মুক্তিযুদ্ধ

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১: ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে’

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১১ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন যশোরে স্বাধীন বাংলাদেশের কোনো মুক্তাঞ্চলে প্রথমবারের মতো জনসভার আয়োজন করা হয়। ৬ ডিসেম্বর যশোর মুক্ত হওয়ার ৫ দিন পর যশোর শহরের টাউন হল মাঠে জনসভার আয়োজন করে আওয়ামী লীগ।

জনসভায় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, 'বাংলাদেশ সরকার যুদ্ধাপরাধী ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে গণহত্যাকারীদের বিচারের মুখোমুখি করবে। যারা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন, তারা নিজ নিজ ঘরবাড়ি ফিরে পাবেন। আমরা ৪টি রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। দলগুলো হলো- জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক পার্টি এবং নেজামে ইসলাম।'

জনসভায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'আমরা আমাদের সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছি। আজ যশোর যেমন মুক্ত, সমগ্র বাংলাদেশও তেমন মুক্ত হবে খুব শিগগির। আমাদের পরবর্তী কাজ হবে দেশ পুনর্গঠন করা।'  

জনসভা শেষে এদিন কলকাতায় ফিরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, 'বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য শিগগির সংবিধান রচিত হবে। জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত পাকিস্তান কোনো সবিধান তৈরি করতে পারেনি। কিন্তু আমরা সংবিধান রচনা করছি। ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য একটি ট্রাইব্যুনাল গঠিত হবে।'

 সাংবাদিকদের নানা প্রশ্নের জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন,'যদিও সরকারি সিদ্ধান্ত হয়নি, তবে ঢাকা শহরের নাম পরিবর্তন করে মুজিবনগর রাখা হতে পারে।'

ঢাকায় এদিন  

১১ ডিসেম্বর ভোর ৪টার দিকে আল বদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও  চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খানের নির্দেশে পিপিআইর প্রধান প্রতিবেদক   ও কলম্বিয়া ব্রডকাস্টিং সার্ভিসের প্রতিবেদক সৈয়দ নাজমুল হককে পুরানা পল্টনের বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায় আলবদর বাহিনী।

একই দিন ভোর ৬টার দিকে আল বদরের অপারেশন ইনচার্জ চৌধুরী মুঈনুদ্দীন ও  চিফ এক্সিকিউটর আশরাফুজ্জামান খানের নির্দেশে ৫-৬ জন সশস্ত্র আলবদর সদস্য দৈনিক পূর্বদেশের প্রধান প্রতিবেদক এএনএম গোলাম মুস্তাফাকে  গোপীবাগের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায়।

১১ ডিসেম্বর দুপুর ৩টা থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হয়। 

১১ ডিসেম্বর তেজগাঁও বিমানবন্দরে জাতিসংঘের অনুরোধে বিমান হামলা বন্ধ রাখে ভারতীয় বিমানবাহিনী।

১১ ডিসেম্বর তেজগাঁও বিমানবন্দরে পাকিস্তানি সমরাস্ত্র ও বিমান বিধ্বংসী কামান পরিদর্শন শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ  নিয়াজী বলেন, 'কোনো ক্রমেই শত্রুকে কাছে ঘেঁষতে দেয়া চলবে না। এখন আমাদের একমাত্র লক্ষ্য পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন 

১১ ডিসেম্বর ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র রোনাল্ড জিগলার বলেন, 'জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রস্তাব মেনে নেওয়া ভারত-পাকিস্তান উভয়ের জন্যই অত্যাবশ্যক। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এ ব্যাপারে নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা কিসিঞ্জারের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। যুদ্ধবিরতি ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।'

১১ ডিসেম্বর প্রভাবশালী সংবাদপত্র সানডে টেলিগ্রাফে গভর্নর মালিকের আত্মসমর্পণের একটি প্রস্তাব প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ডা. মালিক একটি প্রস্তাব ঢাকায় নিয়োজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করেছেন। রাও ফরমান আলী গভর্নরের পক্ষে ৫টি শর্তে আত্মসমর্পণের কথা জানিয়েছেন।

