মুক্তিযুদ্ধ

৮ নভেম্বর ১৯৭১: ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইন্দিরা গান্ধীর বৈঠক

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ৮ নভেম্বর গুরুত্বপূর্ণ ও ঘটনাবহুল একটি দিন। এদিন ফ্রান্সের প্যারিসে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদু এবং প্রধানমন্ত্রী চাবান দেলমাসের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী। এ সময় ইন্দিরা গান্ধী ২ দেশের মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার আহ্বান জানান।

তিনি প্রেসিডেন্ট জর্জ পম্পিদুকে বলেন, 'বাংলাদেশে পাকিস্তান যে নৃশংস হামলা চালিয়েছে, তা কল্পনাতীত। এ সমস্যা কেবল কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হতে পারে না। আর পাকিস্তান এখন যে সমাধানের কথা বলছে, তা বাংলাদেশের মানুষের মতামত হলে ভারতের আপত্তি নেই। জনগণ যা চায়, তা-ই যেন করা হয়। জনগণের কাছে যা গ্রহণযোগ্য হবে, তা-ই যদি হয়, তবে সমাধান আশা করতে পারি আমরা।'

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিদু ইন্দিরা গান্ধীকে আশ্বস্ত করে বলেন, 'ফ্রান্স সবসময় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানে বিশ্বাসী। আর যে অঞ্চলে সমাধানের পরিকল্পনা করা হবে, সেখানকার বাসিন্দাদের মতামতই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।'

ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী চাবান দেলমাসের সঙ্গে সোয়া ১ ঘণ্টা বৈঠক করেন ইন্দিরা গান্ধী। এ বৈঠকে প্রধানত শরণার্থী সমস্যা ও ফ্রান্সের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের উন্নয়ন নিয়ে আলোচনা হয়।

চাবান দেলমাস ইন্দিরা গান্ধীকে বলেন, 'পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে ফ্রান্স। এখন সরকারি বা বেসরকারিভাবে পাকিস্তানে কোনো অস্ত্রের চালান পাঠাচ্ছে না ফ্রান্স।' 

ভারতে এদিন

৮ নভেম্বর ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ১ কোটি ৩১ লাখ ২০ হাজার টাকা সহায়তা দেয় জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা। দিল্লিতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার শরণ সিংয়ের হাতে এ টাকার চেক তুলে দেন জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খাঁ। এ সময় শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনারকে শরণার্থীদের অবস্থা ব্যাখ্যা করা হয়। পরে ভারতের শ্রমমন্ত্রী আর কে খাদিলকর, স্বাস্থ্যমন্ত্রী উমা শঙ্কর দীক্ষিত, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নীতিনির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান ডি পি ধর, মন্ত্রিসভার সচিব টি স্বামী নাথন, অর্থ সচিব আইজি প্যাটেলসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিবরা প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খাঁর সঙ্গে বৈঠক করেন।

৮ নভেম্বর পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য সরকার এক বিবৃতিতে বলে, ভারতে আশ্রয় নেওয়া শরণার্থীর সংখ্যা এখন ৯৬ লাখ ৮ হাজারে দাঁড়িয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী  শিবিরে এখন আছেন ৬৬ লাখ ১০ হাজার শরণার্থী। শরণার্থী শিবিরের বাইরে আছেন ২৫ লাখ ৪৩ হাজার শরণার্থী। এ শরণার্থীদের মধ্যে ৪ লাখ ৫৫ হাজার জনকে ত্রিপুরা, আসাম, বিহার, মধ্য প্রদেশ ও উত্তরপ্রদেশের ১৭টি কেন্দ্রীয় অস্থায়ী শিবিরে রাখা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়ার ছায়া ষষ্ঠ কেন্দ্রীয় অস্থায়ী শিবিরে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে ৩ হাজার ৯০২ শরণার্থীকে। নভেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৪ হাজার শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে।

পাকিস্তানে এদিন

৮ নভেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সাময়িকী নিউজ উইককে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, 'ভারত বিদ্রোহীদের পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশে সাহায্য করে চলেছে। ভারতীয় টেনিংপ্রাপ্ত বিদ্রোহীরা পূর্ব পাকিস্তানের নাশকতামূলক কাজে জড়িত। আমি অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছি। ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখলের চেষ্টা করে, তাহলে যুদ্ধ বাধবেই। সে যুদ্ধ কেবল পূর্বাঞ্চলে সীমাবদ্ধ থাকবে না এবং সে যুদ্ধে নিশ্চয়ই আমি পরাজিত হব না। যুদ্ধ বাধলে চীন যে আমাকে অস্ত্র দেবে, সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।'

