উপনিবেশিত মানুষের চিত্রকর আব্দুলরাজাক গুরনাহ

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঞ্জানিয়ার ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। তার নোবেল পাওয়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। গত কয়েক দিন যাবত ২০-২৫ জন সম্ভাব্য নোবেল প্রাপক সাহিত্যিকদের নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে ব্যাপক আলোচনা চলছিল তাতে কোথায় তার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। ‘জুয়াড়ি’রা তার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।

এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন তাঞ্জানিয়ার ঔপন্যাসিক আব্দুলরাজাক গুরনাহ। তার নোবেল পাওয়া সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ছিল। গত কয়েক দিন যাবত ২০-২৫ জন সম্ভাব্য নোবেল প্রাপক সাহিত্যিকদের নিয়ে বিশ্বজুড়ে যে ব্যাপক আলোচনা চলছিল তাতে কোথায় তার প্রসঙ্গ উত্থাপিত হয়নি। 'জুয়াড়ি'রা তার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেননি।

সবচেয়ে বেশি আলোচনা ছিল জাপানের হারুকি মুরাকমি ও কেনিয়ার গুগি ওয়া থিয়োঙ্গিকে নিয়ে। কারণ সবার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে এ বছর নোবেল কমিটি আমেরিকা-ইউরোপের বাইরে থেকেই কাউকে নির্বাচন করবে। এই ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি। তবে নোবেল পেলেন এমন একজন যার কথা কারো মাথায় আসেনি।

সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত হলেও আব্দুলরাজাক গুরনাহের নোবেল বিজয় নিয়ে ক্ষোভ-প্রতিবাদের ঝড় উঠবে না যেমনটি ঘটেছিল বব ডিলান, স্বেতলানা আলেক্সেয়িভিচ, পিটার হানৎকা প্রমুখকে নোবেল দেওয়া নিয়ে।

আব্দুলরাজাক গুরনাহ অদ্যাবধি প্রকাশিত তার ১০টি উপন্যাসে উপনিবেশিত মানুষের যে বস্তুনিষ্ঠ চিত্র অংকন করেছেন, তা তুলনা রহিত। সম্ভবত তিনিই প্রথম উত্তর-উপনিবেশী কথাসাহিত্যিক যাকে সুইডিশ একাডেমি নোবেল পুরস্কার দিয়ে সম্মানিত করলো। সাহিত্য ইতিহাস নয়, কিন্তু তার রচনায় পরিলক্ষিত হয় গভীর সত্যানুসন্ধিৎসা যার কোনো তুলনা হয় না। তিনি পরাধীন ও বাস্তুহারা মানুষের জীবনসংগ্রামের অনুপুঙ্খ গাথা রচনায় উন্মুখ। তার রচনাবলীতে রয়েছে ব্যাপক গবেষণার নানা চিহ্ন।

আব্দুলরাজাক গুরনাহর জন্ম ১৯৪৮ সালে। ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তার প্রথম উপন্যাস 'ডিপারচার ফ্রম মেমোরি'। ১৯৯৪ সালে তার উপন্যাস 'প্যারাডাইজ' বুকার পুরস্কারের জন্য শর্টলিস্টেড হলে তার বই সারা পৃথিবীতে বিক্রি হতে শুরু করে। এরপর তিনি অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন এবং একজন সৎ কথাসাহিত্যিক হিসেবে তার সুনাম ক্রমান্বয়ে বিস্তার লাভ করেছে।

তার বৈশিষ্ট্য হলো নানা চরিত্রের সমবায়ে একটি গল্পবিশ্ব গড়ে তোলা যা নানা স্থান, সংস্কৃতি ও বর্ণিল মানুষের বর্ণনায় সমৃদ্ধ। নানা ঘটনা ও দুর্ঘটনার অনুপুঙ্খ বর্ণনায় রচনার অবয়ব বিকশিত হয়। সংলাপ ব্যবহার করেন তিনি অপরিহার্যভাবে। তার চরিত্রগুলো উপন্যাসের কলেবরে বাস্তব হয়ে ওঠে। একবার শুরু করলে তার কাহিনীর ঘনবদ্ধ বুনোট থেকে ওঠে আসা কঠিন। তার ভাষা প্রাঞ্জল ও মনোহর। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে তিনি সাহিত্যের বিচার করেছেন একাডেমিক দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু, বহু সাহিত্যিকের রচনাশৈলীর ব্যবচ্ছেদ তাকে ঋদ্ধ করেছে। তাবৎ পূর্ব আফ্রিকার সাহিত্য জগতে তার সমকক্ষ আর কেউ নেই।

