১৪ আগস্ট ১৯৭১: দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশনকে হারায় স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৪ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন কলকাতার রবীন্দ্রসরোবর স্টেডিয়ামে শরণার্থীদের সাহায্যে ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ও দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশনের মধ্যে এক প্রীতি ফুটবল ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। এই ম্যাচে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল ৪-২ গোলে দক্ষিণ কলকাতা স্পোর্টস ফেডারেশনকে পরাজিত করে।
ঢাকায় এদিন
১৪ আগস্ট ঢাকায় পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াতে ইসলামীর আমির গোলাম আজম বলেন, 'এবার শুধু তারাই স্বাধীনতা দিবস পালন করছে যারা পাকিস্তানকে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালবাসে। পাকিস্তানের ঘরে-বাইরে শত্রুর অভাব নেই। তবু এ কথা একশ ভাগ সত্য, পাকিস্তান টিকে থাকার জন্যই প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমরা পাকিস্তানকে অখন্ড রাখার জন্য সংগ্রাম করছি।'
ভারতে এদিন
১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আগে দেয়া এক বেতার ভাষণে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি বলেন, 'অভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্বে এখন বিশ্বাস করে তাদের উচিত বাংলার মানুষের পক্ষে দাঁড়ানো। তাদের হয়ে কথা বলা। সাড়ে সাত কোটি মানুষ এখন যে অবস্থায় আছে তা বিশ্বের প্রতিটি মানুষের জন্যই লজ্জাজনক।'
১৪ আগস্ট রাজ্যসভার অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, সম্প্রতি ভারত, সোভিয়েত চুক্তি নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস যে মন্তব্য প্রকাশ করেছে সেটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। তারা বলছে এই চুক্তি নাকি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে বাধা দেবে, আসলে এই ধরনের কোনো প্রস্তাবই চুক্তিতে নেই।
১৪ আগস্ট দিল্লিতে মার্কিন সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির চেয়ারম্যান সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে পারে বলে ভারত যে শঙ্কা প্রকাশ করেছে তা অমূলক নয়। পাকিস্তানের এমন আচরণ গ্রহণযোগ্য নয় এবং আঞ্চলিক শান্তির জন্য প্রচণ্ড হুমকিস্বরূপ। পাকিস্তানের উচিত শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা। একই সঙ্গে পূর্ব বাংলা থেকে আর যেন শরণার্থীরা ভারতের দিকে না আসে সেই লক্ষ্যে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।'
১৪ আগস্ট দিল্লিতে রাজ্যসভায় ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, 'বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানের পথ একটিই এখন তা হচ্ছে স্বাধীনতা। কারণ ওই দেশের জনগণ থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা সবার দাবি একটাই স্বাধীনতা। অন্যথায় তারা কোনো আলোচনায় আসতে রাজি নয়।'
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৪ আগস্ট পূর্ব জার্মানির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র এক বিবৃতিতে বলেন। 'শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক আদালতের নেওয়া পদক্ষেপে পূর্ব জার্মানি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। এই ধরনের পদক্ষেপ আঞ্চলিক শান্তির জন্য হুমকিস্বরূপ। আমাদের জনগণ পাকিস্তান সরকারের কাছে জনগণের নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি ন্যায়বিচার, মানবিকতা ও শ্রদ্ধা জানানোর আবেদন জানাচ্ছে এবং একই সঙ্গে পাকিস্তানের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সামরিক আদালতের বিচারকার্য বন্ধ করার মাধ্যমে পাকিস্তানে বিদ্যমান সংঘাতের একটি শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান বের করার জন্য পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানাচ্ছে।'
১৪ আগস্ট ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তায় ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং সাংবাদিকদের বলেন, 'ভারত ও ইন্দোনেশিয়া দুই দেশই পূর্ব বাংলায় শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে একমত এবং একই সঙ্গে আমরা দুই দেশই শরণার্থী সমস্যা নিয়ে অধিকতর আলোচনা করবো। আমরা চাই শরণার্থীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করা।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
১৪ আগস্ট ব্রিটিশ গণমাধ্যমে ডেইলি টেলিগ্রাফ এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলে, 'শেখ মুজিবুর রহমান এখনো জীবিত আছে কিনা এজন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জবাব দিতে হবে। একই সঙ্গে তার বিরুদ্ধে সমস্ত মামলা প্রত্যাহার করতে হবে। কারণ কোনো সভ্য দেশে একজন সংখ্যাগরিষ্ঠ গনপ্রতিনিধি জয়লাভ করার ফলে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা প্রদান করা সম্ভব না।'
