ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও আমাদের সাহিত্য

ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রধান স্তম্ভের একটি। কিন্তু, স্তম্ভটি নিয়ে আলোচনার ভাগ অনেকাংশেই কম। আয়তন ও বিস্তারে সম্ভবত লেনিন আজাদের, 'ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান: রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি' সবচেয়ে বড় কাজ।

এ বইয়ে তিনি অভ্যুত্থানের সমাজতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আরও কিছু ছোট পরিসরের বই আছে। সবগুলো বইয়ে মোটামুটি ইতিহাসের একই ফ্রেইমওয়ার্ক ব্যবহার করা হয়েছে। নিশ্চিতভাবেই সেটি বাঙালি জাতীয়তাবাদ। ঊনসত্তরের ইতিহাস একটু স্বতন্ত্র বলেই মনে হয়।

শ্রেণিচরিত্রের দিক থেকে বাংলাদেশের রাজনীতি ক্রমশ জনতার দিকে ঝুঁকেছে। এমনকি জাতীয়তাবাদী নেতারাও গণমানুষের ক্ষোভ ও প্রতিক্রিয়ায় শঙ্কিত হয়েছেন। কেন এই গণ অসন্তোষ? এই প্রশ্নের বহুমাত্রিক জবাব। বলা যায়, কৃষক, শ্রমিক, রাষ্ট্রের বাঙালি কর্মচারী ও কর্মকর্তা, স্থানীয় পুঁজিপতি- সকলের স্বার্থ মোটামুটি এক মোহনায় এসে এই বোধ দ্বারা তাড়িত হয়েছিল যে, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে পূর্ব পাকিস্তান শোষিত; শোষণের সর্বাত্মক প্রকাশ আইয়ুব খানের সামরিক শাসন। রাষ্ট্রের ক্ষমতা ব্যবহৃত হয়েছে দমন ও নিপীড়নের কাজে। সামরিক অধ্যাদেশ, নির্দেশনা, বক্তৃতায় প্রকাশ পেয়েছে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থার সংকেত।

রাজনৈতিক দলগুলো শুরু থেকেই আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকে বুঝে পড়ে নিতে চেয়েছিল। একদিকে মওলানা ভাসানী বলেছেন, 'পাকিস্তান একটি ধনবাদী সামন্তবাদী রাষ্ট্র। আর এ রাষ্ট্রের পরিচালক শক্তি হল এদেশীয় একচেটিয়া পুঁজিপতিরা। এই একচেটিয়া পুঁজিপতিরা একদিকে বিভিন্ন জাতির বিকাশের বিরুদ্ধ দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের প্রতিটি জাতির স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারের প্রতি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছে। আর অন্যদিকে, এরা শিল্প বিকাশের প্রয়োজনীয় আদিম-পুঁজি সংগ্রহের জন্য ঔপনিবেশিক শাসকদের মতই নিষ্ঠুর ও নগ্নভাবে এদেশের শ্রমিক-কৃষক আপামর জনসাধারণকে বর্বরভাবে লুণ্ঠন করে চলছে।'

অন্যদিকে পাকিস্তানে বৈষম্যমূলক শিল্পায়ন প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, 'প্রকৃতপক্ষে সমগ্র ব্যাপারটাই পূর্ব পাকিস্তানে শিল্পায়ন ব্যাহত করার জন্য একটি সুচতুর ত্রিমুখী পরিকল্পনার শামিল। এই পরিকল্পনার সঙ্গে ৩টি পক্ষ- যথ, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খানের সরকার, পশ্চিম পাকিস্তানী শিল্পপতিদের একটি ক্ষুদ্র চক্র এবং বৈদেশিক ঋণদান সংস্থাসমূহ ও তাহাদের বিশেষজ্ঞগণ জড়িত রহিয়াছেন।'

