কেন লিখি

কেন লিখি, এ প্রশ্নের মুখোমুখি কতবার যে হয়েছি! সৌজন্যবশত উত্তরও দিয়েছি কিছু একটা; কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে, কেন লিখি। কখনো মনে হয়, লিখি স্মৃতিপুঞ্জ ধরে রাখবার জন্য। কার স্মৃতি? নিজের? না, কেবল নিজেরই তো নয়। এই যে এতদিন ধরে লিখছি, তিরিশ বছর তো হবেই, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-মুক্তগদ্য ইত্যাদি কতকিছু, সব লেখায় তো আমি নিজে উপস্থিত নেই। ভুল বললাম বোধহয়। উপস্থিত আছি বটে, পরোক্ষভাবে আছি, কিন্তু সব স্মৃতি আমার নিজের মালিকানাধীন নয়; বেশিরভাগই এসেছে পর্যবেক্ষণ থেকে, উপলব্ধি থেকে, কল্পনা থেকেও। তার মানে দাঁড়ালো, এ এক সম্মিলিত স্মৃতিপুঞ্জ।

কেন লিখি, এ প্রশ্নের মুখোমুখি কতবার যে হয়েছি! সৌজন্যবশত উত্তরও দিয়েছি কিছু একটা; কিন্তু সত্যি বলতে কি, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যে, কেন লিখি। কখনো মনে হয়, লিখি স্মৃতিপুঞ্জ ধরে রাখবার জন্য। কার স্মৃতি? নিজের? না, কেবল নিজেরই তো নয়। এই যে এতদিন ধরে লিখছি, তিরিশ বছর তো হবেই, গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধ-মুক্তগদ্য ইত্যাদি কতকিছু, সব লেখায় তো আমি নিজে উপস্থিত নেই। ভুল বললাম বোধহয়। উপস্থিত আছি বটে, পরোক্ষভাবে আছি, কিন্তু সব স্মৃতি আমার নিজের মালিকানাধীন নয়; বেশিরভাগই এসেছে পর্যবেক্ষণ থেকে, উপলব্ধি থেকে, কল্পনা থেকেও। তার মানে দাঁড়ালো, এ এক সম্মিলিত স্মৃতিপুঞ্জ।

সময়ের স্মৃতি, জনগোষ্ঠীর স্মৃতি, জনপদের স্মৃতি, এবং হয়তো, পৃথিবী নামক এই অপূর্ব ছোট্ট-সুন্দর-মায়াবী নীল গ্রহটির স্মৃতিও। কিন্তু সে-সব ধরে রাখার জন্য নির্ভর করতে হয়েছে ব্যক্তির ওপর, সৃজন করতে হয়েছে বিবিধ চরিত্র, তাদের ভেতর দিয়েই সংকলিত হয়েছে স্মৃতি, অভিজ্ঞতা আর সম্পর্কের বিবরণগুলো। একটু কি বাড়িয়ে বলা হলো? সত্যিই কি ধরে রাখতে পেরেছি এতসব স্মৃতিপুঞ্জ? মনে তো হয় না। হয়তো স্বপ্ন ছিল সে-রকমই। হয়তো ভেবেছিলাম, আরও বহুকাল পরও পাঠকরা যখন পড়বে এইসব লেখা, তাদের মনে হবে- হ্যাঁ, চেনা যাচ্ছে সময়টিকে, সময়ের মানুষগুলোকে, তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে, তাদের সুখ-দুঃখ-আনন্দ-বেদনাকে, তাদের বিষাদ-বিপন্নতা-একাকীত্ব ও বিষণ্ণ তাকে, তাদের ক্ষোভ-প্রতিবাদ-সংগ্রাম-বিদ্রোহকে। ভেবেছিলাম, পাঠকরা বুঝে নেবে, এই লেখাগুলোর ভেতরে লুকিয়ে আছে আরও বহু মানুষের কণ্ঠস্বর; যারা সবসময় নীরব থেকেছে, কণ্ঠ উঁচুতে তোলেনি, তাদের সবার হয়ে লেখাগুলো কথা বলে উঠছে। উচ্চাকাঙ্খা, জানি। কিন্তু এরকম উচ্চাকাঙ্খা না থাকলে লিখতাম কীভাবে?  

