মুক্তিযুদ্ধ

৩০ অক্টোবর ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধে ৯ রমজান

(পবিত্র কোরআনে রমজানকে রহমতের মাস বলা হলেও, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা এই মাসে বর্বরোচিত গণহত্যা, নৃশংস নির্যাতন-নিপীড়ন, লুণ্ঠন ও ধর্ষণ চালায়। অন্যদিকে, প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য এ মাসে রণাঙ্গনে প্রাণপণে লড়াই করেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। রোজা পালনরত অবস্থাতেই স্বদেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানরা। মুক্তিযুদ্ধের রমজান মাস কেমন ছিল, তা নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারের ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজনের আজকের পর্বে রইল ৯ রমজানের ঘটনাপ্রবাহ।)

মুক্তিযুদ্ধে ৯ রমজান পালিত হয় ৩০ অক্টোবর। দিনটি ছিল শনিবার। অন্যান্য দিনের মতো এদিনও গণহত্যা, নির্যাতন ও নৃশংসতা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী।

৯ রমজান পাবনার ঈশ্বরদীতে জেলা শান্তি কমিটির সেক্রেটারি আবদুস সোবহানের নেতৃত্বে রাজাকারদের একটি দল বেতবাড়িয়া গ্রামে ঢুকে প্রথমে লুটপাট চালায়। এরপর গ্রামের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ করে ৪ জন গ্রামবাসীকে মসজিদ থেকে ধরে এনে পৈশাচিক নির্যাতনের পর হত্যা করে।

৯ রমজান রাতে কামালপুর বিওপি যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে শহীদ হন ১৬ বছরের কিশোর মোহাম্মদ শাহজাহান, বীর বিক্রম। ৯ রমজান মধ্যরাতে কামালপুর বিওপি দখলের জন্য মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেন আখখেতে। অদূরেই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্ত অবস্থান কামালপুর বিওপি। মুক্তিবাহিনীর লক্ষ্য ছিল, যে করেই হোক হানাদার বাহিনীকে ঘাঁটি থেকে বের করতে হবে। তাই গুলিবর্ষণ শুরু করেন তারা।

এ সময় পাকিস্তানি সেনারা ঘাঁটি ছেড়ে বেরিয়ে এসে পাল্টা আক্রমণ গড়ে তোলে। ২ পক্ষের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়। আখখেতের মধ্যেই একটি বাঙ্কারে অবস্থান নিয়েছিলেন মোহাম্মদ শাহজাহানসহ ২ মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি বাহিনী ত্রিমুখী আক্রমণের মধ্য দিয়ে ঘেরাও করে ফেললেও গুলিবর্ষণ চালিয়ে যান তারা।  এক পর্যায়ে গুলি শেষ হয়ে যায় মোহাম্মদ শাহজাহানের। মুক্তিবাহিনীর বাঙ্কার লক্ষ্য করে ছোড়া হানাদার বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন তিনি ও আরেকজন মুক্তিযোদ্ধা।  

রণাঙ্গনে ৯ রমজান

মুক্তিযুদ্ধের ৯ রমজান ঢাকার উত্তর অঞ্চলের নিকটবর্তী এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর একটি দলের ওপর অতর্কিত হামলা চালান গেরিলারা। এ সময় হানাদার বাহিনীর ৩ সেনা নিহত হয় এবং এক অফিসারসহ ৪ সেনা আহত হয়। একইদিন মুক্তিযোদ্ধাদের এই দলটি কমলাপুর এলাকায় অপারেশন চালিয়ে ৪ রাজাকারকে হত্যা করে।

৯ রমজান সেহরির সময় তাহেরউদ্দিন আখঞ্জির নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মৌলভীবাজারের বড়লেখার বর্নি থেকে গিয়ে হানাদার বাহিনীর গৌরীনগর ক্যাম্পে হামলা চালায়। বিপরীত দিক থেকে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার মাহবুব ও তার বাহিনীও হানাদার বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। ৫ নম্বর সেক্টরের সেক্টর কমান্ডার মীর শওকত আলী ১২০ মিলিমিটার মর্টার নিয়ে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগ দেন।

হানাদার বাহিনী এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে পেছনে সরে যায়। তখন ওয়্যারলেসে খবর পেয়ে হানাদার বাহিনীর আরেকটি দল এগিয়ে এসে আক্রমণ শুরু করে। সংঘর্ষ বড় হয়ে যাওয়ায় এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী পিছু হটে ক্যাম্পে ফিরে যায়। এই যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর ১১ সেনা নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

মুক্তিযুদ্ধের ৯ রমজান দুপুরে নোয়াখালীর সুধারাম থানার ওদারহাটে পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। কমান্ডার মতিন ও হাবিলদার খালেকের ট্রুপসসহ মোট ৪০ জন মুক্তিযোদ্ধা এই অপারেশনে অংশ নেন। ৪ ঘণ্টাব্যাপী এই যুদ্ধের শেষদিকে ২৬ জন রাজাকার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। পরে ২৬ রাজাকারকে স্থানীয় আবদুল্লাহ মিয়ার বাড়ির কাছে গুলি করে হত্যা করেন মুক্তিযোদ্ধারা।

৯ রমজান সন্ধ্যায় ৭ নম্বর সেক্টরে ক্যাপ্টেন গিয়াসউদ্দীন চৌধুরীর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী হানাদার বাহিনীর জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। একটু পর হানাদার বাহিনীর একটি কনভয়  ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনী আক্রমণ শুরু করে। এতে কনভয়তে থাকা হানাদার বাহিনীর ২টি জীপ ধ্বংস হয় এবং বেশ কয়েকজন হানাদার সেনা নিহত হয়।

৯ রমজান মেজর আফসারের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর একটি দল গাজীপুরের কালিয়াকৈরের ফুলবাড়ীয়া এলাকায় হানাদার বাহিনীর অবস্থানে আক্রমণ চালায়। এতে ৭ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়।

সাতক্ষীরার আশাশুনি থানার চাপড়ায় ছিল রাজাকারদের ক্যাম্প। ৯ রমজান ভোরে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল ওই ক্যাম্পে হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনীর গ্রেনেড হামলায় বেশ কয়েকজন রাজাকার নিহত হয়। বাকি রাজাকাররা পালিয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পের দখল নিয়ে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার করে।

৭ নম্বর সেক্টরের লালগোলা সাব সেক্টরের অন্তর্গত চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুন্দরপুর ইউনিয়নে ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি। এখান থেকে রাজাকারদের সহযোগিতায় নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর হামলা চালিয়ে যাচ্ছিল হানাদার বাহিনী। পাশের গ্রামগুলোতেও লুটপাট চালাচ্ছিল তারা। ৯ রমজান সকালে মুক্তিবাহিনীর বড় একটি দল এ ঘাঁটির উপর হামলা চালায়। হামলায় পাকিস্তানি সেনারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। পরে ঘাঁটিটি দখল করে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিবাহিনী।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: সেক্টর ভিত্তিক ইতিহাস সেক্টর ২, ৫ ও ৭

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র দশম খণ্ড

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
child victims of July uprising Bangladesh

Child victims of July uprising: Of abandoned toys and unlived tomorrows

They were readers of fairy tales, keepers of marbles, chasers of kites across twilight skies. Some still asked to sleep in their mother’s arms. Others, on the cusp of adolescence, had just begun to dream in the language of futures -- of stethoscopes, classrooms, galaxies. They were children, dreamers of careers, cartoons, and cricket.

11h ago