ইতিহাস

মোনাজাতউদ্দিন: সংবাদের পেছনে ছুটে বেড়ানো এক মহাপ্রাণ

গাইবান্ধায় এক গ্রামে আমাশয় ছড়িয়ে পড়েছে, ডাক্তারের আগে দৌড়াচ্ছেন তিনি সংবাদের খোঁজে। বাঁধ ভেঙেছে, নদী ভাঙনে গ্রাম বিলীন হচ্ছে, খেতে ফসল নেই, সর্বত্র অভাব—মানুষ তাকে খুঁজছে, তিনি মানুষ খুঁজেছেন। সংবাদের নেশায় মরিয়া এক সংবাদকর্মী ছুটছেন সবার আগে। বৃষ্টি, ঝড় ঝাপটা, খরা, মঙ্গা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই আটকাতে পারে না তাকে। প্রান্তিক মানুষের চিত্র যে জাতীয় সংবাদ হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যেত একজনের তৈরি করা মর্মভেদী প্রতিবেদনে।
মোনাজাতউদ্দিন

গাইবান্ধায় এক গ্রামে আমাশয় ছড়িয়ে পড়েছে, ডাক্তারের আগে দৌড়াচ্ছেন তিনি সংবাদের খোঁজে। বাঁধ ভেঙেছে, নদী ভাঙনে গ্রাম বিলীন হচ্ছে, খেতে ফসল নেই, সর্বত্র অভাব—মানুষ তাকে খুঁজছে, তিনি মানুষ খুঁজেছেন। সংবাদের নেশায় মরিয়া এক সংবাদকর্মী ছুটছেন সবার আগে। বৃষ্টি, ঝড় ঝাপটা, খরা, মঙ্গা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিছুই আটকাতে পারে না তাকে। প্রান্তিক মানুষের চিত্র যে জাতীয় সংবাদ হয়ে উঠতে পারে তার প্রমাণ পাওয়া যেত একজনের তৈরি করা মর্মভেদী প্রতিবেদনে।

রংপুরে কোনো গ্রামে গ্রামে ডায়রিয়া—মোনাজাতউদ্দিন ঘটনাস্থলে যাচ্ছেন—দুদিন পরে পত্রিকার প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে অসহায় মানুষের সেই দুর্দশার চিত্র। অতঃপর সমাধান। তিনি নিবিষ্ট মনে জীবনকে এঁকেছেন সংবাদপত্রের পাতায়। একটি প্রতিবেদনেই শেষ নয়! বরং সংবাদের পিঠে সংবাদ। কখনো সরেজমিন প্রতিবেদন, কখনো ধারাবাহিক প্রতিবেদন—নানা নামে নানা ছন্দে সমস্তই সংবাদ উপস্থাপন।

 খবরকে সকল পর্যায়ের পাঠকের জন্য বোধগম্য করে তোলার নিপুণ কৌশলটি জানতেন মোনাজাতউদ্দিন। যিনি চোখ দিয়ে কেবল দেখতেন না, অনুধাবন করতেন মন দিয়ে। যার ফলে সংবাদ হয়ে উঠত একান্তই আমাদের নিজস্ব। যে উত্তরের জনপদের খবর আমাদের শহুরে মানুষের কানে বেশ একটা পৌঁছায় না, সেই উত্তরবঙ্গের খরা, মঙ্গাপীড়িত মানুষের হাহাকার মোনাজাতউদ্দিন শহুরে মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন তার মর্মভেদী আহ্বান।

আজকের দিনে এসে মোনাজাতউদ্দিনের উত্তরবঙ্গকে হয়তো চেনা যাবে না। সময়ের ব্যবধানে আজ উত্তরবঙ্গ আধুনিক, প্রশস্ত সড়ক, দুধারে ফসলের খেত, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ, আধুনিকতার জয়ধ্বনি। মঙ্গাপীড়িত উত্তরবঙ্গের জমি আজ তিন ফসলি খেত, বাড়ির আঙ্গিনায় সবজি বাগান, পুকুরে মাছ, গোয়ালে গাভী।

