নগরীর প্রথম পাঠাগার রামমোহন রায় লাইব্রেরি

রাজধানী ঢাকার প্রথম পাঠাগার কোনটি? এর উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই বলবেন, নর্থব্রুক হল লাইব্রেরি। কিন্তু, এটি প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় রামমোহন রায় লাইব্রেরি। তবে কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যেতে বসছে।
রামমোহন রায় লাইব্রেরি। ছবি: পলাশ খান

রাজধানী ঢাকার প্রথম পাঠাগার কোনটি? এর উত্তরে বেশিরভাগ মানুষই বলবেন, নর্থব্রুক হল লাইব্রেরি। কিন্তু, এটি প্রতিষ্ঠার ১৩ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় রামমোহন রায় লাইব্রেরি। তবে কালের বিবর্তনে এটি এখন হারিয়ে যেতে বসছে।

ধুলোর আস্তরণ জমেছে লাইব্রেরির বইয়ের পাতায়। জরাজীর্ণ বইগুলোর বাঁধাইও ছুটে যাচ্ছে। মূল ভবনটিও এখন পরিত্যক্ত। করোনার কারণে লাইব্রেরিটির অবস্থা আগের চেয়ে আরও খারাপ। যার ফলে এখন আর খোলে না লাইব্রেরির দরজা। শুধুমাত্র পাঠক এলেই খুলে দেওয়া হয়।

রাজধানীর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পেরিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। এটি পেরিয়ে যেতেই বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজ। এখানেই অবস্থিত রামমোহন রায় লাইব্রেরি। ১৮৬৯ সালে ব্রাহ্ম মন্দির প্রতিষ্ঠার সময়ই ব্রাহ্ম সমাজের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক অভয় চন্দ্র দাশ মন্দির ভবনে রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করেন।

রামমোহন রায় লাইব্রেরি। ছবি: পলাশ খান

১৮৭১ সালের ১৮ জানুয়ারি দ্বিতল ভবন তৈরি করে সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন পাঠাগারটি। তা এখন আর সেখানে নেই। ভবনটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় রাজা রামমোহন রায় পাঠাগার সেখান থেকে সরিয়ে আবারও মন্দির ভবনে নেওয়া হয়েছে।

১৯২৬ সালে এখানে এসেছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। দীর্ঘ সময় এ পাঠাগারে সময় কাটিয়েছিলেন জ্ঞানতাপস ও বহু ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। বিখ্যাতজনদের মধ্যে আরও এসেছিলেন কবি বুদ্ধদেব বসু, অধ্যাপক মুহাম্মদ আবদুল হাই, কাজী মোতাহার হোসেন, বেগম সুফিয়া কামাল, কবি শামসুর রাহমান।

১৯২৪ সালে রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ এখানেই লাবণ্য গুপ্তের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। এই পাঠাগারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন জীবনানন্দের মা কবি কুসুমকুমারী দেবীও।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাঠাগারটি। এখানে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করেছিল। লুট হয়ে যায় শত বছরের পুরনো মূল্যবান নথিপত্র, সাময়িকী ও বই। এর আগে পাঠাগারের সংগ্রহে ছিল প্রায় ৩০ হাজার বই। কিছু বই ছিল একেবারেই দুর্লভ। সে সময় প্রতিদিন গড়ে ১০০ থেকে ১৫০ পাঠক এই পাঠাগারে আসতেন।

স্বাধীনতার পর আবার পাঠাগারটি চালু করা হয়। সে থেকেই পাঠাগারটির ভগ্ন দশা শুরু। রামমোহন রায় পাঠাগারের মূল দ্বিতল ভবনটি জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল। যেকোনো সময় রাস্তার ওপর ধসে পড়তে পারে— এ আশঙ্কায় রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) ২০০৪ সালের ১৯ এপ্রিল ৭ দিনের মধ্যে ভবনটি ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয়।

