মুক্তিযুদ্ধ

১ ডিসেম্বর ১৯৭১: বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানকে সেনা অপসারণের আহ্বান ইন্দিরা গান্ধীর

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ১ ডিসেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন দিল্লিতে রাজ্যসভার অধিবেশনে দেওয়া এক বক্তৃতায় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী উপমহাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণের নির্দেশ দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রতি আহ্বান জানান। ইন্দিরা গান্ধী এসময় বলেন, 'বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানি সৈন্য অপসারণই সমস্যার শ্রেষ্ঠ সমাধান। ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের জনসাধারণকে প্রস্তুত থাকতে হবে।'

ঢাকায় এদিন

১ ডিসেম্বর সকাল পৌনে ৮টায় ইস্কাটনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটে। এত সকালে অফিসে কেউ অবস্থান না করায় দুজন সামান্য আহত হওয়া ছাড়া কেউ হতাহত হয়নি। তবে গেরিলাদের এ বোমা হামলায় অফিসের ৩টি কক্ষ ও কাগজপত্রের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এই অফিস দুমাস আগে জুলফিকার আলী ভুট্টো উদ্বোধন করেছিলেন।

পাকিস্তানে এদিন

১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে পাকিস্তান সরকারের এক মুখপাত্র বলে, 'নিষিদ্ধঘোষিত আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার এখনও শেষ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানের চারটি রণাঙ্গনে যে আক্রমণাত্মক চাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা এখনো অব্যাহত রয়েছে।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

১ ডিসেম্বর মার্কিন সংবাদপত্র 'নিউইয়র্ক টাইমস' একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয় 'বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্দেশে সামরিক বাহিনীর লোকেরা পুনরায় গ্রামবাসীদের হত্যা এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়ার বর্বর অভিযান শুরু করেছে। গেরিলা সন্দেহে জিঞ্জিরার কতজন যুবককে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে হত্যা করেছে তার সঠিক হিসেব নেই। বুড়িগঙ্গার অপর পারের এই গ্রামটিতে অন্তত ৮৭ জনকে সামরিক বাহিনীর লোকেরা হত্যা করেছে। এদের অধিকাংশই যুবক। নারী এবং শিশুরাও ওদের হাত থেকে রেহাই পায়নি।'

দেশব্যাপী গণহত্যা ও প্রতিরোধ যুদ্ধ

কালীগঞ্জ গণহত্যা

১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কালীগঞ্জে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাহাদুরসাদী ইউনিয়নের খলাপাড়া গ্রামে ন্যাশনাল জুট মিলের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের ওপর পৈশাচিক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় শহীদ হন ১৩৬ জন নিরীহ মানুষ।

এদিন কালীগঞ্জ ন্যাশনাল জুট মিলের শ্রমিক কর্মচারীরা সকালের নাস্তা খেতে বসার সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পার্শ্ববর্তী ঘোড়াশাল ক্যাম্প থেকে নদী পার হয়ে মিলের ভিতর ঢুকে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। ওই দিন সকাল থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত ন্যাশনাল জুট মিলের নিরীহ বাঙ্গালী কর্মকর্তা কর্মচারীদের সারিবদ্ধভাবে লাইনে দাঁড় করিয়ে হানাদার বাহিনীরা গুলি করে নির্মম গণহত্যা চালায়।এরপর ৩/৪ দিন নিরীহ বাঙালিদের লাশ মিলের সুপারি বাগানে পড়েছিল।

