মুক্তিযুদ্ধ

৬ নভেম্বর ১৯৭১: মুজিবনগরে জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৬ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন মুজিবনগরে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

বৈঠকে বলা হয়, 'ইয়াহিয়া খান এখন নতুন ষড়যন্ত্রে মেতেছেন। ইয়াহিয়া খানের নতুন যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে তীব্র উত্তেজনা ও যুদ্ধাবস্থা বাংলাদেশে চলমান নৃশংসতাকে আড়াল করার অপপ্রয়াস। এ ছাড়া, হানাদারদের বিরুদ্ধে যে বাংলাদেশ তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলছে এবং পাকিস্তানী বাহিনীর দিন যে ফুরিয়ে আসছে— তা থেকে দৃষ্টি ফেরানোর কৌশল এটি। পাকিস্তান সরকারের এ দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে হবে।'

বৈঠকে আরও বলা হয়, 'আমাদের নেতা বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে সব পদক্ষেপ নেওয়া হোক। অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানে ইয়াহিয়া যে অপচেষ্টায় মেতেছেন, সেদিকেও দৃষ্টি রাখতে হবে। এ সবই ঘৃণ্য ইয়াহিয়ার চক্রান্ত '

 প্রায় সাড়ে ৪ ঘণ্টাব্যাপী এ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। সভায় উপস্থিত ছিলেন অর্থমন্ত্রী এম মনসুর আলী, আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি আবদুস সামাদ আজাদ, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, মনোরঞ্জন ধর, মনি সিংসহ উপদেষ্টা পরিষদের সদস্যরা। তবে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। ৮ সেপ্টেম্বর সর্বদলীয় জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন হওয়ার পরে এটিই ছিলো উপদেষ্টা পরিষদের প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। 

ভারতে এদিন

৬ নভেম্বর দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসে আটক বাঙালি গোয়েন্দা কর্মকর্তা হোসেন আলী এবং তার স্ত্রী ও মেয়েদের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দিল্লিতে পাকিস্তান দূতাবাসের সামনে এ বিক্ষোভে ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী অংশ নেন। বিক্ষোভকারীরা অবিলম্বে হোসেন আলীকে মুক্তি দিতে পাক দূতাবাসের প্রতি আহবান জানান। মুক্তি না দিলে পাকিস্তানকে চরম পরিণতি ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দেন তারা।

পাকিস্তানে এদিন

৬ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ছাত্র ও দলীয় কর্মীদের উদ্দেশে দেওয়া এক ভাষণে  পাকিস্তান মুসলিম লীগের (কাইয়ুম পন্থী) সভাপতি খান আবদুল কাইয়ুম খান বলেন, 'সম্ভব হলে পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচনের তারিখ এগিয়ে আনা উচিত। পূর্ব পাকিস্তানে উপনির্বাচনের জন্য আর ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে ভারতীয় এজেন্টদের নাশকতা বৃদ্ধি পেয়েছে। উপনির্বাচন শুরু হলে এ নাশকতা আরও বাড়বে। তাই সরকারের উচিত অবস্থা অনুকূলে থাকতেই নির্বাচন এগিয়ে আনা।'  

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৬ নভেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ওয়াশিংটনে মার্টিন লুথার কিং ইন্সটিটিউট পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য ওয়াল্টার জন ট্রয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। ওয়াল্টার জন ট্রয় ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, মার্কিন কংগ্রেসে সবসময় আলোচনার দ্বার উন্মুক্ত রয়েছে। সুতরাং সত্যের জয় অনিবার্য।

পরে ইন্দিরা গান্ধী মার্টিন লুথার কিংয়ের স্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

৬ নভেম্বর পিকিংয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো চীনের প্রধানমন্ত্রী চি ইয়েং লাই, পররাষ্ট্রমন্ত্রী চি ইয়েং ফি এবং সামরিক কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যানের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, 'পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানে চীনের আশু পদক্ষেপ কামনা করি।'

একইসঙ্গে ভারতের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধির বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ করেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।