পূর্ব পাকিস্তানের আরও অনেক দল ও গোষ্ঠী আইয়ুব খানের সামরিক জামানার তীব্র সমালোচনা করেছেন, বিকল্প মত ও পথের নিশানা প্রস্তুত করেছেন। মস্কোপন্থী ও পিকিংপন্থী কমিউনিস্টদের দ্বন্দ্ববিরোধ সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত ঐক্যের পাল্লাই জোরদার হয়েছিল, জনতা নেমে এসেছিল রাজপথে। আসাদ, মতিউর, জোহার রক্তের দাগ মুছে অবশ্যসম্ভাবী হয়ে উঠেছিল আইয়ুব খানের পতন।

এই পর্বের সাহিত্যিক উপস্থাপনা হাতে গোনা। শামসুর রাহমানের 'আসাদের শার্ট', আল মাহমুদের 'ঊনসত্তরের ছড়া', আহমদ ছফার 'ওঙ্কার', আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের 'চিলেকোঠার সেপাই'- নামগুলোই ঘুরে ফিরে আসে। প্রতিটি লেখা যার যার মহিমা নিয়ে সাহিত্যের ইতিহাসে উজ্জ্বল অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে। অভ্যুত্থানের সময়ে বিভিন্ন সংকলন ও সাময়িকীতে কবিতা প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সময়পর্বের কবিতা আলোচনা করতে গিয়ে ১৯৭৯ সালের দিকে সাঈদ-উর-রহমান জানিয়েছেন, গণ অভ্যুত্থান বিষয়ক কবিতাগুলো মূলত সাময়িকী আর সংকলনেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, বইয়ে অন্তর্ভুক্ত কবিতার সংখ্যা কম। ঘটমান বা চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কবিতা যতোটা আলোড়িত করার ক্ষমতা রাখে, ফিকশনের পক্ষে তা করা সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। ফিকশনের তুলনায় এখানেই হয়তো কবিতা এগিয়ে যায়। নাটকেও হয়তো এমন এক গণমুখী তাগিদ আছে। অন্য দিকে একজন গল্পকার কিংবা ঔপন্যাসিককে ধীর স্থিরভাবে বুঝে নিতে হয় পরিপ্রেক্ষিত। চলমান ঘটনাসমূহের যেকোনো একটিকে বেছে নিলে তার চলে না। কেননা ইতিহাসের অনেকগুলো গলির সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন তিনি। কোন গলিতে কী ঘটছে, তার রহস্যভেদ করতে সময় লাগেই, প্রয়োজন পড়ে ঐতিহাসিক দূরত্বের। হয়তো তাই ফিকশনের জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হলো। আহমদ ছফা 'ওঙ্কার' লিখলেন ১৯৭৫ সালে। তারও এক দশক পর আখতারুজ্জামান লিখলেন 'চিলেকোঠার সেপাই'।

কিন্তু 'আসাদের শার্ট' লেখা হয়েছিল ঊনসত্তরের ওই ঐতিহাসিক মুহূর্তের ভেতর। ১৯৭০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল শামসুর রাহমানের কবিতার বই 'নিজবাসভূমে'। উৎসর্গে লিখেছিলেন, 'আবহমান বাংলার শহীদদের উদ্দেশ্যে।' এই বইয়েই সংকলিত হয়েছে 'আসাদের শার্ট'। সঙ্গে আছে 'বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা', 'হরতাল', 'ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯'। 'আসাদের শার্ট' কবিতাটিতে উদ্দীপনার একটি জাতীয় প্রতীক নির্মাণ করতে পেরেছিলেন, 'আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা।' বইটির আরও কিছু কবিতায় ধরা আছে ঊনসত্তরের সময়চিহ্নিত ছবি- হরতাল, পিকেটিং, পুলিশ রিপোর্ট, রক্ত, স্লোগান। বলেছেন, 'ভীষণ বদলে গেছে শহর আমার!' ('হরতাল')। ঊনসত্তরের প্রতিটি দিন বদলে যাচ্ছিল ঢাকা; প্রকৃতপক্ষে বদলানো শুরু করেছিল আরও আগে, ৫২ পর থেকেই বদলে যাচ্ছিল ঢাকার কণ্ঠস্বর; ঊনসত্তরে সেটি আরও জোরালো হয়েছে, হয়ে উঠেছে প্রত্যাখ্যানের।

