আমার পাঁচটি প্রিয়পাঠ্য

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। ফাইল ছবি

জরুরি ও প্রভাবশালী বইগুলোর মধ্যে ৫টিকে বেছে নিতে হলে আমি নাম করব—রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গোরা, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রবন্ধের বই, উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট, ফিওদর দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এবং কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো। এই রচনাগুলোর একটির সঙ্গে আরেকটির বিস্তর পার্থক্য। সময়ের দিক থেকে যেমন, বিষয়বস্তুর দিক থেকেও। তবে এদের মধ্যে ঐক্যের একটি জায়গা আছে। আর ঐক্যের জায়গাটি হলো- এই প্রতিটা বইয়ের মধ্যে গভীর দার্শনিকতা আছে, তারুণ্য আছে।

গোরা

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

রবীন্দ্রনাথ অনেক ধরনের রচনা লিখেছেন, উপন্যাসও লিখেছেন। কিন্তু আমার মতে তার মধ্যে শ্রেষ্ঠ উপন্যাস হচ্ছে গোরাগোরার কেন্দ্রে আছে গৌরেমাহন। তার গায়ের রং একটু উদ্ধত রকমের ফরসা। ছয় ফুট লম্বা, গলার স্বর গম্ভীর এবং তার চলাফেরা অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। এই তরুণ একটা দায়িত্ব নিয়েছে। সেই দায়িত্বটা হলো, সে নিজেকে হিন্দু মনে করে, ব্রাহ্মণ বলে জানে এবং এই সমাজে হিন্দুত্ব একটা অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে, সেটাকে সে সম্পূর্ণতা দেবে। অন্যদিকে তার আকাঙ্ক্ষা হলো, সে ভারতবর্ষকে চিনবে। এই কাজটা করতে গিয়ে সে নানা রকম অসুবিধার মধ্যে পড়ছে।

সেটা ইংরেজ শাসনের সময়। তারপর দেখা গেল যে সে জেলখানায় গেছে। এক মাসের বেশি সে জেলখানায় ছিল। জেলখানায় কষ্ট হয়েছে। কষ্টটাকে সে বড় মনে করেনি। সে মনে করেছে, ফিরে এসে সে প্রায়শ্চিত্ত করবে এবং সে মহা আয়োজন করছে প্রায়শ্চিত্তের। তার বাবা ভীষণ রকম সংস্কারাচ্ছন্ন। ইংরেজদের সঙ্গে ওঠা-বসা ছিল। বাবা তাকে প্রায়শ্চিত্ত করতে নিষেধ করেছেন। যেদিন সে প্রায়শ্চিত্ত করবে, সেদিন পিতা অসুস্থ হয়ে পড়লেন। মারা যাবেন মনে করে পিতা গোরাকে তার জন্মকাহিনি বললেন- গোরা তাদের সন্তান নয়। গোরা সিপাহি অভ্যুত্থানের সময় জন্ম নিয়েছে। তার বাবা-মা আইরিশ। বাবা যুদ্ধের সময় মারা গেলেন। মা এই সন্তানকে জন্ম দিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মারা গেলেন।

সেই মুহূর্তে 'গোরা' আবিষ্কার করল যে সে হিন্দু তো নয়ই, এমনকি ভারতবর্ষীয়ও নয়। এই যে ধাক্কা- সেটা গোরাকে মুক্ত করল। এবং মুক্ত ভারতবর্ষকে সে পেয়ে গেল। এই তরুণ জানত না সে কে, এবং জানতে চেষ্টা করে সে নিজেকে আবিষ্কার করল।

হ্যামলেট

উইলিয়াম শেক্সপিয়ার

উইলিয়াম শেক্সপিয়ারের হ্যামলেট নাটকটাও হ্যামলেট নামে এক তরুণকে নিয়ে লেখা। এই তরুণেরও একটা দায়িত্ব পড়ে গেছে কাঁধে। দায়িত্বটা হচ্ছে তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়া। কিন্তু এই পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নিতে গিয়ে তরুণ দেখতে পেল তার পিতার যে ঘাতক, সে একজন ব্যক্তি ঠিকই; কিন্তু সেই ব্যক্তির সঙ্গে তার মাও জড়িত। সে আরও দেখতে পেল, ভবিষ্যতে যে মেয়েটিকে সে বিয়ে করতে চায়, সেও এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে এইভাবে: যার শ্বশুর হওয়ার কথা, সেই লোকটি রাজার পারিষদ এবং রাজার পক্ষে তার ওপর গুপ্তচরবৃত্তি করছে। তার দুই বাল্যবন্ধুও রাজার সঙ্গে কাজ করছে। ওই রাজাই কিন্তু ঘাতক।