জীবন তো বহুমাত্রিক, কত যে তার রঙ, কত যে বৈচিত্র্য! আমাদের রূঢ়-দুঃসহ-দুর্বহ পারিবারিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-রাষ্ট্রীয় বাস্তবতার ভেতরে বসবাস করতে গিয়ে কত যে গ্লানি-বেদনা-দুঃখ-হতাশা-হাহাকার-ক্ষোভ সঞ্চিত হয়, তার তো হিসেব-নিকেশ নেই। কিন্তু এগুলোই তো সব নয়। এসবকিছুর ভেতরে বসবাস করেও তো মানুষ ভালোবাসে, প্রেমে পড়ে, গান গায়, সুর তৈরি করে, লেখালেখি করে, শিল্পচর্চা করে। কীভাবে তা সম্ভব? মনে কি হয় না, অন্তঃশীলা প্রবাহের মতো কোথাও আনন্দের ফল্গুধারা বয়ে চলেছে? কোথাও যেন লুকিয়ে আছে সুখ, তৃপ্তি, আনন্দ আর প্রেম, যার সন্ধান এই মানুষগুলো জানে? মনে কি হয় না, তাদের আছে জীবন ও জগতের সঙ্গে এক ধরনের সম্মানজনক বোঝাপড়া, অলিখিত-অপ্রকাশিত, কিন্তু তাদের কাছে সেগুলো অবোধ্য নয়? নইলে মানুষ বাঁচে কী করে, কী নিয়ে যাপন করে দুঃসহ এক জীবন? হয়তো এই রহস্যসূত্র, এই জীবন-সংবেদ আবিষ্কার করার সাধ ছিল, হয়তো চেষ্টা ছিল সেই আবিষ্কারগুলো ধরে রাখতে আমার লেখাগুলোতে। পেরেছি কি না, পারলেও কতটুকু পেরেছি জানি না। হয়তো জানা হবেও না কোনোদিন।     

অবশ্য কখনো এমনও তো ভাবি যে, লেখালেখির আড়াল নিয়ে আমি আসলে নীরবতা আর নৈঃশব্দ্যের কাছে সমর্পণ করতে চেয়েছি নিজেকে। কিন্তু কথাটা যত সহজে বলা গেল, আদতে ততটা সহজ নয়। নৈঃশব্দ্যের কাছে সমর্পণ করতে পারলে তো জীবনের মোক্ষলাভ ঘটেই যেত! আমি জানতাম, নিশ্চয়ই জানতাম, এখনো এই জানার ভেতরে কোনো ভুল ধরা পড়েনি যে, নীরবতা আর নৈঃশব্দ্যের মধ্যে, নির্জনতা আর নিশ্চুপতার ভেতরেই লুকিয়ে আছে জগৎ আর জীবনের গভীর-গভীরতর রহস্যময়তা ভেদ করার সূত্রসমুহ। হয়তো সেজন্যই নিজের জন্য এবং এই কোলাহলমুখর পৃথিবীর নিরুপায় বাসিন্দাদের জন্য রচনা করতে চেয়েছিলাম এক অপরূপ নৈঃশব্দ্যের জগৎ। ভাবতাম, যদি পারি এমন যে, আমার গল্প পড়ে, উপন্যাস পড়ে বা অন্য কোনো লেখা পড়ে পাঠকদের চারপাশে নেমে আসবে গভীর নীরবতা আর নৈঃশব্দ্য, তাহলে আমার চাওয়ার আর কিছু থাকবে না! 