আল মাহমুদ লিখেছিলেন দারুণ দুটি ছড়া। 'ঊনসত্তরের ছড়া'য় আল মাহমুদ গেঁথে দিয়েছিলেন স্লোগানের ভাষা। একটি জঙ্গি মিছিল তার সমস্ত সরবতা ও সহিংসতা নিয়ে যেভাবে ছড়িয়ে পড়ে, তার চমৎকার একটি ভাষিক উপস্থাপনা পাওয়া গিয়েছে ঊনসত্তরের ছড়ায়, 'ট্রাক! ট্রাক! ট্রাক!/ ট্রাকের মুখে আগুন দিতে মতিয়ুরকে ডাক।' কিংবা 'কারফিউ রে কারফিউ!/ আগল খোলে কে?/ সোনার বরণ ছেলেরা দেখ্/ নিশান তুলেছে।' এ সময়ের বিবরণ দিতে গিয়ে আল মাহমুদ লিখেছেন, 'তখন ৬৯-এর গণ আন্দোলন তুঙ্গে এবং শেষ পর্যায়ে। অদ্ভুত এক ছড়া লিখে ফেললাম। এক কারফিউর রাতে বসে।' এই সেই ছড়া। ছড়ার খুব ভালো একটি প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল। ছড়াটি প্রকাশ হওয়া মাত্র চারদিকে হুল্লোড় তুলেছিল আর গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে ছাত্র-শিল্পীরা গাইতে শুরু করেছিল।

এক সাক্ষাৎকারে আল মাহমুদ বরাবর অভিযোগ তোলা হয়েছিল, ঊনসত্তরের মতো বিরাট রাজনৈতিক আন্দোলনে কবিদের ভূমিকা ছিল না। জবাবে বলেছেন, 'লেখকরা ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন এবং একটা ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে আমাদের দেশে লেখকদের রাজনৈতিক আন্দোলনে হয়ত গুরুত্ব দেয়া হয় না।' কথাটি শেষাংশ সত্য। কারণ লেখকরা রাজনৈতিক হতে চান না, আবার রাজনৈতিক আন্দোলনে লেখকের অংশগ্রহণকেও তাৎপর্যের সঙ্গে গ্রহণ করা যায় না।

প্রশ্ন হলো, কবি-লেখকদের সৃষ্টিশীল কাজে গণ-অভ্যুত্থানের উপস্থাপনা তাহলে কোথায়? উত্তর, ওই হাতে গোনা। তারই মধ্যে আহমদ ছফার কাছে জমে আছে আমাদের ঋণ। 'ওঙ্কার' উপন্যাসের ছোট্ট পরিসরে এঁকে ফেলেছেন পূর্ব বাংলার বাঙালির শ্রেণিচরিত্রের মর্মমহল। আইয়ুবি শাসন এবং বাঙালি মধ্যবিত্তের শ্রেণিস্বার্থের লেনাদেনার সম্পর্কটি ছোট্ট পরিসরেও বৃহতের আবেদন জোগায়। অথচ উপন্যাসটির গল্পাংশ অত্যন্ত ছোট: পূর্ব বাংলার এক মধ্যবিত্ত কথকের জবানিতে উঠে এসেছে গ্রাম ও শহরের গল্প; সে গল্পে বোবা মেয়ের কণ্ঠ থেকে বেরিয়ে এসেছে ভাষা। জীবন্ত বাস্তবতা থেকে প্রতিদিন সে গড়ে নিয়ে চেয়েছে ধ্বনি। কিন্তু তা অস্পষ্ট, অস্ফুট। কথক স্বামীটি স্ত্রীর প্রতি আগ্রহ, উদাসীনতা, বৈরাগ্য ও দ্বিধায় সংকুচিত; খাপ খাওয়াতে ব্যর্থ। ব্যর্থ সে চলমান সময়ের সঙ্গে মিশে যেতেও। মিছিল তার ভালো লাগে না। জনতার কোলাহল তাকে বধির করে তোলে। একদিন তার বোবা স্ত্রীর রক্তাক্ত স্বরযন্ত্র বেয়ে উচ্চারিত হয়েছে একটি শব্দ, 'বাঙলা।'