২০০৫ সালে তৎকালীন ব্রাহ্ম সমাজের আচার্য ও ট্রাস্টি প্রাণেশ সমাদ্দার উচ্চ আদালতে রিট করে ঐতিহ্যবাহী এ ভবনটিকে পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্তির আবেদন করেন। পাশাপাশি সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে একই দাবি জানিয়ে আরেকটি আবেদন করা হয়। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ২০০৯ সালে এক প্রতিবেদনে বলে, পুরাকীর্তি আইনের আওতায় এ নিদর্শনটি প্রাচীন কীর্তি হিসেবে গণ্য করা যায় না। তা ছাড়া ভবনটি পুরাকীর্তি হিসেবে সংরক্ষণেরও উপযোগী নয়।

তবে একই বছর অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশন জানায়, রাজউকের করা ঢাকার ঐতিহাসিক ও নান্দনিক স্থাপনার তালিকার ৯৩টি স্থাপনার মধ্যে এই পাঠাগারটিও রয়েছে। সেজন্য রাজউকের নগর উন্নয়ন কমিটির অনুমোদন ছাড়া তালিকাভুক্ত স্থাপনার আংশিক কিংবা সম্পূর্ণ অপসারণ, পুনর্নির্মাণ ও ও পরিবর্ধন করা যাবে না।

বর্তমানে ব্রাহ্ম মন্দির ভবনের দোতলার একটি অংশে চালু রয়েছে পাঠাগারটি। নড়বড়ে কাঠের পাটাতন আর অপ্রশস্ত খাড়া সিঁড়ি পেরিয়ে ঢুকতে হয় সেখানে। দিনের বেলাতেও আলো না জ্বালালে নজরে পড়ে না কোনো কিছুই।

সেখানে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি। আরও আছে কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, জসীমউদ্‌দীন ও সুফিয়া কামালের মতো বরেণ্য সাহিত্যিকদের আলোকচিত্র। নজর কাড়বে দেয়ালে টাঙিয়ে রাখা বিশ্বের বড় বড় সব লাইব্রেরির আলোকচিত্রও।

বর্তমানে পাঠাগারটিতে ৫০০ থেকে ৬০০ বই আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিশ্ববাণী প্রকাশিত মহাভারতের ২১ পর্ব, বিশ্বভারতী প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলী, ব্রাহ্ম ধর্মভিত্তিক প্রায় সব বই, রাজা রামমোহন, স্বামী বিবেকানন্দ রচনাবলী, আছে সব পবিত্র ধর্মগ্রন্থও।

পাঠাগারটির বিষয়ে কথা হয় বাংলাদেশ ব্রাহ্ম সমাজের সাধারণ সম্পাদক রণবীর পাল রবির সঙ্গে। দ্য ডেইলি স্টারকে তিনি বলেন, '২০০৪ সাল থেকে এ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় পাঠাগারটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় ১০ বছর বন্ধ থাকার পর ২০১৪ সালে মন্দির ভবনে আবারও চালু হয় পাঠাগারটি। কিন্তু, পাঠাগারের আগের সে জৌলুস নেই। পাঠক না পাওয়ায় আবারও বন্ধ করে দেওয়া এটি।'

তিনি আরও বলেন, 'করোনার কারণে এখানে পাঠকের সংখ্যা অনেক কমে যায়। বর্তমানে পাঠক আসলে আমরা লাইব্রেরির দরজা খুলে দিই। তবে এখন আর সাধারণ পাঠকরা আসেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষকরাই মূলত এখানে আসেন।

'এখনও যে কেউ চাইলে পাঠাগারটিতে প্রবেশ করতে পারেন, বই পড়তে পারেন। সমাজের সর্বস্তরের পাঠকদের অনুরোধ করছি পাঠাগারটিতে আবারও আসার জন্যে,' যোগ করেন তিনি।

Comments

The Daily Star  | English

Fire breaks out at Dhaka Shishu Hospital

Five fire engines are trying to douse the blaze that originated around 1:45pm at the cardiology ward of the hospital

20m ago