খুঁজে আনা অজানা কাহিনী

বিদেশে বায়োগ্রাফার বা জীবনীকার পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের দেশে এখনো এর প্রচলন ঘটেনি এবং সব সময় তা নির্মোহ না-ও হতে পারে। আবার ইতিহাসের চরিত্র যখন হন কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, তখন বাইরে থেকে একজন গবেষক বা লেখকের সেখানে পৌঁছানো যেমন কঠিন, তেমনি পৌঁছাতে পারলেও তা হয়ে যেতে পারে ফরমায়েশি রচনা। তাই অজানা গুরুত্বপূর্ণ সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বই রচনার সময় লেখক-গবেষককে খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়।

বিদেশে বায়োগ্রাফার বা জীবনীকার পেশা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আমাদের দেশে এখনো এর প্রচলন ঘটেনি এবং সব সময় তা নির্মোহ না-ও হতে পারে। আবার ইতিহাসের চরিত্র যখন হন কোনো রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, তখন বাইরে থেকে একজন গবেষক বা লেখকের সেখানে পৌঁছানো যেমন কঠিন, তেমনি পৌঁছাতে পারলেও তা হয়ে যেতে পারে ফরমায়েশি রচনা। তাই অজানা গুরুত্বপূর্ণ সংগৃহীত তথ্য নিয়ে বই রচনার সময় লেখক-গবেষককে খুব সাবধানে অগ্রসর হতে হয়।

সরাফ আহমদ সেই কাজই করেছেন তার '১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন' বইটিতে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর প্রবাসে থাকা তার ২ কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা কেমন করে সেই দুঃসহ দিনগুলো পার করেছিলেন, তথ্য-উপাত্তসমেত এ বইয়ে আছে সেই বৃত্তান্ত। দীর্ঘ সাড়ে ৩ দশক ধরে জার্মানিতে বসবাসরত সরাফ আহমেদ এতে তুলে এনেছেন অজানা তথ্য, উদ্ধার করেছেন দলিলপত্র, ইন্দিরা গান্ধী, ওয়াজেদ মিয়া, শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার অপ্রকাশিত চিঠি, প্রেস ক্লিপিংস ও ছবি। বাংলায় অনুবাদ করেছেন আর্কাইভে রাখা জার্মান সংবাদপত্রে প্রকাশিত নিবন্ধ। লেখক ফোন ও ই-মেইলে বিভিন্নজনের সঙ্গে যোগাযোগ করলে একটির পর একটি নতুন সূত্রের সন্ধান পেতে থাকেন। বার্লিন, বন, ফ্রাঙ্কফুর্ট, কার্লসরুয়ে, ভিয়েনা, ব্রাসেলস, আমস্টারডাম, ওয়াশিংটন, বেঙ্গালুরু, ঢাকা—এসব জায়গায় সেই সময়ের ঘটনার সাক্ষী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের খুঁজে বের করেছেন তিনি।

জার্মান সাংবাদিক যারা ১৯৭৫ সালের ১৬ আগস্ট বনে বঙ্গবন্ধু কন্যাদের সঙ্গে সাক্ষাত করেন, তাদের সঙ্গেও লেখক যোগাযোগ করেছেন। তখন মিডিয়া মহলে রটে গেলো শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাদের বনে রাষ্ট্রদূতের বাসায় বন্দী করে রাখা হয়েছে। কিন্তু তাদের যে বন্দী করা হয়নি, তা প্রমাণ করতে ২ বোনকে সাংবাদিকদের সামনে হাজির করতে হলো রাষ্ট্রদূতকে। সাংবাদিকরা যখন এ বাসায় উপস্থিত, তখনও ওপর তলা থেকে কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছিল। দ্য ভেল্ট পত্রিকার প্রতিবেদনে লেখা হয়-

'শোকে মুহ্যমান শেখ হাসিনা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলেন। তার পরনে হলুদ পাড়ের সবুজ রংয়ের শাড়ি। ডান হাত দিয়ে তিনি আঁচল ধরে আছেন। বাম হাতে থাকা সাদা রুমাল দিয়ে বারবার চোখ মুছছেন। তার পেছন পেছন নেমে আসলেন ছোট বোন  শেখ রেহানা। তিনিও ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তারা দুজনেই ড্রইংরুমের খয়েরি রংয়ের সোফাটিতে বসলেন। তাদের মুখে কথা নেই। তারা নিচের দিকে তাকিয়ে অঝোরে কাঁদছেন। কান্নার সময় তারা বারবার কেঁপে কেঁপে উঠছেন। দুই বোনের কান্নায় বড় ড্রইং রুমটির পরিবেশ ভারি হয়ে উঠলো। এভাবে তারা তিন-চার মিনিট সোফায় বসে রইলেন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী উঠে দাঁড়িয়ে তাদের সোফার কাছে গেলেন এবং শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানার মাথার হাত দিলেন। পরে তাঁদের নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ি দিয়ে ওপরের দিকে উঠে গেলেন।'