প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় ৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৪ বাঙালি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে চাকরি থেকে বহিষ্কার করেন। এ ৪ কর্মকর্তার মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক সমন্বয় ও বৈদেশিক সাহায্য বিভাগের যুগ্ম সচিব এম এ রশীদ, পরিকল্পনা বিভাগের আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক শাখার প্রধান মোহাম্মদ আবদুস সাত্তার, নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনের সহকারি প্রেস এ্যাটাচি মাকসুদ আলী।

আন্তর্জাতিক মহলে এদিন

৮ নভেম্বর প্রভাবশালী মার্কিন সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমসের এক বিশেষ প্রতিবেদনে বলা হয়, 'মার্কিন সরকার পাকিস্তানে ৩৬ লাখ ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বাতিল করেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের ঠিক পরেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তান সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য ও অস্ত্র ব্যবহার করছে বলে দীর্ঘদিনের যে অভিযোগ ছিল, তা প্রমাণিত হয়েছে। অস্ত্রের চালান বন্ধ করার মাধ্যমে ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের বড় ফাটল বন্ধ হতে পারে। এর ফলে মার্কিন কংগ্রেসও শান্ত থাকবে। সম্ভবত জেড এ ভুট্টো আন্দাজ করতে পেরেছিলেন, মার্কিন সরকার যে কোন মুহূর্তে পাকিস্তানকে অস্ত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আর সেজন্যই তিনি হঠাৎ পিকিং সফরে গেছেন।

এ ছাড়া মার্কিন সরকার পাকিস্তানে সামরিক সরঞ্জাম রপ্তানি বন্ধ করলে, পাকিস্তানের হাতে থাকা প্রায় ২৩ লাখ ডলার মূল্যের সামরিক সরঞ্জাম আমদানির বৈধ লাইসেন্স অকার্যকর হয়ে যাবে।'

৮ নভেম্বর পিকিংয়ে পাকিস্তানের প্রতিনিধি দলের সম্মানে আয়োজিত ভোজসভায় চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই বলেন, 'চীন সবসময় পাকিস্তানের সহযোগী দেশ। ২ দেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে খুব সন্তোষজনক আলোচনা হয়েছে।' 

এদিন ভোজসভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে চীন সফররত পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো সাংবাদিকদের বলেন, 'শান্তি পরিষদে স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে ভারত-পাকিস্তানের এ উত্তেজনার মধ্যে সেগুলো উত্থাপন করেও এখন আর কোনো লাভ হবে না। তবে শান্তি পরিষদ যদি চায়, পাকিস্তান বিষয়টিকে স্বাগত জানাবে।'

এদিন বিকেলে জুলফিকার আলী ভুট্টো ইসলামাবাদের উদ্দেশে পিকিং ত্যাগ করেন।  

আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এদিন

৮ নভেম্বর ব্রিটিশ গণমাধ্যম লন্ডন টাইমসের সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, 'পূর্ব বাংলা বিষয়ে চীন সর্বশেষ যে বিবৃতি দিয়েছে, তাতে বোঝা যায় যে চীন পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে কোনো কথা দিতে অনিচ্ছুক।'

৮ নভেম্বর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্যা টাইমসের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'পিকিংই একমাত্র রাজধানী, যেখানে পাকিস্তান প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছে। পাকিস্তানের বক্তব্য কতটা দুর্বল, এ থেকে তা বোঝা যায়। চীন ও পাকিস্তানের যৌথ বিবৃতি ছাড়া ভুট্টোকে পিকিং থেকে ফিরে আসতে দেখে মনে হচ্ছে, চীন এখন কোনো কথা দিতে অনিচ্ছুক।'

৮ নভেম্বর ব্রিটিশ সংবাদপত্র দ্যা গার্ডিয়ানের সম্পাদকীয়তে বলা হয়, 'ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হলে পাকিস্তান একেবারেই নিঃসঙ্গ ও অভিযুক্ত হবে। ইয়াহিয়া বিরোধিতা দ্রুত বাড়ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের জেনারেলরা হিংস্রতার চরম সীমায় এসে পৌঁছেছেন।'  

