‘স্বামীকে কোথায় নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তা যদি জানতে পারতাম’

খবির উদ্দিন মিয়ার স্ত্রী ছালেহা বেগম। ছবি: স্টার

১৯৭১ সালের ৫ ডিসেম্বর। রাজবাড়ীর পাংশায় সরকারি বীজ আনতে গিয়েছিলেন বেলগাছি আলিমুজ্জামান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের (বর্তমানে বেলগাছি আলিমুজ্জামান স্কুল অ্যান্ড কলেজ) এক শিক্ষক। সঙ্গে ছিল তার ছেলে। সেদিন ছেলে ফিরে আসলেও ফিরেননি তিনি।

কোথায় আছেন, কেমন আছেন আজও সব অজানা। পরিবারের শেষ ইচ্ছে কোথায় তাকে হত্যা করা হয়েছে তা জানা। কিন্তু সেই ঠিকানা কি মিলবে? সবার কাছে উত্তর অজানা।

বলছি শিক্ষক খবির উদ্দিন মিয়ার কথা। বিজয়ের ৫০ বছর পরেও পরিবারের সদস্যরা জানেন না, তাকে কোথায় নিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

খবির উদ্দিন মিয়ার জন্ম রাজবাড়ী সদর উপজেলার রায়নগর গ্রামে। ১৯৪৪ সালে রামদিয়া বিএমবিসি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেন। ১৯৪৬ সালে বেলগাছি আলিমুজ্জামান বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন।

মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে স্থানীয় যুবক-তরুণদের সংগঠিত করেন খবির উদ্দিন। স্কুল মাঠে বাঁশের লাঠি ও কাঠের বন্দুক (ডামি) দিয়ে প্রশিক্ষণ দেন। ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনচেতা হওয়ায় স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছিল বৈরী সম্পর্ক।

স্থানীয়রা ও পরিবারের সদস্যরা মনে করেন, স্থানীয়ভাবে প্রভাবশালী শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান চৌধুরী ওরফে নান্নু চৌধুরীর নির্দেশে তাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।

ব্যক্তিজীবনে খবির উদ্দিন ছিলেন ২ ছেলে ও ৩ মেয়ের জনক। স্ত্রী ছালেহা বেগম এখনো জীবিত। বড় ছেলে মারা গেছেন। তিনিও শিক্ষকতা করতেন।

যেদিন খবির উদ্দিন মিয়াকে পাংশা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন তার সঙ্গে ছিলেন মেজো ছেলে আব্দুর রব মিয়া।

আব্দুর রব মিয়া দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি তখন সপ্তম শ্রেণির ছাত্র। নানা ছিলেন তৎকালীন ইউপি সদস্য। ওই দিন পাংশায় সরকারি বীজ দেওয়ার কথা ছিল। নানার পক্ষ থেকে আব্বাকে যেতে বলা হয়। আব্বা আমাকে ও আমার খালাতো ভাইকে সঙ্গে নেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পদ্মানদীর পাড় ঘেঁষে হাঁটা পথে রওনা দেই। এসময় আমাদের এলাকার আরও ৮-১০ জন ছিলেন।'

তিনি বলেন, 'স্থানীয় গতমপুর বাজার পৌঁছানোর পর বাবার কিছু মুক্তিযোদ্ধা শিক্ষার্থী পথ আটকে দাঁড়ান। তারা বাবাকে পাংশা না যেতে অনুরোধ করেন। এ কথা শুনে আমাদের সঙ্গে থাকা কয়েকজন ভয়ে ফিরে আসেন। আমরা বেলা সাড়ে ১১টার দিকে পাংশা রেলস্টেশন এলাকায় পৌঁছাই। আমরা একটি চায়ের দোকানে বসি। তোমরা এখানে থাকো, আমি একটু আসছি বলে বাবা বাইরে যান। এরপর বাবা আর ফিরে আসেননি।'

