মুক্তিযুদ্ধ

১ নভেম্বর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ১১ রমজান

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসররা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজকের পর্বে রইল ১১ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধের ১১ রমজান পালিত হয়েছিল ১ নভেম্বর। দিনটি ছিল সোমবার। মুক্তিযুদ্ধের অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

মুক্তিযুদ্ধের ১১ রমজানের দিন পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিকতার বিবরণ পাওয়া যায় দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের নান্দারাই গ্রামের বাসিন্দা সোলায়মান গণির কথায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ডের ১৪৮তম পৃষ্ঠায় দেওয়া সাক্ষ্যে সোলায়মান গণি বলেন, '১৯৭১ সালের ১১ রমজান সকাল ১১ টা ৩০ মিনিটে খান সেনা ও রাজাকাররা আমাকে গ্রেপ্তার করে। দড়ি বেঁধে রাজাকার, খান সেনা ও শান্তি কমিটির সদস্যরা আমাকে থানায় নিয়ে যায়। রাস্তার মধ্যে বেদম মারে। এ সময় তারা বেয়নেট দেখাচ্ছিল এবং উল্লাস করছিল। ৪ মাইল রাস্তায় বিরামহীনভাবে মেরেছিল। আমার চোখ-মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছিল।'

'থানায় নেওয়ার পর আমার পা উপরে তুলে লোহার রড দিয়ে মারতে থাকে। সঙ্গে কিল, ঘুষি ও লাথি সমানে চলতে থাকে। এ অবস্থায় ৪-৫ ঘণ্টা রেখে অত্যাচার করতে থাকে। ৪ রাত থানায় ছিলাম এবং তারা একইভাবে অত্যাচার করেছিল। রোজার মাস হওয়া সত্ত্বেও তারা সেহরি অথবা ইফতারের জন্য কোনো খাবার দেয়নি। না খেয়েই রোজা থাকতে হয়েছে। বহুবার তাদের কাছ থেকে পানি চেয়ে পাইনি। চতুর্থ দিনে  ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে আমাকে ছেড়ে দেয় তারা', যোগ করেন সোলায়মান গণি।   

তিনি আরও উল্লেখ করেন, 'ওরা আমার বাড়িঘরও লুটপাট করে এবং সবশেষে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। আমার অপরাধ, আমি আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলাম এবং অসহযোগ আন্দোলনের সময় বিশেষ কর্মতৎপরতা প্রদর্শন করেছিলাম।'

মুক্তিযুদ্ধের ১১ রমজানে পাকিস্তানি বাহিনীর পৈশাচিকতার বর্ণনা পাওয়া যায় নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার সফিকপুর গ্রামের বাসিন্দা মোহাম্মদ ছালামত আলীর বর্ণনায়ও।

তিনি বলেন, 'বর্বর নরপশুরা রাজাকারসহ সশস্ত্র অবস্থায় গ্রামে প্রবেশ করার আগেই গ্রামের জনসাধারণ প্রাণভয়ে পালিয়ে যায়। সেনা ও রাজাকাররা নৌকা থেকে নেমেই গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়িতে তল্লাশি চালাতে লাগল। তাদের ধারণা ছিল, হয়তো কোনো আওয়ামী লীগকর্মী, মুক্তিযোদ্ধা বা স্বেচ্ছাসেবক গ্রামে আত্মগোপন করে আছেন। তবে তাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল লুট করা। ঘরের সব মূল্যবান আসবাপত্র নষ্ট করে দেয় তারা। সৌখিন জিনিসও নিয়ে যায়। ট্রাংক, স্যুটকেস খুলে বা আছাড় মেরে সেগুলোর ভেতরে যা পায়, সবকিছু নিয়ে যায়।'

'মজিবুর রহমান নামের ৫০ বছর বয়সী এক ব্যক্তিকে বেদম মারধর করে। আমাকে ধরে চোখ বেঁধে দেয়। চোখ বাঁধা অবস্থাতেই নৌকায় তোলে। অনেক অবাঞ্চিত কথা বলার পর পাকিস্তানি বাহিনী আমাকে আত্রাই স্টেশনে নিয়ে যায়। সেখানে নামিয়ে চোখের বাঁধন খুলে দেয়। স্টেশন সংলগ্ন একটি ঘরে আমাকে বন্দী করে রাখে', যোগ করেন তিনি।

রণাঙ্গনে ১১ রমজান

মুক্তিযুদ্ধের ১১ রমজান চট্টগ্রামে দুর্ধর্ষ অপারেশন চালান গেরিলা মুক্তিযোদ্ধারা। এই অপারেশনে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানি সেনা, পুলিশ নিহত হয়। অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা রফিক আহমদ, শফিউল বশর ফজলুল হক, অমল মিত্র ও ভোলানাথ।  

প্রথমে স্টেট ব্যাংক অপারেশন চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধারা সিদ্ধান্ত নেন পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর অতর্কিত হামলা চালানো হবে। ২টি গ্রেনেড, ২টি সাব মেশিনগান, ৪টি রিভালভার এবং বেশ কিছু গোলাবারুদ নিয়ে ছোট একটি ফিয়েট গাড়িতে চেপে রওনা হন তারা।

