১৫ আগস্ট ১৯৭১, শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের পরিণতি হবে ভয়াবহ: পিয়েরে ট্রুডো

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৫ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রভাবশালী ব্রিটিশ দৈনিক 'দ্য টাইমস' পত্রিকায় প্রখ্যাত ব্রিটিশ আইনজীবী ডব্লিউ টি উইলিয়ামের একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে উইলিয়াম বলেন, 'যেভাবে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গোপন বিচার প্রহসন শুরু হয়েছে, তাতে আমি ও বিশ্বের বিবেকসম্পন্ন সব মানুষ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যেভাবে এই তথাকথিত বিচার চলছে তাতে কোনোক্রমেই শেখ মুজিবুর রহমানের ন্যায় বিচার আশা করা যেতে পারে না। একমাত্র প্রাণের ঝুঁকি ও বহু ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি ছাড়া কোনো বাঙালি কৌঁসুলি শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ সমর্থনে যাবেন না। আইয়ুব খানের আমলে সুপ্রিম কোর্টের রায় লঙ্ঘন করে সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু করেছিল। যার তীব্র পরিণতি আইয়ুব খান ভোগ করেছেন। ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা ঠিক সেই একই ধারাবাহিকতায় বর্তমান বিচারে প্রহসন শুরু করেছে। পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসন যদি মূর্খতার বশে এই ধরনের মিথ্যা অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানকে শাস্তি প্রদান করে, তবে তার পরিণতি হবে প্রচণ্ড ভয়াবহ। পাকিস্তানের উচিত এই ধরনের আত্মঘাতীমূলক উদ্যোগ থেকে সরে আসা।'
দেশব্যাপী এদিন
১৫ আগস্ট চট্টগ্রাম, মোংলা, চাঁদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও দাউদকান্দি নদীবন্দর আক্রমণের উদ্দেশ্যে নৌ-কমান্ডোরা লিম্পেট মাইন নিয়ে অপারেশন জ্যাকপট সফলভাবে পরিচালনার জন্য অবস্থান নেন। আক্রমণের সুস্পষ্ট নির্দেশ পেয়ে অপেক্ষমাণ নৌ-কমান্ডোরা এদিন সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে জোয়ার-ভাটার সময় নিশ্চিত হয়ে সন্ধ্যার পর বন্দরে অবস্থানরত অস্ত্রশস্ত্র ও পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সামরিক সরঞ্জামাদিবাহী জাহাজগুলো ধ্বংসের লক্ষ্যে যাত্রা শুরু করেন।
ভারতে এদিন
১৫ আগস্ট মার্কিন সিনেটের উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি নয়াদিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ ও শরণার্থী পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠক করেন।
পাকিস্তানে এদিন
১৫ আগস্ট পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্টের বিবৃতির তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলে, শেখ মুজিব দেশ ও জাতির শত্রু। তার বিচার সম্পূর্ণভাবে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। শেখ মুজিবের বিচারে নাক গলিয়ে জাতিসংঘ তার সীমা ছাড়িয়ে গেছে। এই ধরনের বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয়। শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার আইন মেনেই হচ্ছে। এখানে দ্বিমত করার কোনো সুযোগ নেই।
আন্তর্জাতিক মহলে এদিন
১৫ আগস্ট কানাডার প্রধানমন্ত্রী পিয়েরে ট্রুডো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছে এক তারবার্তায় শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসনে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, 'শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের পরিণতি হবে ভয়াবহ।'
১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কয়ারে পাকিস্তানের দূতাবাসের উদ্যোগে এক প্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রতিবাদ সমাবেশে বেশ কয়েকজন বাঙালিও অংশ নিয়েছিলেন। সমাবেশে উপস্থিত বক্তারা বলেন, পাকিস্তানকে বিভক্ত করার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের এখন ভারত আশ্রয় দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী প্রকাশ্যে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। লেবার পার্টির এমপিরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ক্রমাগত মিথ্যাচার ও বিষোদগার ছড়িয়েই যাচ্ছেন।
১৫ আগস্ট ট্রাফালগার স্কয়ারে পাকিস্তানের দূতাবাসের সমাবেশের প্রতিবাদে অ্যাকশন বাংলাদেশ সংগঠন মার্কিন দূতাবাসের সামনে আরেকটি প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে। এই প্রতিবাদ সমাবেশে বিভিন্ন ফটোগ্রাফ ও ভিডিওচিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে চলমান গণহত্যার চিত্র দেখানো হয়।
১৫ আগস্ট পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হামিদুল হক চৌধুরী লন্ডনে বলেন, 'যারা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন, তারা মীর জাফরের মতোই ভুল করছেন। মীর জাফর বাংলার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল।'
১৫ আগস্ট ব্রিটেনের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক আইনজীবী সংস্থাও শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের জন্য ইয়াহিয়ার বর্বর সামরিক চক্রের কঠোর সমালোচনা করেন।
১৫ আগস্ট ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে বিচারের বিষয় বলেন, 'ব্রিটিশ ও ভারতীয় আইনেই তার বিচার হচ্ছে। বিচারে তার যে শাস্তিই হোক না কেন, তা ক্ষমা করার একমাত্র ক্ষমতা প্রেসিডেন্টের থাকবে। এখন পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভারত সরকার আশ্রয় দিচ্ছে।'