সংবাদ আর সাংবাদিকতাই ছিল মোনাজাতউদ্দিনের ধ্যান

কিন্তু মোনাজাতউদ্দিনের উত্তরবঙ্গ আজকের মতো ছিল না। সেই উত্তরবঙ্গ ছিল রুক্ষ, সেই জনপদে চতুর্দিকে কেবলই হাহাকার। আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা দেখা দিতো। বেশির ভাগ মানুষের ঘরে খাবার থাকত না। আমন ধান ঘরে তোলার আগ পর্যন্ত খাবার জুটত না। নদী ভাঙনে বিপর্যস্ত চারদিক। সেই উত্তরবঙ্গকে দৈনিক সংবাদের পাতায় গভীর মমতায় তুলে ধরতেন মোনাজাত উদ্দিন, গ্রামই ছিল যার কর্মক্ষেত্র। গ্রামের মানুষেরাই ছিল তার সংবাদের মানুষ। মোনাজাতউদ্দিনের প্রতিবেদন মানেই সংবাদ পত্রিকার চুম্বকের আকর্ষণ। মোনাজাত উদ্দিনের উত্তরবঙ্গের সঙ্গে আজকের উত্তরবঙ্গের তফাৎ সুস্পষ্ট হয় মোনাজাত উদ্দিনের প্রতিবেদনের সঙ্গে ২৩ বছর পরের এক প্রতিবেদনে।

১৯৯২ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে মোনাজাত উদ্দিন রংপুরের এক অসহায় পরিবারের বাল্যবিয়ের চিত্র তুলে ধরে লিখেছিলেন, 'কথাবার্তায় বোঝা গেল: এই বাল্যবিবাহের বিষয়টি তাদের কাছে অস্বাভাবিক কোনো কিছু নয়। অল্প বয়সে ছেলেমেয়ে বিয়ে দেওয়া যে আইনসিদ্ধ নয়, এই খবরটুকুও জানে না তারা, কেউ বলেনি। আছিরন জানায়, তার দুটি মেয়ে। এরপর ছেলে নেওয়ার আশা ছিল। কিন্তু হলো না। একদিন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের এক লোক এসে ফুসলিয়ে নিয়ে গেল তাকে, নগদ টাকা আর শাড়ির লোভ দেখিয়ে "অপারেশন" করল। এখন আর কী করা যাবে! ছেলের আশা বাদ দিতে হয়েছে। জামাই ঘরে এনে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হচ্ছে।'

মোনাজাতউদ্দিনের সেই মর্মস্পর্শী প্রতিবেদন চোখে পড়েছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের। গ্রামের মানুষদের সচেতন করতে ঢাকা থেকে মালেকা বেগমসহ মহিলা পরিষদের কেন্দ্রীয় নেতারা ছুটে গিয়েছিলেন।

সেই আছিরনের ২৩ বছর পরের চিত্র ফুটে উঠে রংপুরের প্রথম আলো প্রতিনিধি আরিফুল হকের করা ২০১৫ সালের একটি প্রতিবেদনে। 'সেই আছিরন এই আছিরন' শিরোনামের প্রতিবেদনে সাংবাদিক আরিফুল হক লিখেছিলেন, 'মোনাজাত উদ্দিন লিখেছেন আছিরনের দৈন্য নিয়ে। আমি লিখব আছিরনের 'বৈভব' নিয়ে। মাঝখানের ২৩ বছরের জীবন আছিরনের নিজের হাতে গড়া।' '….রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বিখ্যাত পায়রাবন্দ ইউনিয়নের জয়রামপুর গ্রামের আছিরন নেছা (৪২) দুই মেয়েকে নিয়েই পাটজাত পণ্য তৈরি করেন। তিনি গ্রামের মহিলাদেরও প্রশিক্ষণ দেন। পায়রাবন্দসহ সাতটি গ্রামের ৬০০ মহিলাকে হস্তশিল্পের প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মমুখী করেছেন তিনি। নিজে হয়েছেন স্বাবলম্বী। এখন বাড়িতে দুটি ঘর, চারটি তাঁত আছে তার। আছে পাটপণ্যের একটি শোরুম। পুকুরে মাছ চাষ করছেন। আট শতক জমি কিনে ছোট মেয়েকে বাড়ি করে দিয়েছেন।'

