অন্য এক ইলিয়াস
আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তার লেখালেখির প্রথম দিকে 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' শিরোনামে একটি গল্প লিখেছিলেন। একটি অসাধারণ পঙক্তি দিয়ে গল্পটি শুরু হয়। 'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো।'
এটি কি কোনো গল্পের পঙক্তি, নাকি কবিতার? 'মনোরম' আর 'মনোটোনাস' এই দুই আপাত বিরোধপূর্ণ শব্দের সহাবস্থান এই প্রশ্নের জন্ম দেয় বৈকি! কবিরা এমন লিখতে পারেন, লেখেনও। কিন্তু কোনো গদ্যকার কি সচেতনভাবে এমনটি লিখবেন? যদি লেখেন, একটি শহর কীভাবে একইসঙ্গে মনোরম এবং মনোটোনাস হয় এমন প্রশ্নে জর্জরিত হতে হবে গল্পকারকে।
গল্পকাররা নানাদিক থেকেই দুর্ভাগ্যবান। পাঠকরা তাদের এতটুকু ত্রুটিও (!) ক্ষমা করেন না। গদ্যের জন্য কাব্যিক ভাষাকে রীতিমতো নিন্দার চোখে দেখা হয় এ দেশে। যেন গদ্যকে আবশ্যিকভাবে কাঠখোট্টা হতে হবে। গল্পের মধ্যে আবেগ থাকা তো গর্হিত অপরাধ। সমালোচকরা রীতিমতো মৃত্যুদণ্ডই দিয়ে দেন লেখককে। যেন 'নিস্পৃহ', 'নির্মোহ', 'নিরাসক্ত' হওয়ার কোনো বিকল্পই তার সামনে খোলা নেই।
যাক, এইসব আলাপ বাদ দিয়ে আমরা বরং ওই একই গল্পের আরও কয়েকটি পঙক্তি পড়ে নিতে পারি।
'এই মনোরম মনোটোনাস শহরে অনেকদিন পর আজ সুন্দর বৃষ্টি হলো। রাত এগারোটা পার হয় হয়, এখনো রাস্তায় রিকশা চলছে ছল ছল করে, যেনো গোটিয়ার বিলে কেউ নৌকা বাইছে "তাড়াতাড়ি করো বাহে, ঢাকার গাড়ি বুঝি ছাড়ি যায়।" আমার জানলায় রোদন-রূপসী বৃষ্টির মাতাল মিউজিক, পাতাবাহারের ভিজে গন্ধভরা সারি, বিষাদবর্ণ দেওয়াল; অনেকদিন পর আজ আমার ভারি ভালো লাগছে। ছমছম করা এই রাত্রি, আমারি জন্যে তৈরি এরকম লোনলি-লগ্ন আমি কতোদিন পাইনি, কতোকাল, কোনোদিন নয়। বৃষ্টি-বুনোট এইসব রাতে আমার ঘুম আসে না, বৃষ্টিকে ভারি অন্যরকম মনে হয়, বৃষ্টি একজন অচিন দীর্ঘশ্বাস। এইসব রাতে কিছু পড়তে পারি না আমি, সামনে বই খোলা থাকে, অক্ষরগুলো উদাস বয়ে যায়, যেনো অনন্তকাল কুমারী থাকবার জন্যে একজন রিক্ত রক্তাক্ত জন্মদান করলো এদের। চায়ের পেয়ালায় তিনটে ভাঙা পাতা ঘড়ির কাঁটা হয়ে সময়কে মন্থর কাঁপায়। ষাট পাওয়ারের বাল্বে জ্বলছে ভিজে আলো, আর চিনচিন করে ওঠে হঠাৎ, কতোদিন আগে ভরা বাদলে আশিকের সঙ্গে আজিমপুর থেকে ফিরলাম সাতটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে, "তুই ফেলে এসছিস কারে", সেই সোনার শৈশবে ভুল করে দ্যাখা একটি স্বপ্ন, স্বপ্নের মতো টলটল করে। আমার ঘুম আসে না, আলোর মধ্যে একলা জেগে রই।...'
