১৯ নভেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান পালিত হয়েছিল ১৯ নভেম্বর। দিনটি ছিল শুক্রবার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজকের পর্বে রইল ২৯ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান পালিত হয়েছিল ১৯ নভেম্বর। দিনটি ছিল শুক্রবার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান নওগাঁর রাণীনগর থানার বড়বড়িয়া গ্রামে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ৫ মুক্তিযোদ্ধাসহ ৭ জন মুক্তিকামী মানুষ। 

এর আগে, মুক্তিবাহিনীর একটি দল বড়বাড়িয়া গ্রামে অবস্থান করেছিল। স্থানীয় রাজাকারদের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে জানতে পেরে অপারেশন চালিয়ে ৫ মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৭ জনকে আটক করে পৈশাচিক নির্যাতনের পর নৃশংসভাবে হত্যা করে।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান কুড়িগ্রাম মহকুমার নাগেশ্বরী থানার চর বেরুবাড়ি ইউনিয়নে পৈশাচিক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১৮ জন নিরীহ সাধারণ মানুষ।

এর আগে, রমজান মাসের শুরুর দিকে রাজাকার ও ইপিক্যাফের একটি দল চর বেরুবাড়িতে আসে। এরপর তারা গ্রামের নিরীহ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার ছিনিয়ে নেয়। একইসঙ্গে গ্রামবাসীদের মধ্যে কয়েকজনের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায়। তখন গ্রামবাসীদের কাছে খবর পেয়ে কোম্পানি কমান্ডার নান্নু মিয়ার নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালালে রাজাকাররা পালিয়ে যায়। এরপর মুক্তিযুদ্ধে রমজান মাসের শেষ দিন অর্থাৎ ২৯ রমজান রাজাকাররা নাগেশ্বরী থেকে পাকিস্তানি হানাদার সেনাদের সঙ্গে নিয়ে আবার বেরুবাড়িতে আসে। প্রথম তারা বাড়ি বাড়ি ঢুকে লুটপাট চালিয়ে অগ্নিসংযোগ করে প্রায় দেড়শর মতো বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়। এসময় তারা বাড়ি বাড়ি গিয়ে নারীদের শারীরিক নির্যাতন চালায় এবং মুক্তিবাহিনীর চর সন্দেহে গ্রাম থেকে বিভিন্ন বয়সের ২৫০ জনকে বেরুবাড়ি বাজারে ধরে নিয়ে আসে। পরে ১৮ জনকে বেরুবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনে এনে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। আটককৃত বাকিদের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের ডালিম হোটেল ছিল এক মৃত্যুপুরী। চট্টগ্রাম ছাত্র সংঘের সভাপতি মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আন্দরকিল্লার মহামায়া ভবনে স্থাপিত হয়েছিল টর্চার সেল ও ডিটেনশন সেন্টার।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান দুপুর ২টার দিকে মীর কাসেম আলীর নির্দেশে আলবদর বাহিনী ও পাকিস্তানি হানাদার সেনারা চট্টগ্রামের বাকলিয়ার চাক্তাই এলাকা ঘিরে লুৎফর রহমান ফারুক ও সিরাজকে অপহরণ করে ডালিম হোটেলে তুলে আনে। এরপর ২ জনের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন চালায় আলবদর বাহিনী। 

মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গণে ২৯ রমজান

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর শক্ত অবস্থান রায়গঞ্জ দখল করতে গিয়ে শহীদ হন লেফটেন্যান্ট আবু মঈন আশফাকুস সামাদ। এর আগে, ২৪ রমজান ভূরুঙ্গামারী থেকে পিছু হটে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট রায়গঞ্জ সেতুর পাশে ঘাঁটি তৈরি করে। এ ঘাঁটিটি দখল করতে ২ দফা রেকি করে ২৯ রমজান রাতে আক্রমণের ক্ষণ চূড়ান্ত করা হয়। 

২৯ রমজান রাত ৯টার দিকে লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ, লেফটেন্যান্ট আবদুল্লাহ ২ গ্রুপ কমান্ডো নিয়ে রায়গঞ্জ দখলের উদ্দেশ্যে ৬ নম্বর সেক্টরের ভুরুঙ্গামারি সাব সেক্টর থেকে রওনা দেন।