আজকের দিনে যখন সাংবাদিকতা মানেই শহর কেন্দ্রিক, সাংবাদিকতা বললেই বিনোদন, চলচ্চিত্র, ক্রীড়া অবধারিতভাবে চলে আসে। আজকের দিনে সাংবাদিকতা মানেই চলতি সংবাদ, দিনের খবর পরদিন প্রকাশিত, অনলাইনে তা আরও দ্রুত। যখনকার খবর তৎক্ষণাৎই প্রকাশ। সাংবাদিকতার অনুসন্ধানী চোখ আজ প্রায় বিলুপ্ত। তখন মোনাজাতউদ্দিনের তৈরি করা সংবাদগুলো আমাদের চোখ খুলে দেয়। তিনি যেন আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন সংবাদ কতটা জীবন ঘনিষ্ঠ হতে পারে। একজন সাংবাদিক তার পেশার মধ্য দিয়ে কত অবদান রাখতে পারেন সমাজে। মোনাজাতউদ্দিনের ভোর, সকাল, দুপুর, বিকেল, সন্ধ্যা, মধ্যরাত বলে কিছুই ছিল না। তিনি যেন নিজেই এক আদ্যোপান্ত সংবাদ। সংবাদকর্মী হিসেবে সাংবাদিকতা ছিল তাঁর পেশা। কিন্তু সাংবাদিকতা শুধু তার পেশা ছিল না, ছিল নেশা।

আজকের দিনে একটি প্রচলিত ধারণা এই যে, ভালো সাংবাদিক হতে গেলেই রাজধানী কেন্দ্রিক হতে হবে, বাস করতে হবে শহরের কাছে, সেখানে মোনাজাত উদ্দিন ছিলেন ব্যতিক্রম। তিনি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করে গেছেন রংপুরের প্রত্যন্ত জনপদে থেকে। সংকট আর সমস্যার অন্তরালে তিনি খুঁজেছেন নাড়িনক্ষত্র। পাদপ্রদীপের আলোয় নিজে কখনো আসতে চাইতেন না, অথচ তার প্রতিবেদন ছিল বহু সমস্যার চিত্র আর সমাধান। তার প্রতিবেদন মানেই দৈনিক সংবাদ পত্রিকার মূল আকর্ষণ।

নিজের রংপুরের কেরানীপাড়ার বাড়িতে এমনও হয়েছে মাসে সপ্তাহখানেকও তিনি থাকতে পারেননি। ছুটেছেন জেলা থেকে জেলায় সংবাদের খোঁজে। দিনের পর দিন শুনেছেন মানুষের দুর্দশার চিত্র। হাতের কাগজের প্যাড ভরে উঠত প্রতিবেদনের বিষয়বস্তুতে। বাড়ি ফিরে তো বটেই ঘটনাস্থল থেকেই তিনি প্রতিবেদন পাঠাতেন ঢাকায় কার্যালয়ে।

তার অজস্র প্রতিবেদনের ভিড়ে একটি প্রতিবেদনে চোখ বুলালেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় তার লেখা 'সরেজমিন প্রতিবেদন-নাচোল' শিরোনামের প্রতিবেদনে তিনি লিখছেন, 'জমি জালিয়াতির ঘটনা চলছে নাচোলে। ধনী ও প্রভাবশালীরা বিভিন্ন পন্থায় বাগিয়ে নিচ্ছে সরকারি খাসজমি ও পুকুর। বেহাত হয়ে যাচ্ছে ঘোষিত 'শত্রুতা সম্পত্তি'। এ অভিযোগ করেছেন রাজনৈতিক নেতা, কর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষক; এমনকি অভিযোগ করা হয়েছে উপজেলা প্রশাসন থেকেও। তাদের অভিযোগের সুর শুনে মনে হয়েছে, ব্যাপারটা তাদের চোখের সামনে ঘটছে, অথচ তারা সবাই বড় অসহায়। উপজেলা চেয়ারম্যান সাহেবের ফাইলে জমা হয়ে আছে এ সংক্রান্ত শতাধিক অভিযোগপত্র, সাধারণ দরখাস্ত, কিন্তু এর একটিরও কোন ব্যবস্থা তিনি আজ পর্যন্ত নিতে পারেননি। ফাইলবন্দি হয়ে আছে বহু কৃষকের ফরিয়াদ।'

