‘স্বামীর মৃত্যুর পর বেশিরভাগ সময় অনাহারে কাটাতে হয়েছে’

শহীদ সন্তোষ কুমার দাস। ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল যখন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে সন্তোষ কুমার দাস শহীদ হন তখন তার বয়স ছিল ৩৩ বছর। তিনি ছিলেন গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজের (তৎকালীন কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজ) দর্শন বিভাগের শিক্ষক।

শহীদ সন্তোষ কুমার দাস ও স্ত্রী নীলিমা দাস। ছবি: সংগৃহীত

স্বাধীনতার ৫০ বছর পরও এই শহীদ বুদ্ধিজীবীর পরিবারের নেই নিজের জমি বা ঘর। ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় টিনের ভাড়া বাসায় থাকেন শহীদ সন্তোষ কুমার দাসের বিধবা স্ত্রী নীলিমা দাস ও ৪ ছেলে।

ওই সময়ের প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের যে ২ শিক্ষকের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর ক্ষোভ ছিল তাদের একজন সন্তোষ কুমার দাস। অপরজন হলেন বৈলতলি সাহাপুর সম্মিলনী উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গোবিন্দ ঠাকুর। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদেরকে গুলি করে হত্যা করে।

সন্তোষ কুমার দাস শিক্ষকতার পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। কবিতা আবৃত্তি ও বিপ্লবী গান গেয়ে শিক্ষার্থীসহ মুক্তিপাগল জনতাকে স্বাধীনতার চেতনায় উজ্জীবিত করতেন তিনি।

মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্ভাসিত ও মুক্তমনা ছিলেন বলেই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর টার্গেট ছিলেন সন্তোষ দত্ত।

গোপালগঞ্জ শহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢুকলে তিনি সদর উপজেলার উরফি ইউনিয়নের মানিকহার গ্রামে কাপালিক পাড়ায় আশ্রয় নেন। ৩০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী তার খোঁজে মানিকহার গ্রামে গণহত্যা চালায়। সেখানে শহীদ হন মুক্তিপাগল সন্তোষ দাস। পরবর্তী ওই গ্রামে শহীদের তালিকা সম্বলিত ফলক নির্মিত হয়, সেখানে রয়েছে সন্তোষ দাসের নাম।

শহীদ সন্তোষ কুমার দাস ১৯৩৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফরিদপুর শহরের ঝিলটুলী মহল্লায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা বরদা কান্ত দাস, মা কিরন বালা দাস। ৩ ভাই ও ১ বোনের মধ্যে সন্তোষ কুমার দাস ছিলেন বড়।

১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনে এমএ পাশ করেন। যোগ দেন গোপালগঞ্জের তৎকালীন কায়েদে আজম মেমোরিয়াল কলেজে।

গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজের শিক্ষকদের মতে, সন্তোষ কুমার দাস খুব সাদাসিধে মানুষ ছিলেন। নিরহংকারী, পরোপকারী ও সদালাপী হিসেবে তার খ্যাতি ছিল। তিনি কবিতা আবৃত্তি ও গান গাইতেন। স্বাধীকার আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। তিনি দর্শন ও মনোবিজ্ঞান বিষয়ে ৪টি বই লিখেছেন। গোপালগঞ্জ বঙ্গবন্ধু কলেজে ছাত্রাবাস রয়েছে সন্তোষ দাসের নামে।

সন্তোষ দাসের ছাত্র ও পরবর্তীতে একই বিভাগের শিক্ষক যামিনী দাসগুপ্ত দ্য ডেইলি স্টারকে বলেন, 'শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিল। তার পড়ানোর স্টাইল শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতো, মুগ্ধ করতো।'

সন্তোষ কুমার দাসের তৃতীয় ছেলে অপু দাস ডেইলি স্টারকে বলেন, 'বাবার মৃত্যুর ৫০ বছর পরও আমরা অত্যন্ত মানবেতর জীবনযাপন করছি। ফরিদপুর শহরে আমাদের জমি বা বাড়ি নেই। ভাড়া বাসায় থেকে সংসার চালাতে গিয়ে প্রায় নিঃশেষ হয়ে গেছি। এ ছাড়াও, করোনা মহামারির কারণে গত প্রায় ২ বছরে আমাদের অবস্থা বেশি খারাপ হয়েছে।'

শহীদ সন্তোষ কুমার দাসের পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ফরিদপুরের জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনে বিধবা নীলিমা দাস লিখেছিলেন, 'বাসা ভাড়া ও অন্যান্য খরচ চালানো আমাদের পক্ষে একেবারেই অসম্ভব হয়ে পড়েছে। তাই বসবাস করার জন্য বাসস্থান খুব দরকার। যেটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার একক প্রচেষ্টায় সম্ভব।'

তিনি আরও লিখেন, 'আমার ৪ ছেলে ও ১ মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছি। আমাদের জীবন অনেক কষ্টের মধ্যে দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। আমার স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে জীবনের বেশিরভাগ সময় আমাদের অনাহারে/অর্ধাহারে কাটাতে হয়েছে যা এখনও মাঝে-মধ্যে ঘটে চলছে।'

এমন হৃদয়গ্রাহী চিঠি দেওয়ার ২ বছর ৯ মাস পরও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ দাসের পরিবার যে তিমিরে ছিল, সেই তিমিরেই পড়ে আছে।

Comments

The Daily Star  | English

US retailers lean on suppliers to absorb tariffs

Rather than absorbing the cost or immediately passing it on to consumers, many US apparel retailers and brands have turned to their suppliers in Bangladesh, demanding they share the pain

5h ago