার্যের সাহচার্য। দেবু ভট্টাচার্য ভীষণ স্নেহ করতেন হাফিজকে। করাচিতেই আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল হাফিজুর রহমানের। এরপর আলতাফ মাহমুদ তাকে নানা সময় সহযোগিতা করতেন। কিন্তু করাচি ভালো লাগেনি হাফিজুর রহমানের কারণ সেখানে তাকে পদে পদে বিপত্তিতে পড়তে হয়েছিল। আর বাঙালিদের তখন সেখানে সবাই তাচ্ছিল্যের চোখে দেখতো। ১৯৬৫ সালে আলতাফ মাহমুদ দেশে ফিরে এলেন। এর কিছুদিন পর হাফিজুর রহমানও চলে এসেছিলেন আলতাফ মাহমুদের অনুরোধেই। একসময় তারা গড়ে তুললেন ঊর্মি প্রোডাকশন নামে একটি সংগীত প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান। আলতাফ মাহমুদ আর হাফিজুর রহমান হয়ে উঠলেন হরিহর আত্মা।

২৫ মার্চের কালরাত্রির সময়ে হাফিজুর রহমান ছিলেন তাদের নিউ ইস্কাটনের বাসায়। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে তার বাবা সৈয়দ আব্দুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। একই সঙ্গে তাদের যশোরের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছিল। হানাদারদের উপর প্রতিশোধের নেশায় জ্বলতে লাগলো হাফিজুর রহমানের মন। দেশজুড়ে হানাদার বাহিনীর চরম পাশবিকতার সীমাও ছাড়িয়ে গেছে ততদিনে। বিশেষ করে বাবার এমন করুণ মৃত্যুই হাফিজুর রহমানের গোটা জগতকে ওলটপালট করে দিয়েছিল। এরপর হাফিজুর রহমান পণ করেছিলেন তিনি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। আলতাফ মাহমুদের কাছে গিয়ে তিনি তার ইচ্ছের কথা খুলে বললেন। এরপর থেকে সৈয়দ হাফিজুর রহমান আলতাফ মাহমুদের সঙ্গে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য সংগীত আয়োজন করতেন। আলতাফ মাহমুদ সুর দিতেন, তিনি বাদ্যযন্ত্র বাজাতেন। যে গানগুলো স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে প্রচারিত হতো মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করতে। গান রেকর্ড শেষে পাঠানো হতো সীমান্তের বাইরে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সেই গান বেজে উঠতো। একই সঙ্গে আজ এখানে তো কাল ওখানে। তাকে তথ্য সরবরাহ ও টাকা পয়সা সংগ্রহের পর দূতদের কাছে টাকা নিয়ে যেতে হতো। অন্যদিকে আলতাফ মাহমুদের বাসা ছিল ক্র্যাক প্লাটুনের গেরিলাদের অস্ত্র ও রসদ রাখার নিরাপদ আশ্রয়স্থল। এই বাড়িতে গান হতো, আলতাফ মাহমুদ সারাক্ষণ গান নিয়ে ব্যস্ত। মুক্তিযুদ্ধের আগে যেমন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি হয়ে গেলেন আলতাফ মাহমুদের সার্বক্ষণিক সহচর। থাকতেন অবশ্য তাদের ২০ ইস্কাটনের ভাড়া বাড়িতে।

কেবল সংগীতই নয়। গোলাবারুদ হাতে তুলে নিয়েছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান। ক্র্যাক প্লাটুনের বেশ কয়েকটি অপারেশনে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন সৈয়দ হাফিজুর রহমান সেটি আগেই বলেছি। হাফিজুর রহমানের হাত দিয়ে ঢাকায় বেশ কয়েকটি মাইন বিস্ফোরণের ঘটনা হয়েছিল। বিশেষ করে গ্রিন রোড, সায়েন্স ল্যাবরেটরিসহ বেশ কয়েকটি জায়গায়। এসব মাইন বিস্ফোরণে তিনি দেখিয়েছিলেন তার দক্ষতা।

আগস্ট মাসে আসাদ গেটের কাছে মাইন বিস্ফোরণের একটি অপারেশনে হাফিজ ছিলেন বড় সঙ্গী। হাফিজের পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল হানাদার বাহিনীর একটি কনভয়। কিংবা দোয়েল চত্বরের কাছে পেতে রাখা মাইন বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একটি ডাবল ডেকার বাস।