প্রাক্কথনে লেখক লিখেছেন, 'প্রাণে বেঁচে যান দুই কন্যা ঘটনার দুই সপ্তাহ আগে জার্মানিতে আসার কারণে। তাঁরা কীভাবে, কোথায় ছিলেন, কারাই-বা সেই রুদ্ধশ্বাস সময়ে বিপদের সাথি হয়েছিলেন, বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংবাদপত্র, জার্মানির সেই সময়কার রাজনীতিক বা জার্মানরা বিষয়টি কীভাবে দেখেছিলেন, এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে থাকি। নতুন প্রজন্ম ও গবেষকদের কাছে সেসব তুলে ধরার তাগাদা অনুভব করি।' আর এই ভাবনা থেকেই হয়তো তিনি বইটি উৎসর্গ করেছেন সেদিনের ২ শিশু জয় ও পুতুলকে।

বঙ্গবন্ধু যখন রাষ্ট্রপতি, সেই সময় পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের আগে কন্যাদের জার্মানযাত্রার সময় তাদের হাতে মাত্র ৫০ ডলার করে তুলে দিয়েছিলেন তিনি। এরপর ঘটে সেই নৃশংস হত্যাকাণ্ড। পাল্টে যায় দৃশ্যপট। বঙ্গবন্ধুকন্যাদের জন্য চলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান। চরম দুঃসময়ে কেউ দূরে চলে যান, কেউবা পাশে এগিয়ে আসেন। গোপন কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু হয়। ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকর্তারা পাহারা দিয়ে তাদের পৌঁছে দেন বিমানবন্দরে। কাউকে না জানিয়ে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে পৌঁছে যান দিল্লি। ২ বোন দিল্লিতে কঠোর নিরাপদ আশ্রয়ে থাকলেও ছিল নিরাপত্তার আতঙ্ক। গোপনীয়তার জন্য সবাইকে ছদ্মনাম গ্রহণ করতে হয়। রাজ্য সরকার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে রাজি না হওয়ায় শেখ রেহানার বিশ্বভারতীতে পড়ার স্বপ্নও অপূর্ণ থেকে যায়। নির্বাসিত জীবনে নানান বাস্তবতার মুখোমুখি হয় এই পরিবার। ইন্দিরা গান্ধীর পরবর্তী সরকার মাসিক ভাতা ও সুযোগ-সুবিধা কমিয়ে দেয়। পরিচয় প্রকাশ না করে ছদ্মনামেই আকাশবাণী দিল্লিতে কাজ করেন শেখ হাসিনা। চলে জয় ও পুতুলের লেখাপড়ার আয়োজন। ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১। ৬ বছরের নির্বাসিত জীবন। রুদ্ধশ্বাস দিন। ঘটনার পর ঘটনা। এরই মধ্যে নিষ্ঠুরতম হত্যাযজ্ঞের বিচার দাবিতে বিশ্বজনমত গঠনের চেষ্টা। ৪৬ বছর আগের এসব ঘটনার সবিস্তার বিবরণ সংগ্রহ ও মলাটবন্দী করার কাজটি আসলে সহজ ছিল না।

সাবেক রাষ্ট্রদূত তারিক এ করিম ও গবেষক ড. শহীদ হোসেন ছিলেন সেই দুঃসময়ের সাথী। ইতিহাসের এই সাক্ষীদের সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণা বইটিতে সংযোজিত হয়েছে, যা বইটির গ্রহণযোগ্যতা ও সূত্রকে আরও জোরালো করেছে। ১০টি পর্বে সাজানো হয়েছে এ বই। বইটি পাঠক ও গবেষকদের ইতিমধ্যেই কৌতূহলী করে তুলেছে। এরই মধ্যে ছাপা হয়েছে তৃতীয় মুদ্রণ।

 

১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: প্রবাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যার দুঃসহ দিন

লেখক: সরাফ আহমেদ

প্রকাশক: প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা

প্রকাশকাল: আগস্ট ২০২১

প্রচ্ছদ: মাসুক হেলাল

পৃষ্ঠা: ১৪৮

দাম: ৩০০ টাকা

 

আহমদ সফি উদ্দিন: রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জনসংযোগ ও প্রকাশনা দপ্তরের সাবেক প্রধান, সাবেক প্রতিনিধি দৈনিক বাংলা ও সাপ্তাহিক বিচিত্রা

Comments

The Daily Star  | English
books on Bangladesh Liberation War

The war that we need to know so much more about

Our Liberation War is something we are proud to talk about, read about, and reminisce about but have not done much research on.

13h ago