দারুণ রূপক এই গল্প। মূলত আইয়ুব শাহি শাসন, পাকিস্তানি সাংস্কৃতিক অধিপত্য এবং অর্থনৈতিক শোষণ থেকে মুক্তির ভাষারূপ সেই বোবা মেয়ের বাকস্ফূর্তি। এই গল্পের পটভূমি জুড়ে আছে পূর্ব বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস। গল্পের প্রটাগনিস্টের উৎস সামন্তবাদী সমাজ কাঠামো। তার পিতার গায়ে আভিজাত্যের রঙিন খোলস। যদিও যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর উচ্ছেদ হয়ে গেছে জমিদারি প্রথা, সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেছে তালুকদারি প্রথা। কথক জানাচ্ছেন, 'বাবার অবস্থা ভয়াবহ। এই তালুকদার শব্দটার ব্যঞ্জনায় তিনি সর্বক্ষণ মোহিত হয়ে থাকতেন। ভুলে যেতে পারতেন চারপাশের রূঢ় পরিবেশ। এই পাঁচটি অক্ষরে উচ্চারিত বিশেষ ধ্বনিটির মাধ্যমে তিনি পূর্বপুরুষের নৈকট্য অনুভব করতেন। সেই তালুকদার নামটাই আইনের খগড়ে কাটা পড়ে গেল।' এই পরিবার থেকে জন্ম নিয়েছে নতুন মধ্যবিত্ত- 'ওঙ্কারে'র কথক।

উপন্যাসজুড়ে তাকে দেখা যায় স্বার্থের সঙ্গে মেপে মেপে চলতে। আইয়ুব খানের শাসন তার জন্য আশীর্বাদ। যে শ্বশুরের সম্পদে পরগাছা হয়ে তার বিকাশ ও সমৃদ্ধি, সেই শ্বশুরের ভিত্তি আইয়ুব খান। কথকের জবানিতেই আছে, 'তিনি আইয়ুব রাজত্বের শক্ত একটা খুঁটি না হলেও ঠেকনা জাতীয় কিছু একটা তো বটেই।' নিজের অবস্থানটি যে ভঙ্গুর সে কথা তার অহমে আঘাত হানে, 'আমি আইয়ুব খানকে কাজে খাটাতে পারিনে। তিনি শ্বশুর সাহেবের হাতে যে পরিমাণ ক্ষমতা গচ্ছিত রেখেছেন, আমি তো তিঁতপুঁটি, তাই দিয়ে অনেক রুই-কাতলাও ঘায়েল করা যায়।' কিন্তু আইয়ুব খান যদি ক্ষমতায় না থাকে? ভবিষ্যৎ ভেবে শিউরে ওঠে সে। অভ্যুত্থানের মুহূর্তে সে ভাবছে, 'আইয়ুব খানের সিংহাসন ঝড়ে পাওয়া নায়ের মতো টলছে। শক্ত মানুষ ফিল্ড মার্শালের জন্য চিন্তিত হলাম। মার্শাল যদি যান আমার শ্বশুরও চিৎপটাং হবেন। যাদের করুণার বদৌলতে আমি পাড়া-গাঁয়ের ধূলিশয্যা থেকে এই বড় কর্তার আসনে উঠে এসেছি, তাঁরা সকলে যাবেন অথচ আমি একা থাকব সে কেমন করে হয়।'