পরদিন ঈদ থাকায় এদিন ছিল চাঁদরাত। সোয়া ১ ঘণ্টা যাত্রার পর রাত সাড়ে ১১টার দিকে মুক্তিযোদ্ধারা ফর্মিং আপ প্লেসে আসা মাত্রই ক্ষুদ্র অসতর্কতার জন্য পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে যায়। তারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থান নিজেদের আর্টিলারি ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণের আওতায় নিয়ে আসে।

রায়গঞ্জ ব্রিজের কাছাকাছি পৌঁছে লেফটেন্যান্ট আশফাকুস সামাদ পাকিস্তানিদের ফাঁদে আটকা পড়েছেন বুঝতে পেরে শিস দিয়ে সহযোদ্ধাদের সংকেত জানিয়ে শুয়ে পড়তে বলেন। এরপর ওয়্যারলেস চালু করে লেফটেন্যান্ট আব্দুল্লাহর উদ্দেশ্যে হ্যালো বলতেই পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থানে  হঠাৎ বিস্ফোরণের শব্দ হয়। সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠে পাকিস্তানি আর্টিলারি। হানাদারদের তীব্র আক্রমণে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে আশফাকুস সামাদ জোর গলায় বলেন, 'কেউ এক ইঞ্চিও পিছু হটবে না। মরলে সবাই মরব। বাঁচলে সবাই বাঁচব।' হানাদারদের ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়েও প্রাণপণে চেষ্টা চালিয়ে যান মুক্তিযোদ্ধারা। 

তখন পাকিস্তানি বাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্য পজিশন পাল্টে ২০০ গজ পেছনে সরে একটি বাঁশঝাড়ের কাছে মেশিনগান স্থাপন করে  আশফাকুস সামাদ সহযোদ্ধা সুবেদার আরব আলীসহ মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানীদের আর্টিলারি ফায়ারের বাইরে যেতে নির্দেশ দিলেন। একপর্যায়ে ভারতীয় আর্টিলারির সহায়তা চেয়ে তুমুল ফায়ার চালিয়ে যান আশফাকুস সামাদ। এসময় গোলার আলোতে আশফাকুস সামাদের অবস্থান ধরে ফেলে হানাদার বাহিনী। তার অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করলে শহীদ হন আশফাকুস সামাদ।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান সাদেক হোসেন খোকার নেতৃত্বে রফিকুল হক নান্টু, ইকবাল আহমেদ সুফি ও আমসল লস্করসহ গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ঢাকা শহরের শান্তিনগরে পাকিস্তান চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা বিভাগের অফিসে বোমা হামলা চালায়। এদিন গেরিলাদের আরেকটি দল মতিঝিলে বোমা বিস্ফোরণ করে কয়েকটি গাড়ি ধ্বংস করে। একইদিন অন্য আরেকটি গেরিলা দল ডেমরায় একটি প্যাকেজিং কারখানায় বিস্ফোরণ ঘটায়।

ধামঘর ছিল সাতক্ষীরা মহকুমার একটি গ্রাম। ৮ নম্বর সেক্টরের ভোমরা সাব সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত এই গ্রামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর টহল দলের নিত্য আনাগোনা ছিল। ২৯ রমজান দুপুর ৩টার দিকে আচমকা মুক্তিবাহিনীর একটি পেট্রোল দলের সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয় হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের একটি টহল দলের। ২ পক্ষের মধ্যে চলা যুদ্ধে একজন হানাদার সেনা ও ২ রাজাকার নিহত হয়।