হ্যামলেট দেখতে পাচ্ছে যে সে একাকী। তার বিরুদ্ধে যারা লড়ছে তারা অন্যায়েরই প্রতিভূ। অর্থাৎ তার যুদ্ধটা অন্যায়ের বিরুদ্ধে এবং সে একা লড়াই করছে। সে সাহসী, কিন্তু লড়তে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছে। কী করবে? এই দ্বিধা তার চরিত্রের মধ্যে আছে। শেষ পর্যন্ত সে অবশ্য প্রতিশোধ নিতে পারল; কিন্তু তাতে তার নিজেরও মৃত্যু হলো এবং এটা বোঝা গেল যে একাকী এই বিরাট অন্যায়ের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব না।

ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট

ফিওদর দস্তয়ভ্স্কি

ফিওদর দস্তয়ভ্স্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশমেন্ট এক মহাকাব্যিক উপন্যাস। এই উপন্যাসেও নায়ক এক তরুণ। 'হ্যামলেট'-এর মতোই। হ্যামলেট ছাত্র ছিল দর্শনের, দস্তয়ভ্স্কির নায়ক রাস্কলনিকভ হচ্ছে আইনের ছাত্র। রাস্কলনিকভ পিটার্সবার্গে থাকে। পিটার্সবার্গ তখন অত্যন্ত উন্নত প্রাচুর্যপূর্ণ শহর। কিন্তু সেখানে গরিব মানুষের সংখ্যাও কম নয়। রাস্কলনিকভ মেধাবী তরুণ। সে দায়িত্ব মনে করেছে এই সমাজব্যবস্থাটা বদল করতে হবে। সে দেখতে পাচ্ছে চতুর্দিকে মানুষগুলো এখানে কীটপতঙ্গে পরিণত হয়েছে।

সে সময় নেপোলিয়ান একজন বীর হিসেবে তরুণদের সামনে আছেন। জার্মান দার্শনিক নিটশে অতিমানবের কথা বলেছেন, তো এই তরুণ নিজেকে অতিমানব হিসেবে ভাবছে। সে অত্যন্ত দরিদ্র অবস্থার মধ্যে আছে, একটা চিলেকোঠায় থাকে। অনেক সময় খাওয়াও পায় না। সে বন্ধক রেখেছে...প্রথমে বন্ধক রাখল তার হাতের একটি আংটি। পরে বন্ধক রাখতে গেল তার একটি ঘড়ি, যা বাবা তাকে দিয়েছিল। বাবা নেই। মা আর বোন আছেন। তাদের সে কোনো সাহায্যই করতে পারছে না। যে মহিলার কাছে বন্ধক দিচ্ছে, সে একটা ডাইনির মতো। সে নিষ্ঠুর, সে উকুনের মতো রক্তশোষক, সুদখোর।

রাস্কলনিকভ ভাবল, এই রকম লোকের তো এখানে বেঁচে থাকার কোনো অধিকার নেই। তারা তো সমাজের শোষক। ওই মহিলাকে সে মেরে ফেলল। একা পেয়ে। এবং মারতে গিয়ে আবার তার বোনও এসে হাজির হয়েছিল, ওই বৃদ্ধাকেও সে মেরে ফেলেছে। এরপরে তার মধ্যে অপরাধবোধ জেগেছে। উপন্যাসের শেষটা খুবই অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। শেষ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে সে ধর্মের পথে চলে গেছে। এই সমাজটাকে বদলানোর দায়িত্ব সে নিয়েছিল। সেটি থেকে ধর্মের পথে গেল। গোরা উপন্যাসের সমাপ্তি মিলনাত্মক। হ্যামলেট-এর সমাপ্তি মৃত্যুর মধ্য দিয়ে। এখানে সমাপ্তিটা মিলনাত্মক এবং এখানে দেখা যাচ্ছে, তরুণ রাস্কলনিকভ যেন পুনর্জন্ম লাভ করল।

প্রবন্ধ সমগ্র

বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধগুলো অসামান্য। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রবন্ধ সংকলনের দ্বিতীয় খণ্ডে সাম্যের ওপর একটা বড় লেখা আছে। যেখানে তিনি সাম্যের কথা বলছেন, অধিকারের কথা বলছেন। বঙ্গদেশের কৃষকের কথা আছে। এই কৃষকের দুর্দশার যে ছবি সেটা তিনি দেখাচ্ছেন। সেখানে কমলাকান্তের দপ্তর আছে, নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ আছে, চিন্তামূলক প্রবন্ধ আছে। তবে যেখানে বঙ্কিমচন্দ্র খুব তাৎপর্যপূর্ণ, সেটা হচ্ছে- তার মধ্যেও তারুণ্য আছে। বঙ্কিমও এই ব্যবস্থার বদল চান, তিনি তারুণ্যের পক্ষে। তিনি বুঝতে পারছেন যে ব্রিটিশ শাসনকে শেষ করা দরকার। কিন্তু তিনিও পথ খুঁজে পাচ্ছেন না।

