মুক্তিযুদ্ধ

৪ এপ্রিল, ১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক

তেলিয়াপাড়া চা বাগানের এই বাংলোতে হয়েছিল প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। ছবি: সংগৃহীত

হবিগঞ্জের মাধবপুরের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৪ এপ্রিলের এই বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম।

তেলিয়াপাড়া চা বাগানের অবস্থান ঢাকা-সিলেট সড়ক ও তেলিয়াপাড়া রেলস্টেশন থেকে ২ কিলোমিটার দূরত্বে ভারতীয় সীমান্তের কাছে। ৪ এপ্রিল এই চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী উচ্চপদস্থ বাঙালি সামরিক কর্মকর্তারা। ভারতীয় বাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন ।

তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বৈঠকের সিদ্ধান্ত হয়েছিল যেভাবে

মার্চ মাসের শেষে মাধবপুর ডাকবাংলোতে অবস্থান নেন মেজর খালেদ মোশাররফ। তেলিয়াপাড়ার বাসিন্দা ও স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আশরাফ আলীকে তিনি চা বাগান থেকে ভারতীয় সীমান্ত পর্যন্ত রাস্তা তৈরির নির্দেশ দেন।

চা বাগানের শ্রমিকরা জঙ্গল কেটে রাস্তা গড়লে তেলিয়াপাড়া বিওপির কাছে ভারতীয় বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন মেজর খালেদ মোশাররফ।

এ সময় খালেদ মোশাররফ ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের কাছে বাংলাদেশের নানা স্থানে থাকা বাঙালি সেনা অফিসার ও ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার জন্য সহযোগিতা চান। সহযোগিতার আশ্বাস পাওয়ার পর দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ ১ এপ্রিল তেলিয়াপাড়ায় চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে যৌথভাবে সদরদপ্তর স্থাপন করেন। ১ এপ্রিল বিকেলেই খালেদ মোশাররফ ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডের সহযোগিতায় দেশের নানা প্রান্তে বিদ্রোহ করা এবং অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। এরইমধ্যে মেজর শাফায়াত জামিল, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রাজা তেলিয়াপাড়ায় উপস্থিত হন।   

২ এপ্রিল কর্নেল এম এ জি ওসমানী ত্রিপুরার আগরতলায় যান। এদিন বিকেলে তেলিয়াপাড়া সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন মেজর খালেদ মোশাররফ এবং মেজর শাফায়াত জামিল। এ সময়  ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল বাঙালি অফিসারসহ সবাইকে নিয়ে তেলিয়াপাড়া চা বাগানে একটি বৈঠকের প্রসঙ্গে তোলেন। তখন ৪ এপ্রিল সকালে বৈঠকের  সিদ্ধান্ত হয়।

৪ এপ্রিল, ১৯৭১

৪ এপ্রিল সকাল থেকেই তেলিয়াপাড়া চা বাগানে উৎসবমুখর পরিবেশ। উপস্থিত সবার মধ্যে টানটান উত্তেজনা।

সকাল ১০টার দিকে বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গলকে নিয়ে ভারতীয় সীমান্ত অতিক্রম করে তেলিয়াপাড়ায় প্রবেশ করেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী।

সকাল ১১টায় শুরু হয় সভার কার্যক্রম। বৈঠকের জন্য তেলিয়াপাড়া চা বাগানের ম্যানেজারের বাংলোতে উপস্থিত হন কর্নেল (অব.) মোহাম্মদ আবদুর রব, লেফটেন্যান্ট কর্নেল সালাউদ্দিন মোহাম্মদ রাজা, মেজর এ.এন.এম নুরুজ্জামান,  মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর শাফায়েত জামিল, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর মঈনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন আবু সালেহ মোহাম্মদ নাসিম, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, ক্যাপ্টেন আবদুল মতিন, লেফটেন্যান্ট সৈয়দ ইব্রাহীম, লেফটেন্যান্ট হেলাল মোর্শেদ খান, লেফটেন্যান্ট সেলিম, লেফটেন্যান্ট মাহবুবুর রহমানসহ মোট ২৭ জন বাঙালি অফিসার।