মনে কি হয় না যে একটি কবিতা পড়ছি? মনে কি হয় না, যেন কোথাও থেকে বিষণ্ণতা ঝরছে! যেন এইমাত্র একটা কথাহীন অব্যাখ্যাত সুর শুনে উঠলাম। যে রাগী ইলিয়াসের ছবি পাঠকের মনে গেঁথে আছে, মনে কি হয় না, এই ইলিয়াস যেন আলাদা, এই ইলিয়াসকে যেন চিনি না! গল্পটি নিয়ে আরও এগিয়ে গেলে আমাদের সঙ্গে পরিচয় হয় রঞ্জুর। সে এক বিষণ্ণ একাকী যুবক, খানিকটা অস্বাভাবিক, হয়তো ব্যাখ্যাহীন কোনো অসুস্থতায় আক্রান্ত। বৃষ্টিমুখর রাতে নিজের ঘরে শুয়ে তার কেবলই মনে হতে থাকে—আম্মার ঘরে কি যেন ফেলে এসেছি! কিন্তু কী যে ফেলে এসেছে সে, মনেই করতে পারে না। দরজায় অস্থির করাঘাত করে, মা-বাবার ঘুম ভেঙে যায়, তারা উঠে এসে দরজা খুলে দেন, তখনও তার মুখে একটিই কথা- 'তোমাদের ঘরে ইয়ে ফেলে এসেছি।' কিন্তু মা-বাবার বারংবার প্রশ্নেও সে মনে করতে পারে না এবং 'হঠাৎ অপরাধী, বিনয়ী ও এলোমেলো বলে ফেললো রঞ্জু, "ঠিক মনে করতে পারছি না, ভুলে গেলাম, কি যেনো ফেলে এসেছি।"'
গল্পটি এত রহস্যময় যে, তল পাওয়া যায় না। ওই যে 'আম্মার ঘরে কী যেন ফেলে এসেছি', কী যে ফেলে এসেছে সে তার মীমাংসা আজও হলো না। মানুষ মায়ের ঘরে কী ফেলে আসে? তার শৈশব? সারল্য? মায়া? উত্তর মেলে না।
একবারই ইলিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে দীর্ঘ আড্ডা হয়েছিল আমার। ততদিনে নিষ্ঠুর কর্কট রোগে তার পা কাটা পড়েছে, মাথায় সেই সুদৃশ্য চুলের বাহারও আর নেই, ক্র্যাচে ভয় দিয়ে চলতে হয় তাকে। তার আগে দেখা হয়েছে এখানে-ওখানে, টেলিফোনে কথাও হয়েছে। কিন্তু এত দীর্ঘ আড্ডা কখনো হয়নি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হলো, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা মিলিয়ে রাতও নেমে এলো কথায়-কথায়। আমি একাই ছিলাম সেদিন। এখনো মনে পড়ে, এই গল্পটি নিয়ে যখন জিজ্ঞেস করেছিলাম, কিছুই বলেননি তিনি। চোখ মেলে দিয়েছিলেন জানালা দিয়ে দূরে কোথাও। গভীর এক ঔদাসীন্যের ভেতরে দিয়েছিলেন ডুব। বেশ কিছুক্ষণ পর তাকে যখন ডেকেছিলাম ফের, জানতে চেয়েছিলাম, কেন আর লিখলেন না 'ওরকম' আর একটি গল্পও। তিনি ফিরে তাকিয়েছিলেন। তখন তার চোখ ছলছল, ঠোঁটে ম্লান হাসি, বলেছিলেন, 'ইচ্ছে করেনি, এরকম গল্প দু'বার লেখা যায় না।'
কেন এ গল্পের প্রসঙ্গে চোখে জল এসেছিল তার? আম্মার ঘরে কী ফেলে এসেছিলেন ইলিয়াস ভাই? উত্তর পাইনি।
২
গল্প এগোয়, আমরাও এগিয়ে চলি। রঞ্জুর মতো আমরাও বিষণ্ণ হতে থাকি, একা হতে থাকি। আর পড়া শেষ হয়ে গেলে মনে হয়—একবার পড়ে এই গল্পটি বোঝা হয়ে উঠলো না। আবার পড়ার জন্য হাত বাড়াই। আবারও বিষণ্ণ হই। কখনো হয়তো চোখের কোণ ভিজেও ওঠে। কিন্তু এবারও মনে হয়, আবার পড়তে হবে এই গল্প।
কোনো-কোনো কবিতা মানুষ বারবার পড়ে, বহুবার পড়ে, হয়তো সাধ মেটে না বলেই পড়ে। কিংবা সেটি তার সূক্ষ্ম অনুভূতিকে আরও তীক্ষ্ণ করে তোলে বলে পড়ে। কিন্তু গল্প? কোনো গল্প কি একই পাঠকের কাছে বহুবার পঠিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করে? সাধারণত করে না। যেটি করে সেটি উজ্জ্বলভাবে ব্যতিক্রম। 'নিরুদ্দেশ যাত্রা' সেই ধরনের গল্প।
