‘সব ধর্মের মানুষ মিলে দেশ স্বাধীন করেছিলাম’

সব ধর্মের মানুষ মিলে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। পরাধীনতা থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু, মানুষ স্বাধীন হয়নি। হানাহানি চলছে। আমি চাই সবাই শান্তিতে থাকুক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকুক—কথাগুলো বলেছেন সাঁওতাল বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিন হেমরম।
বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিন হেমরম। ছবি: রবিউল হাসান/স্টার

সব ধর্মের মানুষ মিলে দেশ স্বাধীন করেছিলাম। পরাধীনতা থেকে দেশ মুক্ত হয়েছে। কিন্তু, মানুষ স্বাধীন হয়নি। হানাহানি চলছে। আমি চাই সবাই শান্তিতে থাকুক। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকুক—কথাগুলো বলেছেন সাঁওতাল বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিন হেমরম।

যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকাররা এলাকায় বাড়ি-ঘরে আগুন দিলে আমিন হেমরম পরিবারের সঙ্গে মালদহে চলে যান।

সেখানে এই সাঁওতাল যুবক প্রিয় মাতৃভূমিকে হানাদার মুক্ত করার আশায় প্রশিক্ষণ নেন এবং সরাসরি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিনের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম রুদ্রকুন্ডে। জেলা শহর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। ২৬ বছর বয়সে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

তার স্ত্রী জমরি মূর্মূ। এই দম্পতির রয়েছে এক ছেলে ও ৩ মেয়ে। তাদের ২ মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছোটমেয়ে সুবিতা হেমরম রাজশাহীর তানোর উপজেলার মুন্ডুমালা মহিলা কলেজে এইচএসসি প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিন হেমরম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও রাজাকারেরা মে মাসে এলাকায় বাড়ি-ঘরে আগুন দিলে প্রাণভয়ে পরিবারের সবার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মালদহের সিংগাবাদে চলে যাই।'

তিনি জানান, তার বাবা-মা, ৫ ভাই, ৩ বোন ও দাদি ক্যাম্প পুকুর এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরদিন তাদেরকে সেখান থেকে বাঙ্গীটোলা স্কুলে পাঠানো হয়। প্রায় এক মাস সেখানে থাকার পর তাদের কুতুবহ শহর ক্যাম্পে স্থানান্তরিত করা হয়।

সেখানে পরিচয় হয় রাজশাহীর গোদাগাড়ি উপজেলার সংগ্রাম মাঝির সঙ্গে। তিনি ওই ক্যাম্পে তরুণ-যুবাদের নিয়ে বৈঠক করেন। তাদেরকে যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, 'সবাইকে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে হবে। দেশ স্বাধীন করতে হবে।'

সংগ্রাম মাঝির এই কথা আমিনকে আলোড়িত করে। তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে মালদহের গৌড় বাগান এলাকায় মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে তিনিসহ ৫ যুবক যান। সেখানে অন্যদের সঙ্গে ১৫ দিন প্রশিক্ষণ নেন।

প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষে অস্ত্র প্রশিক্ষণের জন্যে শিলিগুড়ি আসেন। সেখানে প্রায় ২ সপ্তাহ অস্ত্র চালনা ও গেরিলা যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষণ নেন। প্রশিক্ষণ শেষে ভারতের দিনাজপুরে যান। সেখানে তাদের হাতে অস্ত্র দেওয়া হয়।

তারা (বীরশ্রেষ্ঠ) ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরের নেতৃত্বে ৭ নম্বর সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

আমিন হেমরম বলেন, 'কমান্ডারেরা যখন যেখানে যেতে নির্দেশ দিয়েছিলেন সেখানে গিয়ে যুদ্ধ করেছি। অনেক সময় সম্মুখভাগের যোদ্ধারা পিছু হটলে গেরিলা টিমকে পাঠানো হত।'

কমান্ডার আব্দুস সামাদ ছিলেন তাদের দলনেতা। তার নেতৃত্বে ১৪ জনের এক দল ও কমান্ডার ইদ্রিসের নেতৃত্বে আরেক দল সোনা মসজিদের কলাবাগান সীমান্ত অতিক্রম করে শিবগঞ্জ উপজেলার আড়গাড়া হাটে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তাদের দোসরদের ২ দিক থেকে আক্রমণ করে তাদের পিছু হটতে বাধ্য করে। ওই লড়াইয়ে এক রাজাকার মারা যায় এবং আড়গাড়া হাট শত্রু মুক্ত হয়।

এরপর তিনি গোমস্তাপুর, ভোলাহাট ও রহনপুরে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।

দীর্ঘ ৫০ বছর আগের ঘটনা ও বার্ধক্যের কারণে এখন অনেক কিছু মনে করতে পারেন না তিনি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার সংবাদ আমিন হেমরম শুনতে পান ভারতে ক্যাম্পে বসে। এরপর পরিবারের লোকজনদের সঙ্গে নিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশে ফিরে আসেন।

কয়েকদিন পর অস্ত্র জমা দিতে বলা হলে তিনি রাজশাহী গিয়ে অস্ত্র জমা দেন।

'যখন দেশ ছেড়ে যাই তখন পরাধীন ছিলাম। স্বাধীন হওয়ার পর যখন দেশে আসি তখন অনুভূতি একেবারে অন্যরকম ছিল। তা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। নিজের দেশে ফিরলাম—এই আনন্দ একেবারে আলাদা ছিল,' যোগ করেন তিনি।

বীর মুক্তিযোদ্ধা আমিন হেমরমের সন্তানেরা বাবাকে নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। ছোটমেয়ে সুবিতা হেমরম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'মানুষজন যখন বলেন তোমার বাবা বীর মুক্তিযোদ্ধা তখন মনটা আনন্দে ভরে যায়। বাবাকে নিয়ে আমাদের খুব গর্ব হয়।'

উত্তরবঙ্গ আদিবাসী ফোরাম কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি হিংগু মূর্মূ ডেইলি স্টারকে বলেন, 'ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী সম্প্রদায়ের যে কয়েকজন মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন আমিন হেমরম তাদের অন্যতম। এটা খুবই গর্বের।'

চাঁপাইনবাবগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক প্রচার সম্পাদক সেরাজুল ইসলাম ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমিন হেমরম বীর মুক্তিযোদ্ধা। যুদ্ধের সময় তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। আমরা এক সঙ্গে আড়গাড়া হাটসহ নানাস্থানে যুদ্ধ করেছি।'

Comments

The Daily Star  | English

History of student protests in the USA

American campuses -- home to some of the best and most prestigious universities in the world where numerous world leaders in politics and academia have spent their early years -- have a potent history of student movements that lead to drastic change

6h ago