চিনুয়া আচেবে থেকে শুরু করে গুগি ওয়া থিয়োঙ্গো অবধি প্রায় সব আফ্রিকী লেখক ঔপনিবেশিকতার জাতীয়তাবাদী উপাখ্যান উপস্থাপন করেছেন। আব্দুলরাজাক গুরনাহের অভিমুখ এর বিপ্রতীপে, যেখানে তিনি ব্যক্তিমানুষের অস্তিতসংকট নিয়ে চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন। পরাধীন মানুষের অসহায়ত্ব, বাস্তুচ্যূতি, অভিবাসন, আত্মপরিচয়ের সংকট ও বাধ্যতামূলক বিবর্তন, সম্মান ও মর্যাদাহানি ইত্যাদি নানা বিষয়-আশয় তার রচনার কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। মানুষ কিভাবে তার মূল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তা নানাভাবে চিত্রিত হয়েছে আব্দুলরাজাক গুরনাহের লেখনীতে।

ভিন দেশে গিয়ে বসতি স্থাপনকারী মানুষের বৈদেশিকতা কখনো ঘুচে না। বস্তুত অভিবাসী মানুষ মৃত্যু অবধি নিরালম্ব, নিরাশ্রয় থেকে যায়। অভিবাসন দারিদ্র, শত্রুতা, প্রতিকূলতার দুর্দশা থেকে পরিত্রাণের কোনো চাবিকাঠি নয়। আর যে কথাটি উল্লেখ না করলেই নয়, তার আখ্যানে ইসলামের একটি ভূমিকাও সচরাচর সংরক্ষিত থাকে। সব মিলিয়ে আব্দুলরাজাক গুরনাহ একই সঙ্গে অভিনিবেশী ও বৈচিত্রপূর্ণ। তার একটি উপন্যাস পড়লেই সব উপন্যাসের আস্বাদন হয়ে যাবে না।

এ বছরের সাহিত্যের জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে জেনে আব্দুলরাজাক গুরনাহ যারপরনাই খুশি ও বিস্মিত হয়েছেন। তিনি পাবেন একটি স্বর্ণপদক, সার্টিফিকেট ও ১০ মিলিয়ন সুইডিশ ক্রোনার যার মূল্যমান প্রায় ৯ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। করোনা মহামারির কারণে এ বছর নোবেল পুরস্কার দেওয়ার জন্যে স্টকহোমে কোনো সাড়ম্বর আয়োজন হবে না। পুরস্কার পৌঁছে দেওয়া হবে প্রাপকের হাতে।

১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা ভাষাকে একটানে বিশ্বসাহিত্যের দরবারে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়েছিলেন। এরপর এক শতাব্দীরও বেশি সময় অতিবাহিত হয়েছে। সবার প্রশ্ন: আবার কবে একজন বাঙালি কবি বা কথাসাহিত্যিক নোবেল পুরস্কারের গৌরব অর্জন করবেন? রবীন্দ্রনাথের পর অনেক বড় মাপের কবি-লেখকের আবির্ভাব হলেও তাদের বই সুইডিশ একাডেমির গ্রন্থাগারে স্থান পায় না। হুমায়ূন আহমেদ, হাসান আজিজুল হক বা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কোনো বই সেখানে নেই। এর কারণ একটিই— আর তা হলো বাঙালি লেখকদের গ্রন্থাবলী ইংরেজি বা ফরাসি ভাষায় অনূদিত হয় না। যাদের মাতৃভাষা ইংরেজি তারা যদি দক্ষ হাতে অনুবাদ করেন তবে সেই অনুবাদ বিশ্ববাজারে সমাদর পাবে বলেই আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস।

সরকারের কাছে আমাদের আবেদন থাকবে এমন একটি প্রকল্প নেওয়ার যাতে ইংরেজিভাষী অন্তত: ২০ জন অনুবাদককে ঢাকায় ৫-৭ বছর অবস্থান করিয়ে, বাংলা ভাষা শিখিয়ে, তারপর সমসাময়িক কাব্য-উপন্যাস ইংরেজিতে অনুবাদ করিয়ে প্রকাশ করা হবে বিশ্ববাজারের জন্য। এর জন্য বছরে হয়তো ১২-১৫ কোটি টাকা খরচ হবে। এ অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা বাংলাদেশ অর্জন করেছে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আন্তর্জাতিক মর্যাদার নিরিখে এ ব্যয়ের জন্যে দৃঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে দ্বিধা করা সমীচীন হবে না।

Comments

The Daily Star  | English

Love road at Mirpur: A youthful street

Certain neighbourhoods in Dhaka have that one spot where people gather to just sit back and relax. For Mirpur, it’s the frequently discussed street referred to as “Love Road”.

3h ago