ঐতিহাসিকভাবে বাঙালি মধ্যবিত্ত বিদ্রোহ, অভ্যুত্থান কিংবা বিপ্লবকে ভয় পায় এবং সন্দেহের চোখে দেখে। তার প্রমাণ আছে ইতিহাসের পাতায়। উনিশ শতকে এতো এতো কৃষক বিদ্রোহ, আদিবাসী আন্দোলন সংঘটিত হয়েছে, সেগুলোতে বাঙালি মধ্যবিত্তের না ছিল অংশগ্রহণ, না ছিল সমর্থন। বরং শ্রেণিচ্যুতির ভয়ে কাতর হয়েছেন। 'বঙ্গদেশের কৃষক' প্রবন্ধে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যেমন বলেছিলেন, 'আমরা সমাজবিপ্লবের অনুমোদক নহি।' কৃষকদের জমিদার বিরোধী আন্দোলন ও বিদ্রোহ বঙ্কিমচন্দ্রের সহ্য হয়নি। আসলে ওই শ্রেণিই তো গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারি ব্যবস্থার সঙ্গে মিতালি পাতিয়ে। 'ওঙ্কারে'র কথকের অবস্থান ঠিক এক। সেও ভয় পাচ্ছে, আইয়ুব খানের পতন ঘটলে, তার অবস্থান কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকবে। বোবা স্ত্রীর দিকে খেয়াল করে দেখে, উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকে সে; 'মিছিলের ধ্বনি তার অন্তর্লোকে চুম্বকের মতো ক্রিয়া করে।'

সময়ের ধাক্কা এক সময় না এক সময় লাগেই। ইতিহাস মুক্তি দেয় না। 'ওঙ্কারে'র কথকও বদলে যেতে থাকে। মিছিলের শব্দ আর স্লোগানের ভাষায় যার শ্রুতি বধির হয়ে আসত সেও বদলাতে আরম্ভ করে। পরগাছা মধ্যবিত্তটি স্বীকার করে নেয়, 'স্নায়ুর প্রসারণ ঘটিয়ে অবস্থার সঙ্গে মানিয়ে নিতে বাধ্য হলাম।' আসাদের মৃত্যুর পর যখন আচমকা বদলে যেতে লাগল; বদলে যাওয়া কথকও দেখতে পায় মিছিলের রূপ, 'প্রতিটি মানুষ সমগ্র মিছিলের কাঠামোর সঙ্গে সন্নিবিষ্ট হলেও তারা সকলে আলাদা আলাদা মানুষ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সচেতন সবাক চলিষ্ণু ঝরনা। একটি আরেকটির সঙ্গে মিশে রচনা করেছে এই গতিমান স্রোতধারা।' সেই বোবা মেয়েটি ধাবমান স্রোতের একটি অংশ হিসেবেই চিৎকার করে জানান দেয়, 'বাঙলা।' পাকিস্তানি শাসন ও নির্যাতনে মূক হয়ে যাওয়া বাঙালির সম্মিলিত বাসনা যেন প্রকাশিত হলো 'বাঙলা' উচ্চারণের ভেতর দিয়ে। ব্যক্তির কণ্ঠস্বরে ভাষা পেল জাতীয় আবেগ।