কী হলো রঞ্জুর, কী হলো? এই ভাবনায় আক্রান্ত হয়ে আমরা ইলিয়াস ঘাঁটি এবং বহুদিন পর তাকে পেয়ে যাই চিলেকোঠায়। সেই একইরকম বিষণ্ণ ও একাকী। নিষ্ক্রিয়, নিস্পৃহ, চলমান জীবনে অংশগ্রহণহীন। অবশেষে তাকে হাড্ডিখিজিরের দেখানো পথে হারিয়ে যেতে দেখলে আবারও তার পরিণতি জানার জন্য ইলিয়াস হাতড়াই এবং দেখি তার শেষ উপন্যাস 'খোয়াবনামা'য় এই রঞ্জুই তমিজের বাপ হয়ে উপস্থিত হয়েছে। দেখি, ইলিয়াস বারবার রঞ্জুর কাছে ফিরে এসেছেন। 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'র রঞ্জু, 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর ওসমান ওরফে রঞ্জু আর 'খোয়াবনামা'র তমিজের বাপ—এই তিন জন আসলে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই চরিত্র।
তিন জনই খানিকটা অস্বাভাবিক, অসুস্থই বলা চলে। তিন জনই ঘোরগ্রস্ত, সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে সম্পর্কহীন নিষ্ক্রিয় মানুষ। তিন জনের পরিণতিও এক, অস্বাভাবিক মৃত্যু। অথচ এর ঠিক বিপরীত চরিত্রও নির্মাণ করেছেন ইলিয়াস। 'চিলেকোঠার সেপাই'-এর আনোয়ার কিংবা 'খোয়াবনামা'র তমিজ সেই ধরনের চরিত্র। আমাদের চারপাশেই এমন কিছু মানুষ আছে যারা বাস্তবতার মধ্যে বাস করে না, করে ফ্যান্টাসি বা কল্পনার জগতে। সমাজের ভেতরে থেকেও এই মানুষগুলো জনজীবনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। ইলিয়াস তাদের অস্তিত্ব অস্বীকার করেননি। এমনকি বিদ্রূপও করেননি তাদের নিয়ে, যেমনটা করেছেন মধ্যবিত্তদের। বরং তাদের প্রতি তার এক গভীর সহানুভূতি ছিল। যে রঞ্জুকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন তার প্রথম জীবনে, তাকেই ফিরিয়ে এনেছিলেন ওসমান এবং তমিজের বাপের মধ্যে। মনে হয় যেন ওসমান ও আনোয়ার একই চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ। কিংবা তমিজ ও তমিজের বাপও একই চরিত্রের এপিঠ-ওপিঠ—একজন নিঃসঙ্গ, অসহায়, নৈরাশ্যপীড়িত, বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ; আরেকজন সক্রিয়, আশাবাদী, সমকালের আয়োজন ও প্রয়োজনের সঙ্গে একাত্ম।
একজন মানুষের মধ্যে একইসঙ্গে পরস্পরবিরোধী মানুষ বাস করে—এইসব স্প্লিট পার্সোনালিটি নির্মাণ করে ইলিয়াস কি সেটিই দেখাতে চেয়েছিলেন? রঞ্জু সম্বন্ধে আমাদের কৌতূহল মেটে না, তার পরিণতি জানার জন্য আবার ইলিয়াস হাতড়াই। কিন্তু আর কিছু জানার আগে তিনি নিজেই এক নিরুদ্দেশ যাত্রার পথিক হন। আমাদের খোঁজ তবু থামে না। একসময় তার ডায়েরি আসে আমাদের হাতে। দেখি, ১৯৭৬ সালে, নিজের তেত্রিশতম জন্মদিনে ইলিয়াস লিখছেন:
Jesus, son of God died when he reached this age, 33, Jesus was exhausted and he did all he could do because he was on an assignment to pomp for God. He said, 'O God, take me back. I did what you asked me to do, I suffered Because you desired me to suffer. Now I feel spent up and so let me join you at the Olive Corner of Heaven.'
God said, 'You have done what I asked you to do and so I reward you. Jesus achived death and a place at the Olive Corner of Heaven and so he was crucified.'
And lo! This caricature of an artist was born tired and he is exhausted since his normal and so-called legimate birth on Feb 12, 1943. The bugger is now married and a father and a writer of no fame or authority. And he is yet to start his life. How does he justify his existence? Or does he have any?