পরে পিকিংয়ে পাকিস্তান হাইকমিশন সাংবাদিকদের বলে, 'পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ই ভুট্টোর আলোচনায় উঠে এসেছে। চীন আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। চীনের সঙ্গে আমাদের নানা বিষয়ই মূলত আলোচনায় প্রাধান্য পেয়েছে।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৬ নভেম্বর ফেনীর পরশুরাম ও ফুলগাজীতে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের ৫টি কোম্পানি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর বাংকার করে অবস্থান নেয়। মুক্তিবাহিনীর আরেকটি গেরিলা দল সুবেদার লনি মিয়ার নেতৃত্বে পরশুরামের গুথুমা বিওপির পাশে ভোর সাড়ে ৫টার দিকে হানাদার বাহিনীর একটি পেট্রোল দলের উপর হামলা চালায়।

মুক্তিবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে পেট্রোল দলটিও প্রতিরোধ গড়ে তুলে। বিওপির অন্য হানাদার সেনারা চতুর্দিক থেকে লনি মিয়ার দলটিকে ঘিরে ফেলে। এ সময় মুক্তিবাহিনীর আরেকটি বড় দল যোগ দিলে ২ পক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে হানাদার বাহিনী বিওপি থেকে সরে যায়। এ যুদ্ধে হানাদার বাহিনীর বেশ কয়েকজন সৈন্য নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর গেরিলা হাবিলদার শহীদ আহত হন।

৬ নভেম্বর ভোরে কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারিতে প্রায় আড়াই হাজার মুক্তিযোদ্ধা ও  ৪ ব্যাটেলিয়ন ভারতীয় সেনা পাকিস্তানি বাহিনীর  শক্তিশালী ঘাঁটির উপর হামলা চালায়। এ সময় ২ পক্ষের মধ্যে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। কিন্তু মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সামনে টিকতে না পেরে বহু হানাদার সেনা নিহত হয়। কয়েকজন ভারতীয় সেনাও নিহত হন এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন। মুক্তিবাহিনী হানাদারদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র দখল করে নেয়।   

৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ের দুর্গাপুরে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর একটি টহল দলের ওপর হামলা চালায়। প্রায় ১৫ মিনিটের যুদ্ধ শেষে হানাদার বাহিনী পালিয়ে যায়। এ যুদ্ধে এক হানাদার সেনা নিহত হয় এবং ২ জন আহত হয়। একজন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

৬ নভেম্বর পাবনার আটঘরিয়ার খিদিরপুর গ্রামের চন্দ্রাবতী নদী তীরের বংশীপাড়া ঘাট এলাকায় মুক্তিবাহিনীর একটি দলের সঙ্গে হানাদার বাহিনী ও রাজাকারদের যুদ্ধ হয়। প্রায় ৩ ঘণ্টার এ যুদ্ধে ১১ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং ৩০ হানাদার সেনা নিহত হয়।

৬ নভেম্বর সকালে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ২ ইঞ্চি মর্টার ও ৭৩ এমএম রকেট নিয়ে আন্ধারমানিক বিওপিতে অবস্থানরত  হানাদার বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালায়। এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ও হানাদার বাহিনীর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। পরে মুক্তিবাহিনী টিকতে না পেরে  পিছু হটে নিজেদের ক্যাম্পে ফিরে যায়।

৬ নভেম্বর জামালপুরে মুক্তিবাহিনীর একটি দল মেলান্দহ-মহম্মদপুর এলাকায় হানাদার বাহিনীর উপর হামলা চালায়। হানাদার বাহিনীও তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলে। এ সময় হানাদারদের সঙ্গে মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে হানাদার বাহিনীর এক অফিসারসহ ১২ সেনা নিহত হয়। এক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।

৬ নভেম্বর সাতক্ষীরার আশাশুনিতে মুক্তিবাহিনীর একটি দল রাজাকার ক্যাম্পে হামলা চালায়। এ সময় ২ রাজাকার নিহত হয় এবং এক রাজাকার মুক্তিবাহিনীর আত্মসমর্পণ করে।

তথ্যসূত্র:

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র তৃতীয়, সপ্তম, একাদশ, দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড। 

দৈনিক পাকিস্তান ৭ই নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক যুগান্তর ৭ ও ৮ই নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক ইত্তেফাক ৭ই নভেম্বর ১৯৭১

 

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English
US airstrike on Iran

Strikes on Iran mark Trump's biggest, and riskiest, foreign policy gamble

The dramatic US strike, including the targeting of Iran’s most heavily fortified nuclear installation deep underground, marks the biggest foreign policy gamble of Trump’s two presidencies and one fraught with risks and unknowns.

1h ago