'ওঙ্কারে'র তুলনায় 'চিলেকোঠার সেপাই' বহন করছে মহাকাব্যিক বিস্তার। শহর, গ্রাম, শ্রেণি, পেশা, লিঙ্গ, ধর্মের বিচিত্র সমাবেশে ইলিয়াসের আরাধ্য এক বহুস্বরিক বাস্তবতা। এই বিস্তৃত আয়োজন পাঠককে নিয়ে যায় শহরের গলি থেকে গ্রামে, যমুনার চরে। ইলিয়াসও দেখিয়েছেন মধ্যবিত্তের দোলাচল; অফিসের কেরানিদের আলাপে তুলে এনেছেন মধ্যবিত্তের শ্রেণিস্বার্থের প্রসঙ্গ। গণঅভ্যুত্থানে পিওন, বস্তিবাসী, রিকশাওয়ালা, শ্রমিক, ড্রাইভার, কুলি কারও অংশগ্রহণকেই স্বাগত জানাতে পারে না অফিসের কেরানিকুল। একজনের ছোট্ট একটি আলাপ, 'আরে আইয়ুব খান গেলে তোদের লাভটা কি? তোরা মিনিস্টার হবি? নাকি অফিসে এসে চেয়ার টেবিলে বসবি?' ইলিয়াস নিশানা তাক করেছেন একেবারে মোক্ষম জায়গায়- বাঙালি মধ্যবিত্তের মনে। এই মন সামাজিক অবস্থান নিয়ে সুখী নয়, ঊর্ধ্বতন শ্রেণির স্বপ্নে বিভোর। চিন্তার গহন অতলে কাজ করে শ্রেণিচ্যুতির ভয়; পিওনদের সম্পর্কে ধারণা এমন, 'গুলি খাইয়া মরলে আইজ বাদে কাইল তগো বৌপোলাপানে দ্যাশে যাইবো, ধান বানবো, খ্যাতে কামলা খাটবো। তগো চিন্তা কি?' আরেক জনের জবাব, 'মিডল ক্লাসের আসতেও কাটে, যেতেও কাটে।'

হাড্ডি খিজির, জুম্মন, বস্তি-রাস্তার আরও আরও মানুষ কিন্তু এসব চিন্তার ধারে কাছে নেই। তারা মুহূর্তেই পুড়িয়ে দিতে চায় আইয়ুব খানের ছবি টাঙানো হোটেল। কখনো কখনো গুজব আর বাস্তবতার ফারাক করতে চায় না। আইন, পুলিশ, সামরিক হুমকি অতিক্রম করে তারা চলে যায়; কারফিউর অমান্য করে রাস্তায় দাঁড়িয়ে হাড্ডি খিজির যেমন চিৎকার করে বলে, 'বিবিজানরে সিনার মইদ্যে খোমাখান ফিট কইরা নিন্দ পাইড়েন না ভাইসাবেরা, মরদের বাচ্চা মরদ হইলে রাস্তায় নামেন।' কোনো রাজনৈতিক মতাদর্শ খিজিরদের সার্বক্ষণিকভাবে আটকে রাখতে পারে না তত্ত্বের ফ্রেমে। আর তাই ওসমান বা আনোয়ারের রাজনীতির সঙ্গে হাড্ডি খিজিরের রাজনীতি ও সক্রিয় অংশগ্রহণের পার্থক্য থেকে যায় দ্বিমেরু দূরত্বে। যদিও তারা মধ্যবিত্তের বিভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শ দ্বারা আলোড়িত হয়; যেমন হাড্ডি খিজিররা শরিক হয়েছিল জাতীয়তাবাদে। নিম্নবর্গের রাজনীতির স্বভাবই এই। নিম্নবর্গের ইতিহাসকাররা তাত্ত্বিকভাবে দেখিয়েছেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে শরিক হয়েও গান্ধীর সঙ্গে যুক্ত হয়েও কৃষকরা তৈরি করে ফেলেছেন আন্দোলনের নিজস্ব খাত।

আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নানা কোণ থেকে আলো ফেলেছেন ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের ওপর। ওই সময়কে কেন্দ্র করে উপন্যাসটি এক ধরনের বাহাসও; শ্রেণির সঙ্গে শ্রেণির, মতাদর্শের সঙ্গে মতাদর্শের, রাজনীতির সঙ্গে রাজনীতির, ইতিহাসের সঙ্গে ইতিহাসের। সম্ভবত এই কারণেই ইলিয়াস উপন্যাসটিকে দিতে পেরেছেন মহাকাব্যিক ব্যাপ্তি। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মহাকাব্যগুলো কোনো-না-কোনোভাবে একটি বাহাসকেই সামনে নিয়ে এগোয়; কাব্য রচয়িতা চরিত্রগুলোকে দাঁড় করান বিস্তৃত ঘটনাপ্রবাহের সামনে। 'বুর্জোয়া সময়ের মহাকাব্য' বলে খ্যাত উপন্যাস নামক আঙ্গিকে- যেমনটা বলেছিলেন মার্কসবাদী উপন্যাসতাত্ত্বিক র‌্যালফ ফক্স- ইলিয়াসও অসংখ্য চরিত্রকে দাঁড় করিয়েছেন প্রশ্নের মুখোমুখি। রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামে শ্রেণিগুলোর অংশগ্রহণ কেমন? কোন ধরনের প্রতিক্রিয়া হাজির করে শহর ও গ্রামীণ জনপদের মানুষ? জনতার সম্মিলিত আকাঙ্ক্ষা কি এক? নাকি ভিন্ন ভিন্ন আকাঙ্ক্ষার ময়দানে হেঁটে বেড়ায় জনতার স্বপ্নগুলো? ঊনসত্তরের ঘটনাকে সাক্ষী রেখেই চলেছে এই সব প্রশ্নের মোকাবিলা। 'চিলেকোঠার সেপাই' উপন্যাসটি যে দীক্ষিত পাঠকের দ্বারা ব্যাপকভাবে গৃহীত হলো, তার অন্তত একটি কারণ: বাংলাদেশ থেকে এই প্রশ্নমালা ফুরিয়ে যায়নি। প্রশ্নগুলোর তাত্ত্বিক ফয়সালা হয়তো নানা জন নানাভাবে করেছেন; কিন্তু প্রায়োগিক ফয়সালা নেই।

যাহোক লেখার শেষ প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছি। আরেকটি সূত্র ধরে লেখাটি শেষ করতে চাই। লেখক-পাঠকদের মধ্যে এক ধরনের হাহাকার আছে: বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কোনো মহৎ উপন্যাস নেই কেন? মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে মহৎ/ বিরাট/ মহান সাহিত্য রচিত হলো না কেন? কেন নেই একটি 'ওয়ার অ্যান্ড পিস', 'মাদার' কিংবা 'ওয়ান হান্ড্রেড ইয়ার্স অফ সলিটিউড'? সত্যিই তো কেন নেই। ঔপন্যাসিকরা কি ব্যর্থ? অদক্ষ? তার আগে জবাব খোঁজা দরকার, সত্যিকার অর্থে আমাদের কি কোনো ইতিহাসবোধ আছে? ইতিহাসকে কী চোখে দেখি আমরা?

পদ্ধতিগতভাবে আমরা ইতিহাসকে বুঝতে শিখেছি? আদতে এদেশে ইতিহাস অত্যন্ত খেলো ব্যাপার। ইতিহাসকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে পার্টি রাজনীতির খোঁয়াড়ে। যেকেউ যেকোনো মুহূর্তে ফায়দা মোতাবেক ইতিহাসের বয়ান নিজের সুবিধার দিকে ঘুরিয়ে নিতে প্রস্তুত। ইতিহাসকার অথবা লেখকের ঘাড়ের ওপর খড়গ হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন ইতিহাসের কর্তারা, ইতিহাস বিষয়ক রাজনৈতিক ও নৈতিক চাপ লেখককে বিভ্রান্ত করে। কিন্তু ইতিহাসকে আমার, আমাকে ইতিহাসের অংশ করার সুযোগ দিলেই হয়তোবা মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারে।

Comments

The Daily Star  | English
cyber security act

A law that gagged

Some made a differing comment, some drew a political cartoon and some made a joke online – and they all ended up in jail, in some cases for months. This is how the Digital Security Act (DSA) and later the Cyber Security Act (CSA) were used to gag freedom of expression and freedom of the press.

7h ago