আবার কখনো-বা মনে হয়- না, ওসব কিছু নয়। আমি আসলে আমার স্মৃতি, সম্পর্ক আর অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে চেয়েছি আরও অনেকের সঙ্গে, চেয়েছি আনন্দ আর যন্ত্রণাগুলো ভাগ করে নিতে। একইসঙ্গে, একই পরিবেশ, একই পারিবারিক-সামাজিক কাঠামোর ভেতর দিয়ে বেড়ে ওঠা কিশোর-তরুণদের মধ্যে কেবল অল্প কয়েকজন কেন লিখতে শুরু করেন, আঁকতে শুরু করেন, আপনমনে সুর তৈরি করেন- এই রহস্যের উন্মোচন তো হয়নি এখনো! কেউ কেউ কেন অন্যদের চেয়ে বেশি সংবেদনশীল হন, কেন চারপাশের পরিবেশ-প্রতিবেশ তাকে অধিকতর সচকিত ও বিচলিত করে, কেউ জানে না। সংবেদনশীল আর পর্যবেক্ষণমুখর মানুষগুলো তো কেবল মানুষই দেখেন না, কেবল মনুষ্যসৃষ্ট কোলাহলই শোনেন না, শোনেন নিসর্গের বিবিধ সুর, ছন্দ ও শব্দ; দেখেন বহু-রঙে রাঙানো জগৎ, বৃক্ষদের অপূর্ব কর্মকাণ্ড; পর্যবেক্ষণ করেন জীবজন্তু, পশুপাখি, কীটপতঙ্গের জীবনও। কিছুই তাদের কাছে ফেলনা নয়, কিছুই তুচ্ছ নয়। ব্যক্তিমানুষ আর তার সমাজ, পরিবার ও রাষ্ট্র, জীব-জগতের নানা সদস্য যেমন তাদেরকে ভাবায়, তেমনই বাদ পড়ে না মানুষের সঙ্গে অন্য সবকিছুর অলিখিত দিব্যকান্তি সম্পর্কের রসায়নও। এইসব সম্পর্ক, স্মৃতি আর অভিজ্ঞতার ভার তো কম নয়। একা বয়ে বেড়ানো যায় না আসলে, ভাগ করে নিতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কার এত সময় আছে এসব শোনার? হয়তো সেজন্যই অনির্দিষ্ট পাঠক, শ্রোতা, দর্শকের জন্য সৃষ্টি হতে থাকে সাহিত্য, সুর, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র, নাটক এবং অন্যসব শিল্পমাধ্যম। হয়তো আমিও তাই করতে চেয়েছি। 

কখনো এও মনে হয়, অত মহৎ কিছু নয়; দুর্বহ সময়টিকে পার করার জন্য, যন্ত্রণাদগ্ধ জীবনটিকে একটু সহনীয় করে তোলার জন্য লেখার ঘোরে ডুবে থাকতে চেয়েছি। আর কিছু নয়, আর কিছু নয়। একান্তই ব্যক্তিগত এইসব লেখাজোখা, কেন যে সেগুলো প্রকাশ করতে গেলাম, ভাবি মাঝে-মাঝে, উত্তর পাই না। আর কিছু পাঠক কেন যে লেখাগুলোকে গ্রহণ করলেন নিজেদের মতো করে, এমনকি কখনো-কখনো রচয়িতার চেয়ে বেশি ভালোবেসে ফেললেন কোনো-কোনো লেখাকে, বুঝে ওঠা গেল না। ব্যাপারটা দারুণ রহস্যময়ই রয়ে গেল আমার কাছে। এই মহার্ঘ রহস্যের সঙ্গে বসবাস করার আনন্দও তো কম নয়! 
        
