জহির রায়হান: অকালে হারানো উজ্জ্বল নক্ষত্র

১৯৪৯ সালে, ফেনীর সোনাগাজির আমিরাবাদ স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে লিখলেন ‘ওদের জানিয়ে দাও’ নামের একটি কবিতা। সেই কবিতা প্রকাশিত হলো চতুষ্কোণ পত্রিকায়। কবিতায় উঠে এলো নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মর্ম যাতনার কথা।
জহির রায়হান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪৯ সালে, ফেনীর সোনাগাজির আমিরাবাদ স্কুলের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী আবু আবদার মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে লিখলেন 'ওদের জানিয়ে দাও' নামের একটি কবিতা। সেই কবিতা প্রকাশিত হলো চতুষ্কোণ পত্রিকায়। কবিতায় উঠে এলো নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও মর্ম যাতনার কথা।

'ওদের জানিয়ে দাও,

ওরা আমার ভাই-বোনকে

কুকুর বিড়ালের মত মেরেছে

ওদের স্টীম রোলারের নিচে

ওদের জানিয়ে দাও

ওরা দেখেও যদি না দেখে

বুঝেও যদি না বোঝে'

তারও আগের কথা- কলকাতার বিখ্যাত মিত্র ইন্সটিটিউটে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়াকালীন বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের প্রভাবে প্রথম রাজনৈতিক সংস্পর্শে আসা মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ'র। তারপর কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ফেরি করে বিক্রি করতেন 'স্বাধীনতা পত্রিকা'। তার বাবা মাওলানা হাবিবুল্লাহ ছিলেন কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক।

১৯৬৫ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে বক্তব্য রাখছেন জহির রায়হান। ছবি: সংগৃহীত

১৯৪০ সালে কলকাতা মডেল স্কুলে ভর্তির মধ্য দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়েছিল জহির রায়হানের। সেখানে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ার পর তাকে মিত্র ইন্সটিটিউটে ভর্তি করানো হয়। দেশভাগের কিছুদিন পরেই তারা চলে আসেন গ্রামের বাড়িতে। স্থানীয় আমিরাবাদ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ভর্তি হন ঢাকা কলেজে।

মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ থেকে জহির রায়হান, এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক মণি সিংহ। তখন ইন্টারমিডিয়েটে তিনি ঢাকা কলেজে পড়ছেন। বড় ভাই শহীদুল্লা কায়সারের সুবাদে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যেক কর্মীর পার্টির দেওয়া একটি নাম থাকতো। মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ'র পার্টি নাম রায়হান রেখেছিলেন মণি সিংহ। তারপর থেকে মোহাম্মদ জহিরুল্লাহ দিনে দিনে পরিচিত হয়ে উঠলেন জহির রায়হান নামেই।

১৯৫২-এর ২১শে ফেব্রুয়ারির রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্রদের মিছিলে  যে দশ জনের দলটি সর্বপ্রথম ১৪৪ ধারা ভেঙেছিলো তার মধ্যে অন্যতম ছিলেন ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েট পড়ুয়া জহির রায়হান।

এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হয়েছিলেন জহির রায়হান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই সাংবাদিক হিসেবে যুগের আলো পত্রিকায় কর্মজীবন শুরু হয় তার। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থায় আরও দুটি পত্রিকায় কাজ করেছিলেন জহির রায়হান। একই সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অবস্থাতেই প্রকাশিত হয়েছিলো তার প্রথম গল্পগ্রন্থ সূর্যগ্রহণ।

মুক্তিযুদ্ধের সময় কলকাতায় প্রতিবাদ সমাবেশে পটুয়া কামরুল হাসান, জহির রায়হান ও অজয় রায়। ছবি: সংগৃহীত

চলচ্চিত্রে জহির রায়হানের অভিষেক হয় ১৯৫৭ সালে, জাগো হুয়া সাভেরা চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে। এই চলচ্চিত্রের পরিচালক ছিলেন আখতার জং কারদার। পরিচালক হিসেবে জহির রায়হানের চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় ১৯৬১ সালে, 'কখনো আসেনি' চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রের অভিনয় করেছিলেন খান আতাউর রহমান, শবনম, সুমিতা দেবী। একই বছর সুমিতা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল জহির রায়হানের। এই চলচ্চিত্র জহির রায়হানের পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র হলেও চারটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করে ফেলেছিলেন সুমিতা দেবী। এর আগের বছর প্রকাশিত হয়েছিলো জহির রায়হানের প্রথম উপন্যাস 'শেষ বিকেলের মেয়ে'। পরের বছর জহির রায়হান নির্মাণ করেছিলেন সোনার কাজল। তবে জহির রায়হান মূল আলোচনায় আসেন তারও এক বছর পরে অর্থাৎ ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কাঁচের দেয়াল চলচ্চিত্রের মাধ্যমে। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান চলচ্চিত্র উৎসবে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছিল এটি। জহির রায়হান পেয়েছিলেন শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মাননা।

জহির রায়হানের হাত ধরেই পাকিস্তানের চলচ্চিত্র রঙিন চলচ্চিত্রের জগতে প্রবেশ করেছিল। ১৯৬৪ সালে তার নির্মিত উর্দু চলচ্চিত্র 'সঙ্গম' ছিল পাকিস্তানের প্রথম রঙিন চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের ৬টি গানই তুমুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। বছরটি জহির রায়হানের জন্য দারুণ একটি বছর ছিল। একই বছরে প্রকাশিত হয়েছিল তার রচিত কালজয়ী উপন্যাস 'হাজার বছর ধরে'। এই উপন্যাসের জন্য ১৯৬৪ সালে আদমজী সাহিত্য পুরস্কার পেয়েছিলেন জহির রায়হান।