আরও ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর ব্রিগেডিয়ার শুভ্রমানিয়ম, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে ও আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল।

রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্য এমএনএ  কমান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, এমএনএ মৌলানা আসাদ আলী, এমএনএ মোস্তফা আলী, এমএনএ এনামুল হক মোস্তফা শহীদ।

বৈঠকে প্রথমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এরপর বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডেকে অস্ত্র ও  গোলাবারুদ সরবরাহের আবেদন ভারত সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার অনুরোধ করা হয়। ভি সি পান্ডে এ সময় ভারত সরকারের কাছে আবেদন পৌঁছে দেওয়ার অঙ্গীকার করেন। একইসঙ্গে তিনি ভারত সরকারের অনুমতি সাপেক্ষে গোলাবারুদ হস্তান্তরেরও আশ্বাস দেন। 

এরপর বাংলাদেশের সীমান্ত সংলগ্ন অঞ্চলে প্রশিক্ষণের বিষয়ে প্রস্তাব তোলেন মেজর খালেদ মোশাররফ ও বেশ কয়েকজন বাঙালি অফিসার। আগরতলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ওমেস সায়গল বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর জন্য প্রশিক্ষণ স্থাপন এবং শরণার্থী শিবির স্থাপনের ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন বলে জানান।

সভায় বাংলাদেশকে ৪টি অঞ্চলে বিভক্ত করে সেক্টর গঠনের ব্যাপারে প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এরপর মেজর কাজী মুহাম্মদ শফিউল্লাহকে বৃহত্তর সিলেট ও ময়মনসিংহ জেলার পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে দেওয়া হয় সমগ্র কুষ্টিয়া ও যশোর জেলা, ফরিদপুর জেলা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশে যুদ্ধ পরিচালনার ভার।

বৃহত্তর কুমিল্লা, ঢাকা ও নোয়াখালী অঞ্চলের যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। নোয়াখালী, কুমিল্লার আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত এবং ফরিদপুর ও ঢাকার অংশবিশেষে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর খালেদ মোশাররফকে। অপরদিকে চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী জেলার পূর্বাঞ্চলে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় মেজর জিয়াউর রহমানকে।

এরপর চট্টগ্রাম দখলের জন্য জিয়াউর রহমানের অধীনে ও ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুল মতিনের নেতৃত্বে চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গলের ব্রাভো কোম্পানিকে এবং ক্যাপ্টেন এজাজ আহমদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলের চার্লি কোম্পানিকে রামগড়ের দিকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। বিএসএফের পূর্বাঞ্চলীয় মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডে স্বেচ্ছায় উদ্যোগী হয়ে তাদের রামগড় পর্যন্ত পৌঁছানোর দায়িত্ব নেন।

এরপর ব্রিগেডিয়ার ভি সি পান্ডেকে বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোতে যুদ্ধকালীন অবস্থা পর্যালোচনা এবং দেশের নানা প্রান্তে থাকা বাঙালি অফিসারদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

সভায় জ্যেষ্ঠতম বাঙালি অফিসার হিসেবে কর্নেল (অব.) আতাউল গণি ওসমানীকে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক বা মুক্তিবাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর রাজনৈতিক সরকার গঠনের জন্য জাতীয় ও রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। 

বৈঠকে রাজনৈতিক সরকারের প্রস্তাবে বলা হয়, 'আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক সরকারের গুরুত্ব অপরিসীম। তা না হলে আমাদের পক্ষে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়া সম্ভব হবে না।'

বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া নানা কার্যক্রমের অগ্রগতি পর্যালোচনার জন্য ১০ এপ্রিল বাঙালি অফিসারদের নিয়ে আরেকটি সভা আয়োজনের সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠক শেষে সদ্যনিযুক্ত মুক্তিবাহিনীর প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী পিস্তল উঁচিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধের ঘোষণা দেন।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ: নবম ও দশম খণ্ড

 

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Shahjalal International Airport Terminal-3: Operations face further delay

The launch of Dhaka airport’s third terminal faces a further delay, as the Civil Aviation Authority of Bangladesh (CAAB) is still negotiating an operation and maintenance agreement -- a prerequisite for starting services -- with a Japanese consortium.

10h ago