১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১: বিজয়ের ঘোষণা দেন মেজর হায়দার

ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১৭ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল এক দিন। এ দিন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতির উদ্দেশ্যে এক ভাষণে বলেন, 'এখন আমাদের সময় এসেছে যুদ্ধোত্তর দেশ পুনর্গঠনের সরকার হিসেবে কাজ করার।'

তিনি আরও বলেন, 'বাংলাদেশ সরকার নতুন সংবিধান প্রণয়নের কাজ শুরু করেছে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।'

সেদিন বেতারে এক ভাষণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'দেশের জনগণকে দেশ পুনর্গঠন করতে হবে। জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবে রূপান্তরের কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হবে আমাদের সকলকে।'

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের সাধারণ জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ভাষণে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, 'বাংলাদেশের মানুষ কোনদিন ভারতের উদার সাহায্য ও সমর্থনের কথা ভুলবে না। আমরা আশা করছি, শীঘ্রই শরণার্থীরা বাংলাদেশে ফিরে আসতে পারবেন। আমরা আশা করি, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা আমাদের মাঝে ফিরে পাবো। তাঁর মুক্তির জন্য আমি বিশ্বমহলের কাছে আবেদন জানাচ্ছি।'

ঢাকায় এদিন

১৭ ডিসেম্বর সকাল ৮টা ১০ মিনিটে বেতারে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ফতেহ চৌধুরী বাংলায় এক ঘোষণায় বলেন, 'কিছুক্ষণ পর মেজর হায়দার একটি ঘোষণা পাঠ করবেন।'

সেদিন সন্ধ্যায় ৭টায় দেড় ঘণ্টার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে সম্প্রচার শুরু হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনের। সকাল ৮টা ১৫ মিনিটে বেতারে প্রথমবারের মতো বিজয়ের ঘোষণা দেন মেজর হায়দার। সেসময়ে মেজর হায়দার প্রথমবারের মতো টেলিভিশনে আনুষ্ঠানিক বিজয়ের ঘোষণা দেন।

বিজয়ের ঘোষণায় মেজর হায়দার বলেন, 'প্রিয় দেশবাসী, আমাদের প্রিয় দেশকে মুক্ত করা হয়েছে। আমাদের দেশ এখন মুক্ত। আপনারা সবাই এখন মুক্ত বাংলাদেশের নাগরিক।  সকল গেরিলার প্রতি আমার নির্দেশ—আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। কোথাও যেন আইন ও শৃঙ্খলা বিনষ্ট না হয়। লুটপাট বন্ধ করতে হবে। এলাকায় এলাকায় পাহারার ব্যবস্থা করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার দেশে ফিরে দায়িত্ব না নেবেন, ততদিন পর্যন্ত গেরিলাদের যার যার এলাকায় আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। জনগণের প্রতি আমার আবেদন, আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা করুন। আলবদর, আলশামস, রাজাকার ও দালালদের ধরিয়ে দিন। নিজ হাতে আইন তুলে নেবেন না।'

১৭ ডিসেম্বর ঢাকায় ধানমণ্ডির ৬১৩ নম্বর বাড়িতে ভারতীয় সাংবাদিকদের দেওয়া সাক্ষাৎকারে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব ২ মেয়েকে পাশে রেখে চোখ মুছতে মুছতে বলেন, 'এতদিনে আমরা প্রাণ ফিরে পেলাম। আর তা পেলাম ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের জন্যই। কোনদিন ভাবতেও পারিনি এতো শিগগির এইভাবে মুক্তি পাবো। আমি কি করে ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবো তার ভাষা পাচ্ছি না। আমার নিজের বাড়িতেও আমি স্বাচ্ছন্দ্যে চলাফেরার কোন স্বাধীনতা পাইনি। অষ্টপ্রহর সেখানে হায়েনাদের মেশিনগান উঁচিয়ে রাখা। আমি নিজ বাড়ি থেকে বের হতে না পারলেও আত্মীয়স্বজন আমাদের দেখতে আসতো। গত ৯ মাস এভাবেই আমাদের বন্দী জীবন কেটেছে।'

১৭ ডিসেম্বর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে পিটিআইয়ের এক সাংবাদিককে অধুনালুপ্ত পূর্ব পাকিস্তানের সাবেক গভর্নর ডা. এম এ মালিক বলেন, 'যুদ্ধ শেষ হওয়ায় আমি খুশি হয়েছি। আমি নতুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য শুভকামনা করি। আমার কপালে কী আছে জানি না। বাংলাদেশের নতুন সরকারই তা ঠিক করবেন।'

'আপনি পাকিস্তানি জঙ্গিশাহির গভর্নর হতে গেলেন কেন?'- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'এই প্রশ্নের উত্তর আমি দেব না।' ঠিক এমন সময় তার স্ত্রী তাকে টেনে নিয়ে চলে যান।

সংবাদপত্রে এদিন

১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদী পত্রিকায় 'জয় বাংলা বাংলার জয়' শিরোনামে প্রধান প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এটিই ছিল বাংলাদেশের কোনো গণমাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের প্রথম কোনো ঘোষণা।

১৭ ডিসেম্বর আনন্দবাজার পত্রিকার প্রধান প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল, 'পাকিস্তান নত, বাংলাদেশ মুক্ত'।

কলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক যুগান্তরে 'নিয়াজির নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ, বৃহস্পতিবার ঢাকায় দলিল স্বাক্ষর' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। সেদিন এর নেমপ্লেটের জায়গায় এই শিরোনামটি করা হয়েছিল। পত্রিকার নাম ছাপা হয়েছিল ডান দিকে শিরোনামের  একপাশে।

ভারতে এদিন

১৭ ডিসেম্বর ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, 'গত ১৪ দিনে ভারতের মোট ২ হাজার ৩০৭ সৈন্য নিহত হয়। অপরদিকে হতাহত হয়েছেন ১০ হাজার ৬৩৩ জন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১৭ ডিসেম্বর পিকিংয়ে এক নৈশভোজে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বলেন, 'পাকিস্তানের আজকের পরিস্থিতির জন্য সোভিয়েত ইউনিয়ন দায়ী। তাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সামরিক আগ্রাসন চালিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের পতনের মধ্য দিয়ে দক্ষিণ এশিয়া ও উপমহাদেশে নিয়মিত যুদ্ধের সূচনা হলো। ভারতীয়দের পরাজয়ও এর মধ্য দিয়ে সুনিশ্চিত হবে।'

সেসময় চীনের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদে তৎক্ষণাৎ অনুষ্ঠানস্থল ছেড়ে বেরিয়ে চলে যান চীনে নিযুক্ত সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, চেক প্রজাতন্ত্র, স্লোভাকিয়া, পূর্ব জার্মানি, মঙ্গোলিয়াসহ ৬ দেশের রাষ্ট্রদূত।

১৭ ডিসেম্বর চীন সরকারের এক মুখপাত্র বলেন, 'ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যে আক্রমণ চালিয়েছে তার সঙ্গে শুধু ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেক স্লোভাকিয়া আক্রমণ ও দখলের তুলনা চলে। গত আগস্ট মাসে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের মধ্যে যে মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে আদতে তা ছিল সামরিক চুক্তি। ভারত-পাকিস্তান বিরোধের জন্য সোভিয়েত সরকার হাস্যকরভাবে চীনকে দায়ী করেছে। আসলে সোভিয়েত সরকারই এশিয়ার এক দেশের বিরুদ্ধে আরেক দেশকে লেলিয়ে দিচ্ছে। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলো আক্রমণকারীদের সঙ্গে আক্রমণবিরোধীদের প্রতিরোধ। এই যুদ্ধে চীন পাকিস্তানকে সব ধরনের সাহায্য দিয়ে যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়ন এখনো আন্তর্জাতিকভাবে ভারতের সব ধরনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিয়েছে।'

চীনা মুখপাত্রের এই বিবৃতিতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের কথা বলা হয়নি।

আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রে এদিন

১৭ ডিসেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক দ্য নিউইয়র্ক টাইমস এ 'পূর্ব পাকিস্তানে আত্মসমর্পণের পর ভারত উভয় ফ্রন্টে যুদ্ধ বিরতির নির্দেশ দিয়েছে' শিরোনামে প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর  আত্মসমর্পণের কথা উঠে আসে।

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

১৭ ডিসেম্বর খুলনা হানাদার মুক্ত হয়। সেদিন সার্কিট হাউজ ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে  ব্রিগেডিয়ার হায়াত খানের নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এর আগে  ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করলেও হায়াত খান তা মেনে নেননি। তিনি তার অধীনস্থ বাহিনীকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছিলেন। সেসময় পাকিস্তানি বাহিনীর ট্যাংক রেজিমেন্ট ও ৪ হাজার সৈন্যের সঙ্গে মেজর মঞ্জুরের নেতৃত্বে শুরু হয় মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক যুদ্ধ হয়। সারারাত ধরে চলা ভয়াবহ যুদ্ধে প্রবল ক্ষয়ক্ষতির মুখে এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়।

সেদিন ভোরে শিরোমণি নসু খানের ইটভাটার পাশে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে হানাদার বাহিনী। শুক্রবার জুমার নামাজের পর বেলা দেড়টার দিকে খুলনা সার্কিট হাউস মাঠে লিখিত আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠিত হয়।

৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর ও ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর এম এ জলিল, মিত্রবাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল দলবীর সিংয়ের কাছে পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার হায়াত খান বেল্ট ও ব্যাজ খুলে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর করেন।

১৭ ডিসেম্বর ভোরে বিনা প্রতিরোধে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে মুক্তিবাহিনী। এরপর সকাল ৯টার কিছুক্ষণ পর চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা তোলা হয়। এর আগে ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় ভাটিয়ারীর দিকে একটি ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত করে গিয়েছিল। পরে সারা রাত ধরে সড়ক তৈরি করে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ভোরের দিকে চট্টগ্রামে প্রবেশ করে।

তথ্সূযত্র

লাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র তৃতীয়, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

ব্রেভ অব হার্ট/ হাবিবুল আলম (বীরপ্রতীক)

দৈনিক যুগান্তর, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক আনন্দবাজার, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক আজাদী, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক: [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Promises on paper, pollution in reality

Environment Adviser Syeda Rizwana Hasan’s admission of failure to stop rampant stone extraction in Sylhet’s Jaflong may be honest, but it highlights her glaring limitations as an administrator.

12h ago