তেত্রিশ বছর বয়সে যীশুর ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাটি নিশ্চয়ই তাকে আলোড়িত করেছিল। হয়তো সেজন্যই ওই বয়সে পৌঁছে নিজেকে মিলিয়ে দেখেছিলেন তিনি। দেখেছিলেন, যীশু ওই বয়সেই তার কর্তব্যকর্ম সেরে ঈশ্বরের কাছে চলে যাওয়ার বাসনা প্রকাশ করেছিলেন এই কথা বলে, I did what you asked me to do!!
কর্তব্য সম্পাদনের বিষয়ে কী নিশ্চিত তিনি! বলেছিলেনও, I suffered Because you desired me to suffer!
আহ! ঈশ্বরের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্যই যাবতীয় ভোগান্তিকে মেনে নিয়েছিলেন তিনি! অতঃপর, ডিয়ার লর্ড, এবার আমাকে ফিরিয়ে নাও!
ইলিয়াস কী ভাবছেন? নিজেকে দেখছেন তিনি একজন বিবাহিত পুরুষ, একজন পিতা এবং একজন অখ্যাত লেখক হিসেবে। 'Born tired' শব্দ দুটি ব্যবহার করেছেন। এই শব্দগুচ্ছের ব্যবহার দেখি তার রহস্যময় গল্প 'নিরুদ্দেশ যাত্রা'তেও। রঞ্জু বলেছিল, আমি তো এক জন্মক্লান্ত মানুষ।
শুধু কি তাই? ইলিয়াস বলছেন, এখনো তার জীবন শুরুই করা হয়নি (আর যীশু এই বয়সেই কিনা তার কর্মময় জীবন সম্পন্ন করে ফেলেছিলেন!); আর তারপরই নিজের সম্পর্কে এক মর্মস্পর্শী উচ্চারণ, How does he justify his existence? এই ইলিয়াসকে অচেনা লাগে না? এত সহজে বুঝে ওঠা যায় না তাকে। অন্তত আমি এখনো বুঝে উঠতে পারিনি।
ডায়েরিতে বিভিন্ন বছরে তার জন্মদিনের লেখাগুলো কিংবা না-লেখাগুলো কৌতূহল জাগায়। যেমন ১৯৮১ সালে তিনি কিছুই লেখেননি, কেবল বয়সটুকু ছাড়া। আবার ১৯৮২ সালে লিখেছেন, Nothing should be prized more highly than the value of each day! তারপর দীর্ঘ বিরতির পর ১৯৮৮ এবং ১৯৮৯ সালে লিখেছেন প্রায় একই কথা, What to do? I would rather be guilt of what I do than what I don't do.
এসব পড়তে পড়তে মনে হয়, জন্মদিনটা তাকে কোনো না কোনোভাবে আলোড়িত করতো। আবার ভিন্ন ভিন্ন উক্তিতে ইলিয়াস বলছেন—
'দেখেছি সরলতাই মানুষের স্বাস্থ্যের একমাত্র উপায়...'
'বড় দুঃখের চেয়ে ছোটো দুঃখ যেন বেশি দুঃখকর। ছোটো দুঃখের কাছে আমরা কাপুরুষ কিন্তু বড়ো দুঃখ আমাদের বীর করে তোলে...'
'আমি অনেক দিন ভেবে দেখেছি, পুরুষেরা কিছু খাপছাড়া আর মেয়েরা সুসম্পূর্ণ ...'
'দুনিয়া হলো চারদিনের আয়ু, তা দুদিন গেলো চাইতে চাইতে, দুদিন গেলো অপেক্ষায়...'
'মাঝে মাঝে পরাজিত হওয়া দরকার'
'মানুষ আসলে কিছুই পারে না, মৃত্যুর অধস্তন কর্মচারী হইয়া কাটাইবে দিন আলোর ছায়া মানিয়া মানিয়া'
'জীবন একটা গম্ভীর বিদ্রূপ, এর মজাটা বোঝা একটু শক্ত...'
'আই হ্যাভ মাচ টু টেল ইউ এ্যান্ড মেনি থিংস টু আস্ক- সময় হবে কি আমাদের কখনো?'
If you hear in my voice any resemblance to a voice that once was sweet music in your ears, weep for it, weep for it. If you touch in touching my hair, anything that recalls a beloved head that lay on your breast when you were young and free, weep for it, weep for it...