সংবাদ পত্রিকায় এই যে কৃষকের ফরিয়াদ এটি কেবল কৃষকের ফরিয়াদ নয়, বরং মোনাজাতউদ্দিনের ফরিয়াদও। মোনাজাত উদ্দিন এখানে প্রতিনিধি। কৃষকের ফরিয়াদকে নিজ ফরিয়াদে রূপান্তর একমাত্র মোনাজাতউদ্দিনই পারেন। একজন সাংবাদিক যে সমাজের সকল স্তরের প্রতিনিধি তা আমাদের যেন মোনাজাতউদ্দিন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন। কারণ কৃষকের তো ক্ষমতা নেই উচ্চপদে কি সমস্যার কথা খুলে বলার। সে সমস্যার কথা সরকার বা রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ মহলে পৌঁছানোর ক্ষমতা সাংবাদিকের আছে। একজন সাংবাদিক অনেকাংশেই তা পারেন। আর তাই মোনাজাত উদ্দিন কেবল সেই কৃষকের প্রতিনিধি নন, তিনি একাধারে কর্মী, জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, ছাত্র, শিক্ষকের ও জনপ্রতিনিধি।

আজীবন নির্লোভ আর নিষ্ঠার এক অনন্য উদাহরণ ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। মন্ত্রীর সঙ্গে একই টেবিলে বসে খেয়েও সেই খাবারের বিরুদ্ধেই সংবাদ করতে দ্বিধা করেননি। শিরোনামে লিখেছেন, 'আসাম থেকে বন্যা, ঢাকা থেকে বাবুর্চি, বগুড়া থেকে দৈ'। সত্য প্রকাশের দ্বিধাবোধ টলাতে পারেনি আদতে সরল জীবনের অধিকারী মোনাজাতউদ্দিনকে। সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি গেছেন বিদেশে। চিরচেনা সেই শার্ট, নিজের স্যুট নেই বলে নিয়েছেন ধার। আজকের দিনে তাকালে তা অলৌকিক ঠেকে আমাদের কাছে।

 মোনাজাতউদ্দিনের তৈরি অজস্র প্রতিবেদন স্বজন, পরিজন আর নিকটাত্মীয়দের বিরুদ্ধে গেছে। কিন্তু তিনি অটল থেকেছেন। দুর্নীতি ও আপোষকামিতা তাই মোনাজাতউদ্দিনকে স্পর্শ তো দূরে থাক ছায়াও মাড়াতে পারেনি। অথচ দৈনিক সংবাদে তিনি মাসিক বেতন পেতেন মাত্র ৫০০ টাকা।

মোনাজাতউদ্দিনের সংবাদের নেপথ্য, পথ থেকে পথে, কানসোনার মুখ, নিজস্ব রিপোর্ট, অনুসন্ধানী প্রতিবেদন, পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ, চিলমারীর একযুগ, কাগজে মানুষেরা, ছোটছোট খবর নরনারী বইতে চোখ বুলালে সেই ধারণা সুস্পষ্ট হয়। যেখানে মোনাজাতউদ্দিন বলেছেন তার আত্মকথা। সংবাদের পিছনের গল্প। সেসব যাত্রার বর্ণনাও কি অপরূপভাবে তুলে ধরেছেন।

