মুক্তিযুদ্ধ

সব মুক্তাঞ্চলে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে: ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৪ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগরে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য দেশের সমস্ত মুক্তাঞ্চলে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে এখানে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বলবৎ থাকবে।'

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৪ সেপ্টেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগরে সাংবাদিকদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, 'মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেয়ার জন্য দেশের সমস্ত মুক্তাঞ্চলে ফিল্ড হাসপাতাল গড়ে তোলা হবে। একই সঙ্গে এখানে সব ধরনের চিকিৎসা সেবা বলবৎ থাকবে।'

১৪ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. আব্দুল মোতালেব মালিক পাকিস্তান রেডিওতে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে বলেন, 'জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ শুরু করার উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট আমাকে এই প্রদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান নিযুক্ত করেছেন। আমি আপনাদের সাহায্য ও সহযোগিতা কামনা করছি এই জন্য যাতে প্রদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা যায়। আজকের যুবকশ্রেণি তো জানে না যে, নতুন এক জাতির বাসভূমি আমাদের এই পকিস্তানকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য আমাদের কত পরিশ্রম করতে হয়েছে। পরিশেষে আমি আরো বলতে চাই যে, আমার সরকার একটি অন্তবর্তীকালীন সরকার। যে মুহূর্তে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে এবং নির্ধারিত কার্যক্রম অনুসারে উপনির্বাচন সমাপ্ত করা হবে, সেই মুহূর্তে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে জনগণের সার্বভৌমত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা হবে।' 

ভারতে এদিন

১৪ সেপ্টেম্বর ভারতের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী সমস্ত রাজ্যে সীমান্তে কড়া নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য সীমান্ত রাজ্যগুলোর প্রতি নির্দেশ দেয়। একই সঙ্গে তারা বলে পাকিস্তানি বাহিনী যে কোনো মুহূর্তে ভারতের উপর হামলা করতে পারে। নির্দেশনা দেয়ার পর কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মুখ্য সচিব সাংবাদিকদের বলেন, 'পশ্চিমবঙ্গসহ সারাদেশে জরুরি অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে। ভারত সরকারের গোয়েন্দারা জানতে পেরেছেন, পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের মুখে ভারত আক্রমণের প্রস্তুতি প্রায় সম্পন্ন করেছে। বর্ষণ থেমেছে। যে কোনো সময় তারা ভারতের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। সম্ভাব্য এই আক্রমণ মোকাবিলায় কঠোর ব্যবস্থা নিতে পুলিশের গোয়েন্দা ও বিশেষ বিভাগ ঢেলে সাজানো হচ্ছে।'

১৪ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতি নির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর ও ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিব পি এন ধরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি মঈদুল হাসান।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৪ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে নানা বিষয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান ও ইরানের সঙ্গে আলোচনার জন্য তেহরানের উদ্দেশে লাহোর ত্যাগ করেন। এদিন ইরানের তেহরান বিমানবন্দরে পৌঁছালে ইরানের রাজা মোহাম্মদ রেজা শাহ পাহলভি তাকে স্বাগতম জানান।

১৪ সেপ্টেম্বর মস্কোতে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগোর্নির সঙ্গে এক ভোজসভায় অংশ নেন আফগানিস্তানের রাজা জহির শাহ। এসময় নিকোলাই পদগোর্নি বলেন, 'দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির স্বার্থেই বাংলাদেশ সংকটের দ্রুত সমাধান প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সোভিয়েত ও ভারতের মধ্যকার চুক্তি অনন্য ভূমিকা পালন করবে।'

১৪ সেপ্টেম্বর ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বেশ কয়েকজন এমপির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তিনি বাংলাদেশে চলমান হানাদার বাহিনীর নৃশংসতার চিত্র তুলে ধরেন। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিনল্যান্ডের এক প্রতিনিধি বাংলাদেশের সংগ্রামের পক্ষে তার সরকারের সমর্থন আদায়ের আশ্বাস দেন। একই দিন আবু সাঈদ চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী সম্পাদক, আইনজীবী, মানবাধিকার কর্মী ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাত করেন।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৪ সেপ্টেম্বর সিলেটে মধ্যরাত থেকে হানাদারবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সরাপাড়া, গোবিন্দপুর, বারুধা, অস্টোঘোরি, আভংগি ও তাজপুর ঘাঁটির ওপর চতুর্দিক থেকে আর্টিলারি হামলা শুরু করে। এসময় হানাদার সেনারা মুক্তিবাহিনীর সরবরাহ লাইন সরাপাড়া দখলে নিয়ে নেয় এবং মূল ক্যাম্প থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধারা ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়লে সেনাই নদী পার হয়ে পিছু হটে। এই যুদ্ধে ৬ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৫ জন আহত হন। এসময় মুক্তিযোদ্ধাদের সমস্ত অস্ত্র ও গোলাবারুদ হানাদার সেনাদের দখলে চলে যায়।