দেশব্যাপী এদিন

৮ নভেম্বর জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর মিয়া তোফায়েল সাংবাদিকদের বলেন, 'দেশের যুদ্ধাবস্থায় জামায়াতে ইসলামী যে কোনো দলকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত রয়েছে।' মন্ত্রিসভায় জামায়াতের অংশগ্রহণ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি  বলেন, 'আমরা ক্ষমতা লাভের জন্য নয়, দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য সরকারের দায়িত্বে অংশগ্রহণ করেছি।'

দেশব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ

৮ নভেম্বর চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে মুক্তিবাহিনীর ৪র্থ বেঙ্গল ও মুজিব ব্যাটারির মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হেয়াকো ঘাঁটিতে আক্রমণ চালান। এ সময় ঘাঁটিতে থাকা অর্ধশতাধিক সেনা প্রতিরোধ গড়ে তুললে মুক্তিবাহিনী ও হানাদারদের সংঘর্ষ হয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার যুদ্ধের এক পর্যায়ে মুক্তিবাহিনী ওয়্যারলেসে আর্টিলারিকে খবর দেয়। আর্টিলারি হামলা শুরু হলে হানাদার বাহিনী ফটিকছড়ি বাজারের দিকে পালিয়ে যায়। পরে মুক্তিবাহিনী হেয়াকো বাজার দখল করে নেয়।

৮ নভেম্বর দশম ইস্ট বেঙ্গলের মুক্তিযোদ্ধারা ফেনী থেকে বিলোনিয়া রেলস্টেশন পর্যন্ত দখলের জন্য এগিয়ে গেলে হানাদার বাহিনীর স্যাবর জেটগুলো বেশ কয়েকটি গ্রামে বিমান হামলা চালায়। এ সময় নিরীহ গ্রামবাসীদের বহু বাড়িঘর বিধ্বস্ত হয়। এক পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধারা এমএমজি দিয়ে স্যাবর জেটগুলোতে গুলি করতে শুরু করে।  এ সময় হাবিলদার হাশমতের মেশিনগানের কয়েকটি গুলি একটি স্যাবর জেটে লাগে এবং সেটি কুমিল্লায় ভূপাতিত হয়।

৮ নভেম্বর ৮নং সেক্টরে হানাদার বাহিনীর একটি দল মুক্তিবাহিনীর কায়খালী অবস্থানের উপর তীব্র আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধারা পাল্টা আক্রমণ চালালে উভয় পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু  হয়। প্রায় ২ঘণ্টার এ সংঘর্ষে ২ জন হানাদার সেনা নিহত হয় এবং বেশ কয়েকজন সেনা আহত হয়।

৮ নভেম্বর যশোরের মসল্লায় মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল হানাদারদের জন্য অ্যামবুশের ফাঁদ পাতে। এদিন দুপুরে হানাদার বাহিনীর একটি গাড়ি ওই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় মুক্তিবাহিনীর অ্যামবুশের আওতায় এলে রাস্তায় পাতা মাইনে গাড়িটি উড়ে যায়। গাড়িতে থাকা হানাদার বাহিনীর চালক ও ২ সেনাসহ মোট ৩ জন  নিহত হয়।

৮ নভেম্বর খাগড়াছড়ির রামগড়-করেরহাট সড়কে মুক্তিবাহিনীর একটি দল হানাদার  বাহিনীর টহল দলকে অ্যামবুশ করে। একাধারে হাত বোমা নিক্ষেপ করলে হানাদারদের টহল দলের ৪ সেনা নিহত হয়। ২ সেনা আহত হয়ে পালিয়ে যায়। 

৮ নভেম্বর পাবনায় হানাদার বাহিনীর একটি দল মুক্তিবাহিনীর শাহবাজপুর ঘাঁটিতে হামলা চালায়। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সংঘর্ষে  ৩ হানাদার সেনা নিহত হয় এবং  ৩ জন আহত হয়।

তথ্যসূত্র:

 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র সপ্তম, একাদশ দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ খণ্ড 

দৈনিক পাকিস্তান ৯ই নভেম্বর ১৯৭১

দৈনিক অমৃতবাজার পত্রিকা ৯ ও ১০ই নভেম্বর ১৯৭১

আহমাদ ইশতিয়াক

[email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Elections entirely Bangladesh's internal matter: Shafiqul

'Wounds caused by crimes against humanity perpetrated by AL still fresh,' says CA's press secretary

1h ago