১০ নভেম্বর ১৯৭১: বিলোনিয়া মুক্ত দিবস

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১০ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ফেনীর বিলোনিয়াতে দশম ইস্ট বেঙ্গলের কাছে ২ অফিসার ও ৭০ সেনাসহ মোট ৭২ জন হানাদার আত্মসমর্পণ করে। এর আগে দশম ইস্ট বেঙ্গলের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দেয় ভারতীয় বাহিনীর ৮৩ মাউন্টেন ব্রিগেড।
১০ নভেম্বর রাতে ভারতীয় আর্টিলারির ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের ব্রিগেডিয়ার সান্ধুর তৃতীয় ডোগরা রেজিমেন্ট পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আর্টিলারি হামলা শুরু করে। একইসঙ্গে মুক্তিবাহিনীও আক্রমণ শুরু করলে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায় হানাদার বাহিনী। ৫ নভেম্বর থেকে আত্মসমর্পণের আগ পর্যন্ত বিলোনিয়াতে হানাদার বাহিনী পুরোপুরি অবরুদ্ধ ছিল। বিলোনিয়ার ২ যুদ্ধে প্রায় ৫০০ হানাদার সেনা হতাহত হয়। শহীদ হন প্রায় অর্ধশত মুক্তিযোদ্ধা।
ঢাকায় এদিন
১০ নভেম্বর পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. এম এ মালিকের সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর সহকারী প্রধান মওলানা আবদুর রহিম। বৈঠকে আবদুর রহিম গভর্নরকে বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠা এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার ক্ষেত্রে যে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে জনসাধারণ সরকারের পাশে থাকবে। জামায়াতে ইসলাম দেশের জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করতেও দ্বিধাবোধ করবে না।'
ভারতে এদিন
১০ নভেম্বর দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন সাংবাদিকদের বলে, `হোসেন আলী ও তার পরিবারকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশন দিল্লির পাকিস্তান দূতাবাসে শরণার্থী ঢোকাবার বিষয়টি বিবেচনা করছে। আমরা সেখান থেকে তাকে মুক্ত করে আনবই। আমরা হোসেন আলীর মুক্তির জন্য সব রকম চেষ্টা করেছি। কিন্তু সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। মুজিবনগর থেকে আমাদের মিশন প্রধান হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এলেই আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।'
১০ নভেম্বর দিল্লিতে ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'পাকিস্তান যদি এবার ভারতে আক্রমণ করার দুঃসাহস দেখায়, তবে সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। বাংলাদেশে যা হচ্ছে, তা বিশ্ববাসী দেখছে। শরণার্থী সমস্যা দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য পাকিস্তান ক্রমাগত উসকানি দিচ্ছে বিশ্বজুড়ে।'
১০ নভেম্বর চণ্ডীগড়ে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিং সাংবাদিকদের বলেন, `ভারত আশা করে, চীনের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক শার্জে-ড্যাফেয়ারের স্তর থেকে রাষ্ট্রদূতের স্তরে উন্নীত করা যেতে পারে। চীন সরকার যে পাকিস্তানকে অব্যাহতভাবে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, তা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অবিচার।'
পাকিস্তানে এদিন
১০ নভেম্বর ফয়সালাবাদের লায়ালপুরে আইনজীবীদের উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি (পিডিপি) সভাপতি নুরুল আমিন বলেন, 'নির্বাচনে বিজয়ের পরে বেআইনি ঘোষিত আওয়ামী লীগ নেতারা বর্বরোচিত কার্যকলাপ শুরু করলে দেশে অরাজকতা সৃষ্টি হয়। সেনাবাহিনী বিদ্রোহ দমনে এগিয়ে এলে আওয়ামী নেতারা ভারতে গিয়ে নতুন কৌশলে হামলা শুরু করে। কিন্তু তাদের দিন আর বেশি বাকি নেই। কিছুদিনের মধ্যেই তাদের পতন হবে।