১ ডিসেম্বর দিনাজপুরের ময়দান দিঘির কাছে পুটিমারীতে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী সম্মিলিতভাবে দুপুর ১২ টায় হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে মুক্তিবাহিনীর ৫ জন ও ভারতীয় বাহিনীর ৫৫ জন হতাহত হন। এরপর যৌথবাহিনী ময়দান দিঘি দখল করে। এদিন বিকেলে মুক্তিবাহিনী বোদা থানার কাছে পৌঁছালে হানাদার বাহিনী তাদের উপর হামলা চালায়। যৌথ বাহিনী হানাদারদের হেডকোয়ার্টার আক্রমণ করলে হানাদার বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়। এসময় ভারতীয় আর্টিলারির ক্যাপটেন সুধীর শহীদ হন। এদিন সন্ধ্যায় বোদা থানা মুক্ত হয়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ৬০/৭০ জন সৈন্য হতাহত হয়। পরে ভারতীয় বাহিনী বোদা থানায় অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনী বোদা থেকে তিন মাইল সামনে ঠাকুরগাঁও এর পথে ডিফেন্স নেয়। এ রাতে ভুলক্রমে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে গোলাগুলির কারণে ২০/২৫ জন ভারতীয় জোয়ান হতাহত হন এবং মুক্তিবাহিনীর খাদ্য ও রান্না বহনকারী পার্টির ৪/৫ জন শহীদ হন। এ রাতেই ভারতীয় কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা ভুলিরপুলের কাছে পৌঁছলে হানাদার বাহিনীর হামলার মুখে পড়ে। পাল্টা জবাব দিলে হানাদার সৈন্যরা টিকতে না পেরে ভুলিরপুল আংশিক ধ্বংস করে পিছু হটে।

১ ডিসেম্বর সিলেটের শমসেরনগরে শেষরাতের দিকে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালায়। এসময় মুক্তিবাহিনীর তীব্র আক্রমণে হানাদার বাহিনী এই এলাকা থেকে পালাতে শুরু করে। পরে মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলা ও দুয়ারাবাজার মুক্ত ঘোষণা করে। মুক্তিবাহিনীর অপারেশন অব্যাহত থাকায় হানাদার বাহিনী এই জেলার গারা, আলিরগাঁও, পিরিজপুর থেকে তাদের বাহিনী গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।

১ ডিসেম্বর সিলেটে বিগত ৪ দিন ধরে কানাইঘাট-দূর্বাস্ত রাস্তা দখলে রাখা লেফটেন্যান্ট আব্দুর রবের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধারা এদিন রাত ৮টার দিকে মূল সড়কে না গিয়ে ভিন্ন পথে কানাইঘাটের দিকে যাত্রা শুরু করেন।

১ ডিসেম্বর কুষ্টিয়া অঞ্চলের মুক্তিবাহিনী, স্থানীয় গেরিলা বাহিনী ও জনগণ ভেলুরপাড়া রেল স্টেশনটি পুড়িয়ে দেয়। পরে ব্রীজ ধ্বংস করে স্লিপার উঠিয়ে রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে দেয়।

১ ডিসেম্বর রাঙ্গামাটি ব্যাপটিস্ট মিশনে ঢুকে হানাদারবাহিনী ধর্মযাজক চার্লস আর. হাউজারসহ বহু বাঙালিকে হত্যা করে।

১ ডিসেম্বর গাজীপুরের কালিয়াকৈরে হানাদার বাহিনীর একটি দল বাঙ্কারে রক্ষ্মণাত্মক অবস্থানের সময় বিষধর সাপের ছোবলে ৫ জন হানাদার সেনা নিহত হয়।

১ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ২নং সেক্টরে ক্যাপ্টেন এমএ মতিনের দল, মিত্রবাহিনী ও ২য় বেঙ্গলের একটি বাহিনী সম্মিলিতভাবে আখাউড়া শহরের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ঘিরে ফেলে আক্রমণ চালায়। দুই পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়।

সূত্র-

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম, একাদশ ও দ্বাদশ খণ্ড।

দৈনিক ইত্তেফাক ২ ডিসেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ২ ডিসেম্বর ১৯৭১

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
Binimoy platform suspended by Bangladesh Bank

BB suspends Binimoy over irregularities

During the previous AL govt, it was developed by the IDEA under the ICT Division at a cost of Tk 65 crore.

11h ago