শেষ পর্যন্ত তিনি সাম্য বইটি প্রত্যাহার করে নিলেন। কেননা সাম্যের পথ থেকে তিনি সরে গেছেন। ওই যে রাস্কলনিকভ ধর্মের দিকে চলে গেল, বঙ্কিমচন্দ্রও ধর্মের দিকে চলে যাচ্ছেন। শেষ জীবনে তিনি কৃষ্ণচরিত লিখলেন এবং সেই কৃষ্ণকেই আদর্শ মনে করলেন। আবার ওই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বিরুদ্ধে লিখছেন, বঙ্কিমচন্দ্র বলছেন যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কিন্তু উঠিয়ে দেওয়া যাবে না, তাহলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেবে। এবং পরিষ্কারভাবে একটা কথা বলেছেন- আমরা সামাজিক বিপ্লবের অনুমোদক নই।' তো এই যে পশ্চাদপসরণ, এটা আমার কাছে খুব তাৎপর্যপূর্ণ মনে হয়।

দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস

কার্ল মার্কস ও ফ্রেডরিখ এঙ্গেলসের লেখা দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো ইশতেহার হিসেবে লেখা হয়েছিল। যখন মার্কস আর এঙ্গেলস দু'জনে মিলে লিখছেন, খুবই তরুণ তারা। মার্কসের বয়স তখন ২৯। এঙ্গেলসের বয়স ২৭। কিন্তু তারা ইতিহাস অধ্যয়ন করেছেন। তারা যে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন, সেটা দ্য কমিউনিস্ট মেনিফেস্টোর প্রথম বাক্যেই বলা হয়েছে- এই পর্যন্ত যত ইতিহাসের সৃষ্টি হয়েছে, তার সবই হয়েছে শ্রেণিসংগ্রামের ইতিহাস। এবং শেষ করছেন এই কথা বলে যে এই সামাজিক বিপ্লব ছাড়া মানুষের মুক্তি হবে না। মেহনতি মানুষেরাই মুক্তি আনবে। এবং সেই মুক্তি হবে সব মানুষের মুক্তি। সেখানে মেহনতি মানুষের কিছু হারানোর নেই শৃঙ্খল ছাড়া।

এই যে ৫টি বই আমি দেখলাম, এর মধ্যে তারুণ্য আছে। এই পাঁচটার মধ্যে সমাজ পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা আছে। তরুণেরা এখানে শিখবেন, বাস্তবতাকে কীভাবে অধ্যয়ন করতে হয়। বিশ্লেষণ করতে হয়। তাদের পক্ষে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। যেমন হ্যামলেট কেন পারল না? কারণ হ্যামলেট এই ব্যবস্থাটাকে একাকী বদল করতে চেয়েছিল। রাস্কলনিকভ কেন পারল না? রাস্কলনিকভ চলে গেল ধর্মের দিকে। আবার যে গোরা, সে ধর্মের মধ্যেই বিকশিত হচ্ছে। সে ধর্মকে প্রতিষ্ঠিত করবে। শেষ পর্যন্ত তার কাছে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- ধর্মের চেয়ে জীবন বড়। এইটাও তরুণদের কাছে আসবে। সে কিন্তু ধর্ম থেকে বেরিয়ে এসেছে, তার যাত্রাটা ধর্মনিরপেক্ষতার দিকে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। আর বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা থেকে এই শিক্ষা আমরা পাচ্ছি- স্বাধীনতার জন্য আকাঙ্ক্ষাটা যথেষ্ট নয়, সাম্যও প্রয়োজন। যেটা বঙ্কিমচন্দ্র স্বীকার করছেন।

বঙ্কিমচন্দ্র তার কালে শিক্ষিত ব্যক্তিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিলেন। অত্যন্ত শক্তিশালী লেখক। সেই লেখক যখন মুখোমুখি হচ্ছেন সমাজ পরিবর্তনের সম্ভাবনার দিকে, তখন তিনি যে পিছিয়ে যাচ্ছেন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত থাকুক বলছেন, সাম্য প্রত্যাহার করে নিচ্ছেন; এগুলো থেকে শেখার বিষয় হচ্ছে- একাকী যেমন পারা যাবে না, তেমনি সুস্পষ্ট লক্ষ্য ছাড়াও পারা যাবে না। লক্ষ্যটা হচ্ছে সমাজ পরিবর্তন। আর মার্কস-এঙ্গেলসের কমিউনিস্ট মেনিফেস্টো এই সমাজ পরিবর্তনের জায়গাটিতেই নিয়ে এসেছে। এই পাঁচটা বইকে যদি আমি সাজাই, তাহলে একটা সিদ্ধান্তের দিকে আমি পৌঁছাতে পারি। অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম, সে সংগ্রামটা কেবল ব্যক্তিগত হলে চলবে না, সমষ্টিগত হতে হবে। তার লক্ষ্য হতে হবে সুনির্দিষ্ট-ব্যবস্থাটার পরিবর্তন। একজন-দুজন-পাঁচজন মানুষকে পরিবর্তন করে আমরা মানুষের মুক্তি আনতে পারব না। নিজের পঠনকে আমি এভাবেই সাজাই।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

5h ago