রামপুরার উলন পাওয়ার স্টেশনে উড়িয়ে দেয়ার ঘটনায়ও অনন্য সঙ্গী ছিলেন হাফিজুর রহমান। যে অপারেশনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন গাজী গোলাম দস্তগীর। ওই অপারশনেও তিনি সফলভাবে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিলেন ৩০/৪০/৫০ এমভিএ ক্ষমতাসম্পন্ন ট্রান্সফারমারের। যে বিস্ফোরণে গোটা ঢাকার পূর্বাঞ্চল কেঁপে উঠেছিল।

২৯ আগস্ট দিন থেকে ৩০ আগস্ট ভোর পর্যন্ত ঢাকার বহু বাড়িতে গেরিলাদের ধরতে অপারেশন চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ৩০ আগস্ট ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাজাকারদের সহযোগিতায় ২০ নিউ ইস্কাটনের বাড়ি থেকে হাফিজুর রহমানকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায়। এরপর তাদের নিয়ে যাওয়া হয় তেজগাঁও নাখালপাড়ায় ড্রাম ফ্যাক্টরি সংলগ্ন মিলিটারি টর্চার সেলে। সেখানে তাদের উপর চালানো হয় পাশবিক অত্যাচার। বাদ যাননি হাফিজও। তার উপর চালানো হয়েছিল পৈশাচিক নির্যাতন। কিন্তু তিনি হাজার নির্যাতন মুখ বুজে সহ্য করেছিলেন। একটাবারের জন্যও প্রকাশ করেননি সহযোদ্ধাদের নাম।

৩০ আগস্ট পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে ধরা পড়েছিলেন ক্র্যাক প্লাটুনের মুক্তিযোদ্ধা লিনু বিল্লাহও। তিনি ডেইলি স্টারকে দেয়া ক্র্যাকপ্লাটুন নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন গেরিলা সৈয়দ হাফিজুর রহমানের কথা। তিনি বললেন 'একজনের কথা আমাকে বলতেই হবে। হাফিজ ভাই। তার কথা কেউই তেমন বলেন না। এটি ভীষণ দুর্ভাগ্যের। হাফিজ ভাই ছিলেন আলতাফ ভাইয়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট। আলতাফ ভাই যেখানে হাফিজ ভাইও সেখানে। সেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ সব জায়গায়। হাফিজ ভাই বেশ কয়েকটি অপারেশনও করেছিলেন। হাফিজ ভাই ধরা পড়েছিলেন ইস্কাটনের বাড়ি থেকে। আলতাফ ভাইয়ের বাসায় যাওয়া মানে অবশ্যই হাফিজ ভাইয়ের দেখা পাওয়া।

দেখা যেত আলতাফ ভাই সুর তুলছেন আর হাফিজ ভাইয়ের হাতে বাদ্যযন্ত্র। দারুণ প্রতিভাবান যন্ত্রসঙ্গীত শিল্পী ছিলেন তিনি। তার সাথে আমার শেষ দেখা টর্চার সেলেই। একটু আগে পাশের একটা রুমে কেউ নির্যাতনে অতিষ্ঠ হয়ে চিৎকার দিয়ে বলছিল, 'আমাকে গুলি করো, আমি বেঁচে যাই।' তিনি টর্চার সহ্য করতে পারছিলেন না। আসলে সহ্য করার মতোও না। দরজাটা ফাঁক করে দেখে আঁতকে উঠলাম। হাফিজ ভাইয়ের দুই চোখ উপড়ে পড়ছে। পুরো শরীরে আঘাতের চিহ্ন। আমি দেখেই পাশের সবাইকে বললাম এটা হাফিজ ভাই। হাফিজ ভাই সব অস্বীকার করে গেলেন। একবারের জন্যও সহযোদ্ধাদের নাম প্রকাশ করেননি।'

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছরে এসেও ক্র্যাক প্লাটুনের নিখোঁজ গেরিলাদের মধ্যে একমাত্র হাফিজুর রহমানেরই ঠাঁই হয়নি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায়। মিলেনি ন্যূনতম স্বীকৃতিটুকুও। কেন স্বীকৃতি পাননি তিনি সেই প্রশ্নেরও জবাব নেই কারো। তারা ইস্কাটনের যে বাড়িতে থাকতেন তাও বিক্রি হয়ে গেছে বহু আগে। পাওয়া যায় না তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন।

ক্র্যাক প্লাটুনের দুঃসাহসিক গেরিলা শহীদ সৈয়দ হাফিজুর রহমানকে বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

তথ্য সূত্র-

ব্রেভ অব হার্ট/ হাবিবুল আলম, বীর প্রতীক

শহীদ আলতাফ মাহমুদ ডট কম

Comments

The Daily Star  | English

Upazila Polls: AL, BNP struggle to keep a grip on grassroots

The upazila election has exposed how neither of the two major parties, the Awami League and BNP, has full control over the grassroots leaders.

7h ago