এইসব লেখালেখির চেষ্টা চলছে প্রায় তিন যুগ ধরে, যদিও প্রথম বছর-পাঁচেকের কোনো লেখার নমুনা আর সংগ্রহে নেই। স্কুলে-কলেজে পড়ার সময় দু-একটা লেখা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হলেও সেগুলো ধর্তব্যের মধ্যে নয়। আমার প্রথম গল্প প্রকাশিত হয় ১৯৯০ সালে, এক অল্পপরিচিত জাতীয় দৈনিকে। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী, পড়ি পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে, কিন্তু মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমার পেশা যা-ই হোক না কেন, যেকোনো মূল্যে আমি লেখালেখি চালিয়ে যাবো। সত্যি বলতে কি, পেশা নিয়ে আমার কোনো পরিকল্পনা ছিল না, আমি কখনোই কিছু হতে চাইনি। কিন্তু লিখতে চেয়েছি। সেই যে ১৯৯০ সালে শুরু করেছিলাম, তারপর থেকে অবিরাম লিখেও গেছি। এর বছর দশেকের মধ্যেই দেশের সবগুলো প্রধান জাতীয় দৈনিকের সাহিত্যপাতায়, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং মাসিক সাহিত্য পত্রিকায়, ঈদসংখ্যায় বা বিশেষ সংখ্যায় আমার নানা ধরনের লেখা প্রকাশিত হতে থাকে। লিটল ম্যাগাজিনেও লিখেছি তবে সংখ্যায় কম। প্রচুর লিখতাম তখন। আর এই লেখাগুলোই ছিল অচেনা পাঠকদের সঙ্গে আমার সংযোগসূত্র। পাঠকদের কথা ভেবে লিখিনি কখনো, তবু বিস্ময় নিয়ে আবিষ্কার করেছি, বহু পাঠক তাদের অনুভূতি জানাচ্ছেন আমাকে, তাদের ভালো লাগা জানাচ্ছেন, সমালোচনাও জানাচ্ছেন। এইসব পাঠপ্রতিক্রিয়া নিঃসন্দেহে আমার জন্য আনন্দময় অভিজ্ঞতা হয়ে আছে। এই যে সংযোগ, অচেনা মানুষদের সঙ্গে গভীর-প্রীতিময় সংযোগ, সেই আনন্দও আমাকে লিখে যেতে সহায়তা করেছে।  

এত কথার পরও, তবু বলি, আমি সত্যিই জানি না, কেন লিখি। স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ার সময় নিতান্তই ঝোঁকের মাথায় লিখতে শুরু করেছিলাম। তারপর বছর পাঁচেক একটানা লিখেছি খাতার পাতায়, অজস্র লেখা, কিন্তু প্রকাশ করিনি কোথাও। কী যে লিখেছি এত, মনে নেই আর, সেইসব খাতাও হারিয়ে গেছে কবে-কোথায় খবরও রাখিনি, কিন্তু সেই যে বিরামহীন লেখার অভ্যাস, সেটিই পরে আমাকে দীর্ঘ এক লেখক-জীবন যাপন করার সাহস জুগিয়েছিল। গদ্য লেখার কাজটি কেবল মানসিক পরিশ্রমই নয়, বিপুল ধৈর্য এবং শারীরিক পরিশ্রমেরও ব্যাপার। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন লেখার টেবিলে বসে থাকার মতো মগ্নতা এবং ধৈর্য যেমন লাগে, তেমনই এভাবে বসে থাকতে থাকতে নানা রোগ-বালাইও সঙ্গী হয়ে পড়ে প্রতিটি গদ্য-লেখকের। সেজন্যই প্রস্তুতির প্রয়োজন হয় আর প্রস্তুতিপর্বটা হতে হয় দীর্ঘ সময়ের এবং থাকতে হয় ধ্যান, মগ্নতা ও ধৈর্য। এটুকু বলতে পারি, আমার ধৈর্য ছিল, মগ্নতাও ছিল। অন্য সবার মতোই আমার জীবনে বহুবিধ দুর্যোগ এসেছে, সংগ্রাম এসেছে, বেদনা-নৈরাশ্য-দুঃখ-শোক-হাহাকার এসেছে, তবু আমি কখনো লেখার কলমটি ছাড়িনি। যা-কিছুই হোক না কেন, যত ব্যস্ততাই থাকুক না কেন, নিয়ম করে প্রতিদিন লেখার টেবিলে বসেছি, লিখতে পারি আর না পারি। এবং লক্ষ করেছি, লিখতে পারলে আমার শোকের উপশম হয়, দুঃখ-বেদনা লঘুতর হয়, নৈরাশ্যের অন্ধকারের ভেতরেও কোথাও আলোর রেখার দেখা মেলে। লিখে আনন্দ পেয়েছি, বেঁচে থাকার রসদ খুঁজে পেয়েছি, তাহলে আর কেনই বা 'কেন লিখি' প্রশ্নের উত্তর খুঁজবো? চলছে যেহেতু, চলুক না এভাবেই।  

'অনুভবের যৎসামান্য' ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে 

Comments