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১০ নভেম্বর প্যারিস থেকে পশ্চিম জার্মানির রাজধানীতে যান ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এদিন সকালে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্টের সঙ্গে বৈঠক করেন তিনি। ইউরোপের বিভিন্ন পরিবর্তন, বাংলাদেশ পরিস্থিতি, শরণার্থী প্রত্যাবর্তনসহ নানা বিষয়ে ২ নেতার কথা হয়। পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট ভারতের বর্তমান অবস্থার বিষয়ে সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং ভারত শিগগির এ সমস্যা কাটিয়ে উঠবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১০ নভেম্বর কুড়িগ্রামে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদারবাহী একটি ট্রেনে অ্যামবুশ করার লক্ষ্যে রেললাইনে মাইন পেতে রাখে। পরে মাইন বিস্ফোরিত হয়ে ৮টি বগিতে থাকা ১ অফিসারসহ ৮ হানাদার সেনা নিহত হয়।
১০ নভেম্বর বিকেল ৫টার দিকে সিলেটের বাল্লা ও গোটাগ্রামে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে শখানেক রাজাকারপন্থী গ্রামবাসী মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় মুক্তিবাহিনী গুলি চালালে অর্ধশতাধিক গ্রামবাসী নিহত হয়। তাদের পেছনেই ছিল হানাদারদের বড় একটি দল। তবে প্রথমে মুক্তিবাহিনী তাদের উপস্থিতি টের পায়নি। পরে হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালালে মুক্তিবাহিনীও পাল্টা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে ৩ দিক থেকে ঘিরে ফেলে আর্টিলারি হামলা চালানো শুরু করে। ফলে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে।
হানাদারদের আগমনের খবর পেয়ে ১০ নভেম্বর কমান্ডার আবদুল হাসিম বাবলুর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল বগুড়া-সারিয়াকান্দি সড়কের পাশের বাইগুনী গ্রামে মাইন পেতে রাখে। পরে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় ১ কর্নেলসহ ৫ হানাদার সেনা নিহত হয়।
১০ নভেম্বর ৮ নং সেক্টরের আলীপুরে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে ৫ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়। ১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
১০ নভেম্বর বগুড়া শহরের নিশিন্দারায় মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মীর মঞ্জুরুল হক সূফীর নেতৃত্বে কয়েকজন গেরিলা ১১ হাজার কিলোওয়াট ভোল্টের ট্রান্সমিটার ধ্বংস করে দেন।
১০ নভেম্বর লালমনিরহাট এবং তিস্তাঘাটের মধ্যবর্তী বড়বাড়ি ইউনিয়নে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। এ সময় ক্যাম্পে থাকা ৫ হানাদার সেনা গুলিতে নিহত হয়। বাকিরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।
১০ নভেম্বর সিলেটের গাজুকাটায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ২ রাজাকারকে হত্যা করে একটি ৩০৩ রাইফেল দখল করে নেন।
১০ নভেম্বর ৮নং সেক্টরের তেরাইলে মুক্তিবাহিনীর একটি দল স্থানীয় রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় ১৬ রাজাকারকে আটক করা হয়। ক্যাম্প থেকে ১৬টি রাইফেল, ১১টি বেয়নেট ও বেশ কিছু গোলাবারুদ দখল করে নেয় মুক্তিবাহিনী।
১০ নভেম্বর মৌলভীবাজারের বড়লেখায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর বড়লেখা ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনীর ১৫ সেনা নিহত হয়। পরে মুক্তিবাহিনী ঘাঁটিটি দখল প্রচুর গোলাবারুদ ও অস্ত্র নিজেদের দখলে নেয়।
১০ নভেম্বর কুড়িগ্রাম-চিলমারী সড়কে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। পরে হানাদার বাহিনীর একটি দল রাজাকারসহ ট্রাকে করে ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী তাদের ওপর হামলা চালায়। এ সময় ৩ হানাদার সেনা ও ৩ রাজাকার নিহত হয়।
তথ্যসূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র একাদশ, দ্বাদশ এবং ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক ইত্তেফাক ১১ নভেম্বর ১৯৭১
দৈনিক যুগান্তর ১১ নভেম্বর ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১১ নভেম্বর ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
Comments