১৪ আগস্ট কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় 'মুজিবের সমর্থনে 'নয়াদিল্লির আইনজীবী পাকিস্তানে যেতে চান' শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, 'সুপ্রিমকোর্টের একজন আইনজীবী পাকিস্তানে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে আজ পাক হাইকমিশনারের কাছে তার ভিসা দাখিল করেছেন। লায়ালপুরের পাক সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুরের বিচার হচ্ছে সেখানে তার কৌঁসুলী হিসেবে কাজ করার জন্য ওই আইনজীবী পাকিস্তানে যেতে চেয়েছেন।'
১৪ আগস্ট দৈনিক যুগান্তরে 'বাংলাদেশের স্বীকৃতির দিন কি পিছিয়ে গেল?' শিরোনামে একটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। এই সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'সংসদের বাজেট অধিবেশন সমাপ্ত। শেষের দিনগুলো নাটকীয় উত্তেজনায় ভরা। সংবিধান সংশোধন বিল এবং ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি পেয়েছে সদস্যদের অকুণ্ঠ সমর্থন। এই দুটি দলিল জাতীয় জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি দূর করবে সমাজতান্ত্রিক অগ্রগমনের পথে আইনগত বাধা। দ্বিতীয়টি বাড়াবে ভারতের নিরাপত্তাবোধ। ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি যুদ্ধবাজদের সামনে চরম হুঁশিয়ারি। কিন্তু এই চুক্তিতেই রয়েছে একটি বিরাট বাধা। যুক্ত ইস্তাহারে ভারত সোভিয়েত সমভাবেই চেয়েছে বাংলাদেশের সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান। কিন্তু এই সমাধান এবং তার উপায় অস্পষ্ট। এখন যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হোক না তা অবশ্যই সোভিয়েত রাশিয়ার সমর্থন এবং অনুমোদন সাপেক্ষে। তাতে হয়ত পিছিয়ে যাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের সময়।'
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৪ আগস্ট নওগাঁর ধামইরহাটের সীমান্তবর্তী কুলফৎপুর গ্রামে পাকিস্তানি হানাদারবাহিনী ১৮ জন কৃষককে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্র্যাশ ফায়ার করে হত্যা করে। এসময় ঘটনাস্থলেই শহীদ হন তজুমুদ্দীন, বিজুমুদ্দীন, আব্বাস আলী, রহিমউদ্দীন, ফয়জুল ইসলাম,আফতাবউদ্দীন, তায়েজউদ্দীন, ছয়েফউদ্দীন, কছিমুদ্দীন, আমজাদ হোসেন, চানমুদ্দীন, অবিরউদ্দীন, মতিবুল ইসলাম ও আবেদ আলী নামের ১৪ জন কৃষক। চার জন প্রাণে বেঁচে যান। হানদাররা চলে গেলে গ্রামবাসী ১২ জন শহীদকে সমাধিস্ত করেন।
১৪ আগস্ট নরসিংদীর ঘোড়াশালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল ঝিনারদি রেলওয়ে স্টেশনের নিকটবর্তী একটি গ্রামে লুটতরাজ করতে এলে মুক্তিবাহিনীর একদল গেরিলা তাদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এসময় প্রায় তিন ঘণ্টা যুদ্ধের পর দুটি মরদেহ ও কয়েকটি আহত সৈন্যকে ফেলে নরসিংদীর দিকে পালিয়ে যায়।
১৪ আগস্ট নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাটের কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদারদের উপর অ্যামবুশ করে। এসময় মুক্তিবাহিনীর হামলায় একটি জিপ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়। এসময় ৩০ জন হতাহত হয়। এই সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী নুরুন্নবী গুরুতর আহত হন।
১৪ আগস্ট নওগাঁর মহাদেবপুরের হাপুনিয়া মহাসড়কে মুক্তিবাহিনীর পেতে রাখা একটি শক্তিশালী ডিনামাইটের বিস্ফোরণে হানাদার বাহিনীর একটি জিপ ধ্বংস হয়। এ সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ৫ জন সৈন্য নিহত হয়।
১৪ আগস্ট চাঁপাইনবাবগঞ্জের ৭ নম্বর সেক্টরের মেহেদিপুর সাব-সেক্টরে সুবেদার মেজর মজিদের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর কানসাট অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। এ হামলায় বেশ কয়েকজন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।
১৪ আগস্ট চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার ইলিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মীরেরসরাই হয়ে চট্টগ্রাম শহরে আসার পথে মিয়াজান ঘাটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অতর্কিত হামলার মুখে পড়ে। এসময় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ ও গোলাগুলি হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৫ সৈন্য নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।
১৪ আগস্ট কুমিল্লার মাঝিগাছায় অবস্থানরত পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দলের উপর আক্রমণ চালায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল। এসময় ১০ হানাদার সৈন্য নিহত হয় এবং অনেকে আহত হয়।
সূত্র-
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র পঞ্চম, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড।
দৈনিক যুগান্তর, ১৪ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ১৪ আগস্ট ১৯৭১
দৈনিক পাকিস্তান, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]
Comments