মুক্তিযুদ্ধ

২৭ আগস্ট ১৯৭১: লন্ডনে প্রবাসী সরকারের কূটনীতিক মিশন উদ্বোধন    

লন্ডনের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনীতিক মিশন উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দূতাবাসের সহকর্মীদের সঙ্গে আবু সাঈদ চৌধুরী। ছবি: সংগৃহীত

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ২৭ আগস্ট গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র জয়বাংলা পত্রিকার ১৬তম সংখ্যায় বলা হয়, 'সভ্য জগত থেকে বিচ্ছিন্ন বেলুচিস্তানের কাকুনে বাংলাদেশে হত্যা চালাবার জন্য বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং নিচ্ছে। এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশাল ফোর্স তৈরির কাজে ট্রেনিং দিচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিকামী ভিয়েতনামী নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যেমন ট্রেনিংপ্রাপ্ত গুপ্তবাহিনী পাঠিয়েছিল এবং যার নাম সরকারিভাবে দিয়েছিল 'গ্রিন ব্যারেট', ইয়াহিয়া সরকারও ঠিক তেমনি করে গোপন ট্রেনিং দিয়ে একটি বিশেষ হত্যাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে।'

২৭ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের মুখপাত্র মিজানুর রহমান চৌধুরী মুজিবনগর থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েন না করতে জাতিসংঘ মহাসচিব উথান্টের প্রতি আহ্বান জানান।

পাকিস্তানে এদিন

২৭ আগস্ট সন্ধ্যায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল এসজিএমএম পীরজাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন পাকিস্তান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো। এর আগে, প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন পিপিপির রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা।

২৭ আগস্ট ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করার আগে ইসলামাবাদে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিশেষ সহকারী ডা. আবদুল মোত্তালিব মালিক বলেন, 'ইয়াহিয়া খান দেশে বেসামরিক সরকার গঠনে আগ্রহী। শরণার্থীরাও এর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসতে শুরু করেছে। ২২ আগস্ট পর্যন্ত দেড় লাখেরও বেশি শরণার্থী ভারত থেকে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন।'

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

২৭ আগস্ট যুক্তরাজ্যের লন্ডনের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের কূটনীতিক মিশনের আনুষ্ঠানিক কার্যালয় উদ্বোধন করা হয়। ভারতের বাইরে এটিই প্রথম বাংলাদেশের কূটনীতিক মিশন হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করল। লন্ডনে নিযুক্ত প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ দূত আবু সাঈদ চৌধুরী ছাড়াও মিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বেশ কয়েকজন ব্রিটিশ এমপি ছিলেন। বহু প্রবাসী বাঙালি ও অবাঙালির উপস্থিতিতে এই কূটনীতিক মিশনের উদ্বোধন করা হয়। অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন আবু সাঈদ চৌধুরী।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, 'লন্ডন থেকে সবসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় কর্মকাণ্ড তুলে ধরা হবে। পাশাপাশি এটিই হবে বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বের প্রথম সংযোগস্থল। বিভিন্ন দেশে এরই মধ্যে দূতাবাস ও কূটনীতিক মিশন খোলার কথা হচ্ছে। গত পহেলা আগস্ট আমরা ট্রাফালগার স্কয়ারের সমাবেশে মিশন স্থাপনের কথা বলেছিলাম। এখানে সেটিরই বাস্তবায়ন হলো।'

অনুষ্ঠানের কিছুক্ষণ আগে এক গাড়িভর্তি পুলিশ দূতাবাসের বাইরে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত হয়। অনুষ্ঠান শেষে প্রীতিভোজে তাদেরকেও আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। জানা যায়, লন্ডনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত সালমান আলী প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাসের খবর শোনার পর দ্রুত ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে দেখা করেন। দূতাবাস খোলার প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি তাকে বলেন, 'লন্ডনে অবৈধ বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাস খোলার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি দেশদ্রোহিতা ও ষড়যন্ত্রমূলক। এটি পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি চরম আঘাত ও অবমাননাকর।' সালমান আলীকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারে আশ্বস্ত করে বলেন,  'আমরা এ ধরণের কোন বৈধতা দিতে পারি না। আর স্বীকৃতি দেওয়া তো বহু দূরের কথা। এমনকি এ ধরণের নামের ব্যবহারও আমরা সমর্থন করিনা।'

পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত সালমান আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে দেখা করে প্রতিবাদ জানানোর পর পাকিস্তানি নাগরিক ও পাকিস্তানের সমর্থকেরা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দূতাবাসে হামলা চালাতে পারে, এই আশঙ্কা থেকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এই পুলিশ সদস্যরা সেখানে নিরাপত্তার কাজে এসেছিল।