যেন টুকরো টুকরো করে লিখে রেখেছেন জীবন ও জগতের সারমর্ম। এসব পড়ি, আর আমাদের মনে হয়—সত্যিই জীবন এক গম্ভীর বিদ্রূপ! এর সবকিছু তাই বুঝে ওঠা যায় না! দেখি, তিনি বলছেন, যদি মনে পড়ে তাকে, শোনা যায় তার কণ্ঠস্বর, পাওয়া যায় তার স্পর্শ, তাহলে যেন দু'ফোঁটা অশ্রু বিসর্জন দিই আমরা।
৩
আমাদের অনুসন্ধান থামে না। অতঃপর একদিন দেখি, একটি দৈনিক পত্রিকায় মামুন হুসাইন স্বগত মৃত্যুর পটভূমি শিরোনামের গল্প অথবা স্মৃতিকথা ধারাবাহিকভাবে লিখতে শুরু করেন—মঞ্জু ভাই, অর্থাৎ ইলিয়াস ভাই, যার প্রধান চরিত্র। কিন্তু আমরা দ্বন্দ্বে পড়ি। একি মঞ্জু ভাই নাকি রঞ্জুর কাহিনী? ইলিয়াস কি তবে নিজেকেই নির্মাণ করেছিলেন নিরুদ্দেশ যাত্রা গল্পে? মামুনের গল্পটি আমরা পড়ে যাই, ইলিয়াসের বাগ্মিতায় মুগ্ধ হই। মানুষ, মানব জীবন আর মৃত্যুবিষয়ক দার্শনিক উপলব্ধি আমাদের ঘোর বাড়িয়ে দেয়।
মামুনের অসামান্য গদ্যে আমরা পড়ে উঠি তার মৃত্যু বিবরণ, আমাদের চোখ ভিজে ওঠে—
'তুতুল ভাবি দেখলেন ভোর হয়েছে। মঞ্জু ভাই মেলা ডাকাডাকি, এত রোদ, পাখির চ্যাঁচামেচি, ওষুধের গন্ধ, অক্সিজেন, আঙুর, বেদানার রস, কলিগদের রজনীগন্ধা, সব অবহেলা করে বহুদিন বাদে পেইন কিলার ছাড়াই দিব্যি ঘুমিয়ে আছেন। একটা মৃদু খটকা এলেও, ভাবলেন—তাহলে স্বপ্নের রাজ্যি লোপাট হলো! কে একজন অক্সিজেন মাস্ক সরিয়ে নিলো। লম্বা একটি চাদর দিয়ে ফেস ক্লথ বানানো হলো। পাঁজা পাঁজা আগর বাতির ভেতর সূরা আর রাহমান পড়ছিলেন কেউ। গাড়ি দাঁড়ালো সার-সার। পুলিশ এলো। মন্ত্রী-সেক্রেটারি এলো, এমনকি রাষ্ট্রপতির ফর্সা কোমল একখানা খামও এলো বেলা উঠলে। চশমা সরিয়ে অনেক স্নানের পর তুলাতে কর্পূর জড়িয়ে নাকে কানে গুঁজে দেয়া হয়েছে। কিন্তু ভিড় এড়াতে মঞ্জু ভাই ঘুমের মধ্যেই আম্মার কাছে মালতি নগর রওয়ানা হয়ে গেলেন। ভাবি গাড়ির ভেতর থেমে যাওয়া ঘড়িটা মেলান; সকাল সাড়ে ছয়, তারিখ, চার! পার্থ অগত্যা বাবার সুখ্যাতি শুনতে শুনতে মায়ের ঘড়িতে তারিখ দেখে, কিংবা গাড়ির জানালা দিয়ে দেখে কুয়াশাময় জানুয়ারির আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বাবার শাদা রঙের সাধ, মায়ের রাঙা আঁধার, নিশ্চিন্তিপুরের মাঠ, নদীর জল অথবা শোনে কেবল গাছের শব্দ, উড়ে বেড়ানো পাতা ভাঙার শব্দ, পাখির শব্দ, কান্নার শব্দ আর গভীর এক মৃত্যু গান।'
রঞ্জুকে খুঁজতে খুঁজতে আমরা ইলিয়াসকেই পেয়ে যাই। নিরুদ্দেশ যাত্রায় বেরিয়ে তিনি অবশেষে ঘুমিয়ে পড়েছেন বগুড়ার মালতিনগরে, তার মায়ের পাশে। মায়ের ঘরে কী ফেলে এসেছিলেন, আমাদের তা জানা হয় না বটে। তবে জেনে যাই, মায়ের পাশে অনন্তকালের মতো ঘুমিয়ে পড়ার ভেতরেই আছে হারিয়ে ফেলা সেই শৈশব, সারল্য আর মায়ার সন্ধান!
Comments