তখন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের মোড়ে আইডিয়াল বুক স্টলের সামনে দাঁড়িয়ে পত্রিকা পড়ছিল এক পাকিস্তানি অফিসার। তার কোমরে ছিল রিভালভার। রিভালভারটি ছিনিয়ে নিতে রফিকুল আহমদ ও শফিউল বশর গুলি ছোড়েন। সেই হানাদার অফিসার লুটিয়ে পড়ে। এরপর তারা দ্রুতগতিতে সেই রিভালভারটি তুলে নিতেই ৫০ গজ দূরে একটি জিপে থাকা ৪ পাকিস্তানি সেনা দেখতে পেয়ে ফায়ারিং শুরু করে।

২ পক্ষের গোলাগুলিতে তখন এক পুলিশ সার্জেন্ট নিহত হয় এবং গেরিলা শফিউল পায়ে গুলিবিদ্ধ হন। এ সময় রফিক ও শফিউল পালাতে শুরু করলে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জিপটির সঙ্গে নৌবাহিনীর একটি জিপ গেরিলাদের গাড়ি তাড়া করে। পাকিস্তানি বাহিনীর গুলির মুখে গেরিলারাও পাল্টা গুলিবর্ষণ শুরু করেন। এক সময় গাড়িচালক মুক্তিযোদ্ধা ভোলানাথ পিঠে গুলিবিদ্ধ হন। গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারালে ভোলানাথ গাড়ি থেকে নেমে গলিতে ঢুকে পড়েন।

তখন গেরিলা ফজলুল হক মেশিনগান নিয়ে হানাদারদের লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার শুরু করেন। এ সময় রফিক আহমদ, অমল মিত্র, শফিউল বশর, গাড়ি থেকে নেমে পড়েন। ফের গুলিবিদ্ধ হন শফিউল। অনবরত ব্রাশফায়ারে ফজলুল হকের মেশিনগানের ম্যাগাজিনও শূন্য হয়ে যায়। বিষয়টি টের পেয়ে গুরুতর আহত অবস্থায়ও শফিউল বশর নিজের মেশিনগান নিয়ে ব্রাশফায়ার শুরু করেন, যেন ফজলুল হক নিরাপদ দূরত্বে সরে যেতে পারেন। এ সময় গেরিলা রফিক আহমদ শহীদ হন।

১১ রমজান ইফতারের পর মৌলভীবাজারের লাতু ও বড়লেখার মাঝখানে রেললাইনে মাইন পেতে রাখে মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল। কয়েক ঘণ্টা পর এই লাইন দিয়ে যাওয়ার সময় মাইন বিস্ফোরণে হানাদার বাহিনীর একটি রেল ট্রলি উড়ে যায়।

১১ রমজান যশোরের নোয়াপাড়ায় মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। হামলায় হানাদার বাহিনীর ৬ সেনা নিহত এবং ৪ জন আহত হয়।

১১ রমজান যশোরের ঝিকরগাছার গৌরপুরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিরক্ষাব্যূহ গড়ে তোলে। জানতে পেরে ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযোদ্ধা ও এক কোম্পানি এমএফ রাতে সেখানে আক্রমণ করে। এতে পাকিস্তানি বাহিনীর ২ সেনা নিহত হয় এবং বাকিরা পালিয়ে যায়।

১১ রমজান ১ নম্বর সেক্টরের মনুঘাট সাব সেক্টরের অধীন বিলাইছড়ির রাখিয়াং নদীর পাশে অবস্থান নেয় হানাদার বাহিনীর একটি বড় দল। জানতে পেরে সেখানে হামলা চালায় মুক্তিবাহিনী। এতে ৩ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ৪ জন আহত হয়।

১১ রমজান খাগড়াছড়ির বেলছড়িতে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। কিছুক্ষণ পর হানাদার বাহিনীর একটি দল ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর দলটি তাদের ওপর হামলা চালায়। এতে হানাদার বাহিনীর ২ সেনা নিহত হয় এবং ৫ জন আহত হয়।

১১ রমজান ময়মনসিংহের সড়কে মুক্তিবাহিনীর একটি অ্যামবুশ দল মাইন পুঁতে রাখে। হানাদার বাহিনী অ্যামবুশের আওতায় এলে মাইন বিস্ফোরণে ১ হানাদার সেনা নিহত হয়।

২ নম্বর সেক্টরের ঢাকা মহানগরীর জন্য বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ২টি দল এদিন ২টি আলাদা অভিযান চালায়। একটি দল সন্ধ্যায় কাকরাইলে এক পেট্রলপাম্পে বোমা ছোড়ে। অন্য দলটি সকাল ১১টার দিকে শান্তিনগরে এক ব্যাংকে অভিযান চালায়।

১১ রমজান দুপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গার গোলদড়িতে রাজাকারদের ওপর আক্রমণ চালায়। এ সময় ১৮ জন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে, বাকিরা পালিয়ে যায়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র অষ্টম ও দশম খণ্ড

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ১,২,৩ ও ৮

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
National Consensus Commission Holds Talks with BNP, Jamaat, and NCP

Parties split over ‘pluralism’, nat’l constitutional council

The National Consensus Commission’s talks with major political parties have yielded a broad consensus on key issues such as caretaker government system and a bicameral parliament, but the parties remain divided on some sensitive questions.

10h ago