৩ নম্বর সেক্টরের গাজীপুর মহকুমার কালিয়াকৈর থানায় গাজীপুর টাঙ্গাইল সড়কের পাশেই গজারিয়াপাড়া সেতুর অবস্থান। মুক্তিযুদ্ধে ২৯ জুন মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার আব্দুল গফুর ও কমান্ডার খোরশেদ আলমের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গজারিয়াপাড়া সেতুতে প্রথম বিস্ফোরণ ঘটিয়ে কিছুটা যোগাযোগের অনুপযোগী করে দেয়। পরবর্তীতে হানাদার বাহিনী সেতুটিকে যোগাযোগের উপযোগী করে পুরো সেতু জুড়ে টহল ব্যবস্থা চালু করে।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান সুলতান ও কমান্ডার রঞ্জুকে গজারিয়াপাড়া সেতু ও সুত্রাপুর সেতু ধ্বংসের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এদিন রাতে কমান্ডার সুলতান ও কমান্ডার মঞ্জুর দল গজারিয়াপাড়া সেতুতে বিস্ফোরক লাগিয়ে সেতুটি পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়। গজারিয়াপাড়া সেতু ধ্বংসের পর মুক্তিযোদ্ধারা আধা মাইল এগিয়ে সুত্রাপুর সেতু দখলের জন্য এগিয়ে যান। এসময় সুত্রাপুর সেতুতে রাজাকারদের বড় একটি দল পাহারারত ছিল। রাজাকারদের সঙ্গে সংক্ষিপ্ত গুলিবিনিময় হয় মুক্তিযোদ্ধাদের। একপর্যায়ে রাজাকাররা টিকতে না পেরে পালাতে শুরু করলেও মুক্তিযোদ্ধারা ৩০ জন রাজাকারকে আটক করে সেতুর দখল নেন।

মুক্তিযুদ্ধে ২৯ রমজান টাঙ্গাইলের মীর্জাপুরের মহিষবাথান সেতু ধ্বংস করেন মুক্তিযোদ্ধারা। এই সেতু ও তৎসংলগ্ন এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর টহল দল নিয়মিতই টহল দিত। এদিন মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর যাতায়াত বন্ধ করার জন্য এই সেতু ধ্বংসের পরিকল্পনা করে। পরে হানাদারদের একটি দল টহল শেষ করে ফিরে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত সেতুটি ধ্বংস করে গুঁড়িয়ে দেন।

একইদিন টাঙ্গাইল-মীর্জাপুর সড়কে কোদালিয়া সেতুতে রাজাকার ও মিলিশিয়াদের ওপর আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। কোদালিয়ায় ছিল হানাদারদের শক্ত অবস্থান। ২৯ রমজান বিকেল ৪টার দিকে পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়ক দিয়ে নিজেদের সুবিধামত স্থান নিয়ে নেন। পূর্বের দিনের মতো এদিনও পাকিস্তানি বাহিনীর ২ কোম্পানি সেনা ঢাকা টাঙ্গাইল সড়কে টহল দিচ্ছিল। তবে তারা মুক্তিযোদ্ধাদের দেখেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি। ইফতারের কিছুক্ষণ আগে হানাদার সেনারা পাকুল্লা থেকে ঢাকার দিকে এগোতে থাকে। কমান্ডার আবদুস সবুর খান হানাদারদের যেতে দেখেন। এরপর ইফতারের কুড়ি মিনিট পর পাকিস্তানি সেনারা কোদালিয়া সেতু পার হয়ে গেলে সবুর খান তার দলকে সতর্ক করে দেন।

এদিকে, কোদালিয়া সেতু পার হওয়ার ২ ঘণ্টা পরও যখন মহিষবাথান সেতু অতিক্রমের সংকেত আসেনি, তখন সবুর খান খানিকটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তবে কী শত্রুরা মহিষবাথান সেতু পার হয়নি! ঢাকার দিক থেকেও কোনো সংকেত না আসায় কমান্ডার সবুর খান কমান্ডার সাইদুর রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে কোদালিয়া সেতু আক্রমণের নির্দেশ দিলে মুক্তিযোদ্ধারা গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে সেতুতে উঠে পড়েন। একপর্যায়ে রাজাকার ও মিলিশিয়ারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে সেতুতে অবস্থানরত মুক্তিযোদ্ধাদের রক্ষায় কমান্ডার সবুর খান এবং কমান্ডার সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে দুপাশ থেকে ২ ভাগে বিভক্ত ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধা মিলিশিয়া ও রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালান। এসময় অবস্থা বেগতিক দেখে ৪ মিলিশিয়া ও ৫৫ রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। 

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম ও দশম খণ্ড।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ২, ৩, ৬, ৮ ও ১১

Comments

The Daily Star  | English

11 years on, cries for justice remain unheeded

Marking the 11th anniversary of the Rana Plaza collapse, Bangladesh's deadliest industrial disaster, survivors and relatives of the victims today gathered at the site in Savar demanding adequate compensation and maximum punishment for the culprits

50m ago