১৪ সেপ্টেম্বর জামালপুরে ৭ নম্বর সেক্টর সদরদপ্তর থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দল যমুনা নদী হয়ে বাহাদুরাবাদ ঘাটের কাছে এলে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি টহলবোট তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনী বেশ কয়েকটা দলে ভাগ হয়ে পাল্টা আক্রমণ করলে হানাদার বাহিনীর টহল বোটটি ডুবে যায়।

১৪ সেপ্টেম্বর ফেনীর বিরিঞ্চিতে মুক্তিবাহিনীর এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কামানঘাঁটির উপর ৩ ইঞ্চি মর্টারের গোলাবর্ষণ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর কামান ঘাঁটি ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসময় কামানঘাঁটির ভেতরে থাকা ৩টি জিপও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর হানাদার বাহিনীর ফেনীর মূল ঘাঁটি থেকে হানাদারেরা কামানের সাহায্যে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের দিকে পাল্টা আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা তা প্রতিরোধ করেন। প্রায় দুই ঘণ্টা স্থায়ী এই যুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি কামানসহ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর সিলেটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল ভোর ৪টার দিকে মুক্তিবাহিনীর কুমারশৈল ঘাঁটির উপর হামলা করে। এসময় মুক্তিবাহিনীও ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। প্রায় ৫ ঘণ্টাব্যাপী দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটে যায়। একই দিন ভোরে সিলেটের ২ কোম্পানি হানাদার সেনা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর আক্রমণ করলে মুক্তিযোদ্ধারা সকাল ৯টা পর্যন্ত হামলা প্রতিহত করে। এসময় বেশ কজন হানাদার সেনা ও রাজাকার নিহত হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর একটি জিপ অতর্কিত হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩০ জন সেনা হতাহত হয়। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা নুরুন্নবী আহত হন।

১৪ সেপ্টেম্বর ভোর ৬টার দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের খড়মপুর অবস্থানে সিলেটের আরেকদল হানাদার হামলা চালায় এবং প্রতিরোধের মুখে পিছু হটে। কিছুক্ষণ পরে শক্তিবৃদ্ধি করে পাকসেনারা আবার হামলা চালায়। সকাল ১০টা পর্যন্ত প্রতিহত করে মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে বেশ কজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ ও আহত হন।

১৪ সেপ্টেম্বর খুলনার আলফাপুর এলাকায় মুক্তিবাহিনী এক দুর্ধর্ষ অপারেশনে হানাদার বাহিনীর ২৭ জন সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনী হানাদারদের কাছ থেকে বেশ কিছু অস্ত্র উদ্ধার করে।

১৪ সেপ্টেম্বর কুমিল্লার কসবা এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এই সময় ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনী পাগলাদিয়ান হাটে হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর ৮ সৈন্য নিহত হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর কায়েমপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কায়েমপুর অবস্থানের ওপর রকেট লঞ্চার নিয়ে হামলা চালায়। এসময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর দুটি বাঙ্কার ধ্বংস হয় এবং বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য হতাহত হয়।

১৪ সেপ্টেম্বর রাজশাহীর খানজাহানপুরে মুক্তিবাহিনীর ৩০০ সদস্যের একটি মুক্তিযোদ্ধা দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা হতাহত হয়। হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে পিছু হটে গেলে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে আসে।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র চতুর্থ, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড 

দৈনিক পাকিস্তান ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ 

[email protected] 

Comments

The Daily Star  | English
Are schools open? Simple issue unnecessarily complicated

Are schools open? Simple issue unnecessarily complicated

Are the secondary schools and colleges open today? It is very likely that no one can answer this seemingly simple question with certainty.

36m ago