১৫ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত ভারতের রাষ্ট্রদূত লক্ষ্মীকান্ত ঝা একই টেলিভিশনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'আমার আশ্রয় শব্দটি নিয়ে আপত্তি আছে। কারণ সীমান্ত পেরিয়ে সশস্ত্র অবস্থায় যারা পূর্ব বাংলা থেকে এসেছে, তাদেরকে নিরস্ত্র করা হবে না। আর বহু জায়গায় ভারত সুনির্দিষ্টভাবে পর্যবেক্ষণও করতে পারছে না।'
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন
১৫ আগস্ট 'সানডে টেলিগ্রাফ' পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১১ আগস্ট লায়ালপুরের এক সার্কিট হাউজে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়েছে। এই বিচারের জন্য এক ব্রিগেডিয়ার জেনারেলকে দিয়ে তিন সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ সামরিক আদালতে তার বিচার হবে। ১৩ আগস্ট মামলার শুনানি দুই দিনের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগে বলা হয়েছিল- তিনি ভারতে যোগসাজশে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলে দেশকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এখন পর্যন্ত তার বিচারে আনিত অন্য অভিযোগের পেছনের কারণ জানা যায়নি।
১৫ আগস্ট 'ওয়াশিংটন পোস্ট' পত্রিকায় প্রকাশিত এক সম্পাদকীয়তে বলা হয়, মিথ্যা অভিযোগ তুলে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার প্রহসন শুরু করে পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন সামরিক জান্তা এক মারাত্মক ভুল করেছে। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যদি এই তথাকথিত বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড দেয়, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে মারাত্মক ভুল, আর সেই ভুলের কোনো সংশোধনের পথ থাকবে না।
১৫ আগস্ট প্রভাবশালী ব্রিটিশ পত্রিকা 'দ্য অবজারভার'-এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হলেও তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করতে পারবে না পাকিস্তান। কারণ তিনি প্রচণ্ড জনপ্রিয় এবং একইসঙ্গে এককভাবে পাকিস্তানের ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানকে যদি মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়, তবে পাকিস্তানের ইতিহাসে এটি হবে চরমতম ভুল এবং পাকিস্তান এর ফলাফল দীর্ঘকাল ভোগ করবে। অন্যদিকে, পূর্ব বাংলায় ইয়াহিয়া খান নিপীড়নমূলক যে ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন, তা এখন কেবল পাকিস্তানকে আরও শূন্যের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ও তীব্র আশঙ্কা রয়েছে।
দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ
১৫ আগস্ট রাতে মেজর গিয়াসের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল রাজশাহী- চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডের গুরুত্বপূর্ণ হরিপুর ব্রিজের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়, এসময় মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ১২ জন পাকিস্তানী হানাদার ও রাজাকারকে আটক করেন। রাজশাহী এবং নবাবগঞ্জের মধ্যকার যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
১৫ আগস্ট মুক্তিবাহিনীর একটি দল চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে তিন ইঞ্চি মর্টার দিয়ে প্রায় কয়েক ঘণ্টা ধরে গোলাবর্ষণ করে। এসময় পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর স্থানীয়ভাবে আয়োজিত স্বাধীনতা দিবস উদযাপন পণ্ড হয়ে যায়।
১৫ আগস্ট দুই নম্বর সেক্টরে মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা হানাদার বাহিনীর রসদ বোঝাই দুটি নৌকাকে ব্রাহ্মণপাড়া থেকে নয়ানপুর যাবার পথে অতর্কিত আক্রমণ করে। এই আক্রমণে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রসদ বোঝাই নৌকা দুটি বিধ্বস্ত হয়ে পানিতে ডুবে যায় এবং ১১ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।
১৫ আগস্ট কুমিল্লায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল হোমনা থানার ওপর অতর্কিত আক্রমণ করে। এসময় থানার ভেতরে থাকা পাকিস্তানী পুলিশ ও সেনারা আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এসময় দুই পক্ষের মধ্যে দুই ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ হয়। একপর্যায়ে হানাদার বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এই যুদ্ধে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ১০ জন সৈন্য নিহত হয় ও ১৪ জন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী হয়।
১৫ আগস্ট সন্ধ্যায় জামালপুরের কামালপুরে মেজর আবু তাহেরের নেতৃত্বে ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কামালপুর বিওপির ওপর তীব্র আক্রমণ চালায়। দুই ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১৫-১৬ জন সৈন্য নিহত হয়। এসময় মুক্তিবাহিনীর ১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।
সূত্র:
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ-দলিলপত্র, সপ্তম, দশম, দ্বাদশ, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ খণ্ড
দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ১৬ আগস্ট ১৯৭১
দ্য অবজারভার, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
সানডে টেলিগ্রাফ, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
দ্য টাইমস, ১৫ আগস্ট ১৯৭১
আহমাদ ইশতিয়াক
Comments