২৭ আগস্ট 'হংকং স্ট্যান্ডার্ড' পত্রিকার এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'সামরিক আদালতে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের নামে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা যা করতে যাচ্ছে তা একটা প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়। এই বিচার প্রহসনের পেছনে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার যে গোপন দুরভিসন্ধি আছে তা বীভৎস।'

২৭ আগস্ট আইরিশ আইনজীবী, রাজনীতিক ও মানবাধিকার আন্দোলনের অন্যতম নেতা শ্যন ম্যাকব্রাইট এক চিঠিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার বেসামরিক আদালতে করার আবেদন জানিয়ে বলেন, 'কোন বিদেশি আইনজীবীকে পাকিস্তানের আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থনের অনুমতি যদি না দেওয়া হয়, তাহলে শেখ মুজিবুর রহমান যেন তার ইচ্ছেমতো আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করতে পারেন, তার ব্যবস্থা যেন করা হয়। বিচারে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে যদি তার আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দেওয়া হয়, তাহলে তা বিচার বলে গণ্য হতে পারে না।'

গণহত্যা ও  দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ 

দেয়াড়া গণহত্যা

২৭ আগস্ট পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগী রাজাকাররা খুলনা খালিশপুরে পিপলস জুট মিলের খেয়াঘাট পেরিয়ে সেনহাটি গ্রাম হয়ে দেয়ারা এসে পৌঁছায়। এদিন  ভোররাতে কয়েকশ রাজাকার, বিহারি ও পাকিস্তানী হানাদার সৈন্য গোটা দিয়ারা গ্রামটি ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজতে থাকে। কিন্তু, মুক্তিযোদ্ধাদের খুঁজে না পেয়ে ক্ষুব্ধ ও হতাশ হানাদার বাহিনী প্রতিশোধের নেশায় উন্মত্ত হয়ে মুক্তিযোদ্ধা আবদারের বাড়ি থেকে তার পিতা ডা. মতিয়ার রহমানসহ ছয় জনকে ধরে রাস্তায় এনে পিঠমোড়া করে বেঁধে সেখানেই তাদের কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে। এরপর হানাদারদের আক্রমণের মুখে গ্রামের কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হলেও, ৬১ জন নিরীহ গ্রামবাসী ধরা পড়ে।

পরে, বিহারী রাজাকার ও হানাদাররা তাদেরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ৬১ জনের মধ্যে ৬০ জন ঘটনাস্থলেই শহীদ হন। গণহত্যার পর ৩৮ জন  শহীদের মরদেহ ভৈরব নদীতে ফেলে দেয় রাজাকারেরা। বাকি ২২ জনকে তিনটি গণকবরে মাটি চাপা দেওয়া হয়।

২৭ আগস্ট সকালে কুমিল্লায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর একটি দল নৌকায় সেনেরবাজারের দিকে অগ্রসর হলে মুক্তিবাহিনী অতর্কিত হামলা চালায়। এ সময় দুটি নৌকাই ডুবে যায় এবং বেশিরভাগ সৈন্য পানিতে ডুবে মারা যায়।

পরপর দুদিন আক্রমণের শিকার হওয়ার পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নয়ানপুরের পশ্চিম পাশে শশীদল গ্রামের কাছে জমায়েত হয়ে মুক্তিবাহিনীর সেনেরবাজার অবস্থানের ওপর মর্টার আক্রমণ চালায়। এ সময় দুই পক্ষের মধ্যে ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হয়। পরে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে হানাদার বাহিনী পিছু হটে। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনী ও মুক্তিবাহিনী দুই পক্ষেরই ব্যাপক ক্ষতি হয়।

২৭ আগস্ট ফেনীর পরশুরাম থানার কাছে মুক্তিবাহিনীর একটি দল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে সাত জন হানাদারকে হত্যা করে। অন্যদিকে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী-বিলোনিয়া সড়কের হাসানপুর ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়।

২৭ আগস্ট সিলেট সিয়ালা ঘাটের কাছে মুক্তিবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা কাকারদি ব্রিজ ধ্বংস করতে এগিয়ে এলে স্থানীয় রাজাকারদের প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়। এ সময় মুক্তিবাহিনীর পাল্টা আক্রমণে দুই রাজাকার নিহত হয় এবং একজনকে জীবিত অবস্থায় আটক করে মুক্তিবাহিনী। এরপর মুক্তিবাহিনী ব্রিজটি উড়িয়ে দেয়।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: দলিলপত্র ষষ্ঠ, অষ্টম, দশম, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড

দ্য গার্ডিয়ান, ২৮ আগস্ট ১৯৭১

সাপ্তাহিক জয় বাংলা, ২৭ আগস্ট ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা, ২৮ আগস্ট ১৯৭১

দেয়াড়া গণহত্যা: গৌরাঙ্গ নন্দী

আহমাদ ইশতিয়াক [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Trump tells Zelensky US would help with Ukraine's security in a peace deal

Trump pressures Ukraine to compromise, warns against NATO aspirations

1h ago