রংপুরে প্রথম শহীদ শংকু সমাজদারের স্মৃতিস্তম্ভ চান তার মা

গভীর মমতায় শহীদ সন্তান শংকু সমাজদারের ছবি মুছে দিচ্ছেন মা দীপালি সমাজদার। ছবি: কংকন কর্মকার/ স্টার

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রংপুরে প্রথম শহীদ হয়েছিলেন শংকু সমাজদার। দেখতে দেখতে প্রিয় সন্তান শংকুকে ছাড়াই পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে তার মা দীপালি সমাজদারের। জীবন সায়াহ্নে শহীদ সন্তানের একটি স্মৃতিস্তম্ভ চান এই মা।

রংপুর মহানগরীর কামাল কাছনায় সরকারের দেওয়া একটি বাড়িতে পরিবার নিয়ে বাস করছেন দীপালি সমাজদার। শহীদের তালিকায় শংকুর নাম গেজেটভুক্ত হলেও সরকারি ভাতা জুটেনি। রংপুর সিটি করপোরেশন মাসিক ভাতা দিয়ে শহীদ পরিবারটিকে সহায়তা করছে।

দীপালী সমাজদারের তিন সন্তানের মধ্যে একমাত্র কন্যা ঝর্ণা ব্যানার্জী বেঁচে আছেন।

ঝর্ণা ব্যানার্জী দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, একাত্তরের ৩ মার্চ আমার ভাই শংকু সমজদার বড় ভাইয়ের হাত ধরে মিছিলে গিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স চার-পাঁচ বছর। সেদিন ওই মিছিলে গিয়ে চোখে গুলিবিদ্ধ হয়ে শংকুর মৃত্যু হয়। আমরা তার মরদেহটাও দেখতে পারিনি। যে ভাইয়ের হাত ধরে শংকু মিছিলে গিয়েছিলেন, সেই বড়ভাই কুমারেশ সমাজদার গত বছর ৩ জুলাই মারা গেছেন।

'আমার ৮৫ বছর বয়সী মা ভীষণ অসুস্থ। দীর্ঘদিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর এখন বাড়িতে শয্যাশয়ী অবস্থায় তার দিন কাটছে। আমার মা এবং আমাদের চাওয়া, ৩ মার্চ শংকুর মৃত্যুর দিনটি সরকারি উদ্যোগে অথবা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে পালন করা হোক। আর যদি একটা ম্যুরাল বা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা যায়, তাহলে আমার মা সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন।'

শিশু শংকু সমাজদার। ছবি: সংগৃহীত

তিনি আরও বলেন, 'আমার ভাই দেশের স্বাধীনতার জন্য শহীদ হয়েছেন। এটি আমাদের জন্য গর্বের। সরকার আমার ভাইকে শহীদের মর্যাদা দিয়েছেন। জেলা প্রশাসন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা আমাদের সহযোগিতা করেছে। আমরা সবার কাছে কৃতজ্ঞ।'

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ, সারাদেশের মতো উত্তাল ছিল রংপুর। পাকিস্তানি স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে ডাকা হরতালের পক্ষে শহরে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়েছিল। সেই মিছিলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হন কিশোর শংকু সমাজদার। স্বাধীনতা সংগ্রামে কিশোর শংকু সমাজদার রংপুর অঞ্চলের প্রথম শহীদ।

স্বাধীনতা সংগ্রামে কিশোর শংকুর মৃত্যু মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছিল। ৭ই মার্চের ভাষণে শংকু সমাজদারের আত্মত্যাগকে ঘিরে বঙ্গবন্ধুর উচ্চারণে ঠাঁই পায় রংপুরও।

সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ভাষণে রংপুরকে জায়গা দিলেও স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও আক্ষেপ ঘোচেনি শহীদ পরিবারটির। প্রতিবছর শংকু সমাজদারের মৃত্যুর দিনটি এক রকম নীরবেই কেটে যায়।