শর্তগুলো হলো- ১.পাকিস্তানি বাহিনী কেবল ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করবে। ২.মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কোনো লিখিত চুক্তি থাকবে না। ৩. যুদ্ধবন্দি ও ১ লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দিতে হবে। ৪. সব পাকিস্তানি সেনা যেন পাকিস্তানে ফিরে যেতে পারে সে বিষয়ে নিরাপত্তা দিতে হবে।  ৫. ৭০ এর নির্বাচনে যে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। 

কিন্তু ইয়াহিয়া খান জানামাত্র এ প্রস্তাব নাকচ করে দেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি পাকিস্তানকে সামরিক সহায়তা দেওয়ার অনুরোধ জানান।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১১ ডিসেম্বর খুলনা–যশোর পথে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে মিত্রবহিনীর খুলনা যাওয়া বন্ধ করে দেয় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। অবিরাম গোলাবর্ষণের ফলে ভারতীয় মিত্রবাহিনী ফুলতলায় অবস্থান নেয়।

১১ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় যৌথ বাহিনী বগুড়া-রংপুর মহাসড়কের মধ্যবর্তী গোবিন্দগঞ্জে শক্তিশালী হানাদার ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। সারারাত যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী ভোরের দিকে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়।

১১ ডিসেম্বর টাঙ্গাইল হানাদারমুক্ত হয়। জামালপুর ও ময়মনসিংহ থেকে পালিয়ে আসা হানাদার সেনারা সম্মিলিতভাবে টাঙ্গাইলে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ভারতীয় মিত্রবাহিনী টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, কালিয়াকৈর ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে ছত্রীসেনা নামিয়ে দেয়। আগের দিন রাতে টাঙ্গাইলের কাদেরিয়া বাহিনী মিত্রবাহিনীর সহায়তায় আক্রমণ চালালে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল সার্কিট হাউজে কাদেরিয়া বাহিনীর কমান্ডার কাদের সিদ্দিকীর কাছে আত্মসমর্পণ করে।  

১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর এক কোম্পানি ইপিসিএপি ও ২৪তম ফ্রন্টিয়ার ফোর্সের কিছু সেনার একটি ঘাঁটির উপর ক্যাপ্টেন গাফফারের নেতৃত্বে ৪র্থ বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধা দল আক্রমণ চালায়। এ সময় হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়।

১১ ডিসেম্বর ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটে প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর হানাদার বাহিনীর আরেকটি ব্রিগেডের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। এরপর তারা অস্ত্র ও গোলাবারুদ ফেলে টাঙ্গাইলের দিকে পালিয়ে যেতে শুরু করে।

১১ ডিসেম্বর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড দখল করার জন্য ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে যান। ভারতীয় মিত্রবাহিনীও চন্দ্রকান্তের মন্দিরে এসে পৌঁছে। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় মিত্র বাহিনী প্রবল আক্রমণ চালালে সীতাকুণ্ড ছেড়ে পালিয়ে যায় হানাদার বাহিনী।

১১ ডিসেম্বর কুমিল্লা সেনানিবাসে ভারতীয় বাহিনীর অবিরাম আর্টিলারি ফায়ারে হানাদার বাহিনী ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চান্দিনার দিকে পালিয়ে যায়।

১১ ডিসেম্বর চান্দিনার হারং উদালিয়ায় মুক্তিবাহিনীর ধাওয়ায় পালিয়ে যাওয়ার সময় ৬ হানাদার সেনা করতলা গ্রামের কেওড়াতলায় আটকে যায়। পরে হানাদার সেনাদের গুলিতে ২ মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৬ জন শহীদ হন। এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর গুলি শেষ হয়ে গেলে ৬ জন হানাদার সেনা গণপিটুনিতে নিহত হয়।

১১ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আশুগঞ্জ ছেড়ে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার আগে তারা ভৈরব ব্রিজ উড়িয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র ষষ্ঠ,  একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।

দৈনিক পাকিস্তান ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ১২ ডিসেম্বর ১৯৭১

সানডে টেলিগ্রাফ, ১১ ডিসেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Binimoy platform suspended by Bangladesh Bank

BB suspends Binimoy over irregularities

During the previous AL govt, it was developed by the IDEA under the ICT Division at a cost of Tk 65 crore.

10h ago