মোনাজাত উদ্দিনের সাংবাদিকতার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিলো বগুড়ার বুলেটিনে'র মধ্য দিয়ে ষাটের দশকের প্রথমভাগে। তখন তিনি পড়তেন রংপুরের কৈলাশরঞ্জন হাইস্কুলে। এই স্কুলে থাকার সময়ে মুকুলফৌজের সদস্য হিসেবে দেয়াল পত্রিকা বের করতেন তারা। পরবর্তীতে ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আওয়াজ পত্রিকার মধ্য দিয়ে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা শুরু করেন মোনাজাত উদ্দিন। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পরে উত্তরবঙ্গের সংবাদদাতা হিসেবে তিনি যোগ দেন দৈনিক আজাদ পত্রিকায়। মাঝে কিছুদিন কাজ করেছিলেন দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায়।  মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীতে রংপুর থেকে মোনাজাতউদ্দিন নিজ সম্পাদনায় বের করেন দৈনিক রংপুর। চার বছর এই পত্রিকাটি সম্পাদনার পর দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় উত্তরবঙ্গের সংবাদদাতা হিসেবে যোগ দিতে হয়েছিল। টানা ২০ বছর দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। দৈনিক সংবাদ আর মোনাজাতউদ্দিন ছিল এক হরিহর আত্মা। এক পর্যায়ে ১৯৯৫ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায়। কিন্তু দৈনিক জনকণ্ঠে সঙ্গে তার পথচলা ছিল মাত্র ৮ মাসের।

কারমাইকেল কলেজে বি.এ. ক্লাসে পড়ার সময় বাবার মৃত্যুতে পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসায় সংসারের হাল ধরতে হয়েছিলো মোনাজাতউদ্দিনকে। পড়াশোনায় বিঘ্ন ঘটেছিল বলে পরে প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বি.এ পাশ করেছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা তাঁকে টানেনি কখনোই। টেনেছিল তাকে আদ্যোপান্ত সংবাদের খোঁজ। যার হয়ে উঠেছিলো তাঁর আমৃত্যু নেশা।

আর তাই ১৯৯৫ সালের ২৯ ডিসেম্বর সংবাদের নেশায় পথ থেকে পথে ছুটতে ছুটতে মোনাজাতউদ্দিন গিয়েছিলেন গাইবান্ধার ফুলছড়ির যমুনা নদীর ধারে কালাসোনার ড্রেজিং পয়েন্টে। ফেরিতে নদী পারাপারের সময় প্রতিবেদনের জন্য ছবি তুলতে গিয়ে পা পিছলে পড়ে যান যমুনায়। আদ্যন্ত সংবাদের খোঁজে ছুটে বেড়ানো মানুষটি নিজেই হয়ে গেলেন সংবাদপত্রের সংবাদ।

পরদিন তাঁর হারিয়ে যাওয়ার সংবাদের খোঁজ কি পেয়েছিলেন মঙ্গাপীড়িত রংপুরের আফজাল মোল্লা, পেয়েছিলেন গাইবান্ধার শেফালি বেগম, পেয়েছিলেন কী শেরপুরের কোন অভাবী গ্রামের বেকার বৃদ্ধ মজুর ভাদু? যে আফজাল মোল্লা, শেফালি বেগম আর মজুর ভাদু কথা পরম মমতায় মোনাজাতউদ্দিন লিখেছিলেন, 'ভুলে যাই দীর্ঘদিন বেকার বৃদ্ধ মজুর ভাদুর কথা, বিস্মৃত হই কাঁচকলা সেদ্ধ খাওয়া সেই বৃদ্ধা। যে গ্রামে ক্ষুধা আজও আছে, যেখানে অনাহারজনিত অপুষ্টিতে মারা গেছে নর-নারী-শিশু। তারা কোথায়? তারা থাকুক কি মরুক, আধ সের চালের ভাত ৭ জনে ভাগ করে খাক কিংবা কেউ খাক কাঁচকলা সেদ্ধ, আমার যেন কিছু যায় আসে না!' আপনার আমার না আসলে গেলেও একজন মোনাজাতউদ্দিনের ঠিকই আসতো যেত।

[email protected]

তথ্যসূত্র:

সেই আছিরন এই আছিরন/ আরিফুল হক, প্রথম আলো

পথ থেকে পথে/ মোনাজাতউদ্দিন

সংবাদ নেপথ্য/ মোনাজাতউদ্দিন

পায়রাবন্দের শেকড় সংবাদ/ মোনাজাতউদ্দিন

মোনাজাতউদ্দিন রচনাসমগ্র

 

Comments

The Daily Star  | English

There is a reason why daily news has become so depressing

Isn't there any good news? Of course, there is. But good news doesn't make headlines.

7h ago