শংকু সমজদারের মা দীপালী সমাজদার বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চের ভাষণে আমার ছেলে শংকুর জন্য রংপুরের কথা বলেছেন। আমাকে শহীদের মা হিসেবে দুই হাজার টাকাও দিয়েছেন। সরকার থেকে আমাদের থাকার বন্দোবস্ত করে দিয়েছেন। এখন আমার একটাই চাওয়া, শংকুকে আগামী প্রজন্মের মধ্যে বাঁচিয়ে রাখতে তার স্মরণে একটা স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হোক। আমি বেঁচে থাকা অবস্থায় ভালোবাসার ফুল দিয়ে দিতে চাই। সরকারসহ রংপুরের প্রশাসনের কাছে আমার এটাই শেষ চাওয়া।

একাত্তরের ৩ মার্চের সেই উত্তাল দিনের কথা বলছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সদরুল আলম দুলু। তিনি বলেন, সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের পর সারাদেশের মতো উদ্বেলিত হয়েছিল রংপুরের মানুষ। ইয়াহিয়া খান একাত্তরের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেও ১ মার্চ অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণায় বিক্ষোভে ফেটে পড়েছিল পূর্ববাংলা। সারা দেশের মতো রংপুরেও দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছিল বিদ্রোহের আগুন।

'পূর্বনির্ধারিত অধিবেশন স্থগিত হওয়ার প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় এবং ৩ মার্চ দেশব্যাপী হরতালের ডাক দেন বঙ্গবন্ধু। এরই ধারাবাহিকতায় রংপুরে হরতাল পালিত হয়। পাকিস্তানি দখলদারদের শোষণ-শাসন এবং ষড়যন্ত্রের খপ্পর থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনতে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল রংপুরের মানুষ।'

মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক এই কমান্ডার বলেন, ৩ মার্চ সকালে হরতালের সমর্থনে মিছিল বের হয়। সেই মিছিলে বড় ভাইয়ের হাত ধরে যোগ দেন কৈলাশ রঞ্জন স্কুলের ৭ম শ্রেণির ছাত্র শঙ্কু সমাজদার।

'মিছিল এগিয়ে চলে স্টেশন অভিমুখে। মিছিলটি আলমনগর এলাকার অবাঙালি ব্যবসায়ী সরফরাজ খানের বাসার সামনে যেতেই এক কিশোর ওই বাসার দেয়ালে একটি উর্দুতে লেখা সাইনবোর্ড দেখে তা নামিয়ে ফেলতে উদ্যত হন। আর তখনই বাসার ভেতর থেকে মিছিলটি লক্ষ্য করে গুলি ছোড়া হয়। সেখানে গুলিবিদ্ধ হন কিশোর শংকু সমাজদার। সঙ্গে সঙ্গে মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ কিশোর শংকুকে পাঁজাকোলা করে নিয়ে মুসলিম উদ্দিন কমিশনার হাসপাতালের দিকে দৌঁড়ালেন। কিন্তু পথেই কিশোর শংকু মারা যান। হয়ে যান ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রামে রংপুর অঞ্চলের প্রথম শহীদ কিশোর শংকু সমাজদার।'

তিনি আরও বলেন, ৩ মার্চের ওই ঘটনায় আরও দুইজন শহীদ হন। তাদের একজনের নাম আবুল কালাম আজাদ, অপরজন ওমর আলী। এছাড়াও সেদিন আরও দুইজন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন।

স্বাধীনতা আন্দোলনে রংপুরের প্রথম শহীদ কিশোর শংকু সমাজদারের মায়ের ইচ্ছাপূরণে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক উমর ফারুক গড়ে তুলেছেন শহীদ শংকু সমাজদার বিদ্যানিকেতন।

উমর ফারুক দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, শহীদ শংকু সমাজদার একটি সাহসের নাম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সাথে এই নামটি জড়িয়ে আছে। রংপুরের মানুষের আবেগের সাথে এই নামের সম্পর্ক। তার মায়ের ইচ্ছেনুযায়ী আমরা ব্যক্তি উদ্যোগে একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করেছি। এই প্রতিষ্ঠান থেকে আগামী প্রজন্মকে শহীদ শংকুর চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে জানাতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।

Comments

The Daily Star  | English

Most banks fail to finalise annual financial reports

BB seeks govt approval to extend deadline

2h ago