আব্দুর রব মিয়া বলেন, 'বিকেল ৪টার দিকে চায়ের দোকানটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। আমরা বাবাকে খুঁজতে থাকি। পাংশা শহর একেবারে নীরব। কারফিউ জারি করা হয়েছে। রাস্তাঘাটে কোনো মানুষজন নেই। স্টেশনের অদূরে বাঙ্কার থেকে আমাকে এক পাকিস্তানী সেনা ধরে ফেলে। সে আমাকে তল্লাশি করতে থাকে। এমন সময় আমাদের দূর সম্পর্কের এক আত্মীয় রাজাকার আবদুল লতিফ সেখানে উপস্থিত হন। আমাকে তার (রাজাকার আবদুল লতিফ) ছোট ভাই বলে ছাড়িয়ে নিয়ে আসেন।'

তিনি আরও বলেন, 'আবদুল লতিফ আমাকে জানান, স্যার (খবির উদ্দিন মিয়া) আমাদের কাছে আছে। আগামীকাল সকালে বাড়ি নিয়ে আসব। তোমরা নদীর পাড় দিয়ে বাড়ি যাও। রাত ২টার দিকে বাড়ি আসি। ওইদিন রাতেই পাকিস্তানি সেনারা ট্রেনে করে পাংশা ত্যাগ করে। বেলগাছি-সূর্যনগর রেলস্টেশনের মাঝামাঝি বাড়াইজুরিতে রেলসেতু ভেঙে দেন মুক্তিযোদ্ধারা। এ কারণে ট্রেন এসে বেলগাছি রেলস্টেশনে অবস্থান নেয়। সকালে আমার নানা পাকিস্তানি সেনাদের মাধ্যমে বাবার কাছে একটি চাদর পৌঁছে দেন। এরপর আমরা বাবাকে আর কোথাও খুঁজে পাইনি।'

এখনো তাকে খুঁজছি বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।

খবির উদ্দিনের স্ত্রী ছালেহা বেগম দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'পাংশা থেকে বীজ আনার কথা বলে খবির বাড়ি থেকে বের হন। রাজাকাররা তাকে ধরিয়ে দেন। পরেরদিন সকালে বেলগাছিতে আমার বাবাসহ অনেকেই তাকে দেখেছেন। তাকে আর্মিরা রাজবাড়ী নিয়ে যান। কিছুদিন পরেই দেশ স্বাধীন হয়। তিনি আর ফিরে আসেননি। আমি নানা কষ্টে সন্তানদের বড় করেছি।'

কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, 'আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু আজও তার কোনো স্বীকৃতি পেলাম না। মারা যাওয়ার আগে আমার একটাই ইচ্ছা, স্বামীকে কোথায় নিয়ে হত্যা করা হয়েছিল তা যদি জানতে পারতাম।'

বেলগাছি আলিমুজ্জামান স্কুল অ্যান্ড কলেজের সাবেক সহকারী শিক্ষক মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম মো. মোস্তফা দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'আমি স্যারের সরাসরি ছাত্র ছিলাম। খুব ভালো মনের মানুষ ছিলেন স্যার। তিনি ছিলেন একজন আদর্শ শিক্ষক। বিদ্যালয়ে আমাদের কুচকাওয়াজ শেখাতেন। প্যারেট করাতেন। মহান মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তিনি নিজ উদ্যোগে যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। সবাইকে উৎসাহ দিতেন। অনুপ্রেরণা যোগাতেন।'

'তাকে পাংশা থেকে প্রকাশ্যে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। ধারণা করা হয়, তাকে রাজবাড়ী নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। তবে তার মরদেহ কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায়নি', বলেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

123 ‘pushed in’ from India

Border Guard Bangladesh (BGB) yesterday detained at least 123 individuals, including Rohingyas and Bangla-speaking individuals, after India pushed them into Bangladesh through Kurigram and Khagrachhari border points.

1h ago