এরপর একাধারে একুশে ফেব্রুয়ারি, বাহানা, বেহুলা, আনোয়ারা, চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৬৯ সালে বায়ান্নর রক্তস্নাত ভাষা-আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত উপন্যাস 'আরেক ফাল্গুন'। একই বছর প্রকাশিত হয়েছিল তার আরেক বিখ্যাত উপন্যাস 'বরফ গলা নদী'।

১৯৭০ সালে মুক্তি পেয়েছিল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'। এটি জহির রায়হানের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বলে বিবেচিত। সামাজিক এই চলচ্চিত্রে তৎকালীন বাঙালি স্বাধীনতা আন্দোলনকে রূপকের মাধ্যমে তুলে ধরা হয়েছিল। এতে অভিনয় করেছিলেন রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতাউর রহমান, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন। চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে আমার সোনার বাংলা গানটি প্রথম চিত্রায়িত হয়েছিল। এখন যা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। একই বছর 'টাকা আনা পাই' নামে আরও একটি অসামান্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। সেই বছরই তিনি নির্মাণ শুরু করেছিলেন তার লেট দেয়ার বই লাইট চলচ্চিত্রের। এই চলচ্চিত্রটি ছিল চিত্রনাট্য ছাড়া। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য থেকে সংলাপ সবই ছিলো জহির রায়হানের উপস্থিত মেধায় রচিত। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ায় চলচ্চিত্রটি নির্মাণ বন্ধ হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জহির রায়হান চলে যান ভারতের কলকাতায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে প্রচারাভিযান ও তথ্যচিত্র নির্মাণ শুরু করেন। শুরু করেন তার বিখ্যাত স্টপ জেনোসাইড তথ্যচিত্র তৈরির কাজ। পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ডকুমেন্টারি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের গণহত্যা নিয়ে তার নির্মিত 'স্টপ জেনোসাইড'কে। যার প্রতিটি সেকেন্ডে মিশে আছে একটি জাতির চিহ্ন। একটি জাতির অসীম ত্যাগের ইতিহাস।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা, হানাদার পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হত্যাযজ্ঞ, ভারতে বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারের দিনকালসহ বহুকিছু এই তথ্যচিত্রে তুলে ধরা ধরেছিলেন জহির রায়হান। স্টপ জেনোসাইডের প্রথম প্রদর্শনী হয়েছিলো কোনো এক অজ্ঞাত স্থানে। প্রদর্শনীতে উপস্থিত ছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদসহ মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যরা।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরি করার ক্ষেত্রে 'স্টপ জেনোসাইড' অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধে জহির রায়হানের প্রভাব এতো বিস্তৃত যে হাজার পৃষ্ঠা লিখলেও শেষ হবে না। স্টপ জেনোসাইড থেকে শরণার্থী ক্যাম্প, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে মিটিং, সভা সমাবেশে জনমত গঠন করেছিলেন।

কলকাতায় তার নির্মিত চলচ্চিত্র 'জীবন থেকে নেয়া'র কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, তপন সিনহাদের মতো নির্মাতারা। চলচ্চিত্রটি দেখার পর সত্যজিৎ রায় বলেছিলেন, 'এ এক অনন্য প্রতিভা, চলচ্চিত্রে এক নতুন যাত্রার সূচনা হলো। এক দুর্দান্ত প্রতিভাবান চলচ্চিত্রকারের মাইফলক।'

তখন অর্থনৈতিক দুরবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন জহির রায়হান। তারপরেও তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হতে যতো অর্থ এসেছিল সব অকাতরে মুক্তিযোদ্ধা তহবিলে দান করেছিলেন।

দেশ স্বাধীনের পর ভারত থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন জহির রায়হান।  ১৯৭২ সালের ২৫ জানুয়ারি সাংবাদিক সম্মেলনের ঘোষণার পাঁচ দিন পর ৩০ জানুয়ারি রোববার সকালে রফিক নামের এক অজ্ঞাত টেলিফোন কল আসে জহির রায়হানের কায়েতটুলির বাসায়। টেলিফোনে জহিরকে বলা হয়েছিল, আপনার বড়দা (শহীদুল্লা কায়সার) মিরপুর বারো নম্বরে বন্দী আছেন। যদি বড়দাকে বাঁচাতে চান তাহলে মিরপুর চলে যান। একমাত্র আপনি গেলেই তাকে বাঁচাতে পারবেন। সেদিন সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে তার চলচ্চিত্র প্রদর্শনী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু, টেলিফোন পেয়ে জহির রায়হান দুটো গাড়ি নিয়ে মিরপুরে রওনা দিয়েছিলেন। তার সঙ্গে ছিলেন ছোট ভাই  জাকারিয়া হাবিব, চাচাত ভাই শাহরিয়ার কবির, শ্যালক বাবুলসহ আরও তিনজন। মিরপুর ২ নম্বর সেকশনে পৌঁছানোর পর সেখানে অবস্থানরত ভারতীয় সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তথা তৎকালীন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও পুলিশের সদস্যরা নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে জহির রায়হানের টয়োটা গাড়িসহ থাকতে বলে অন্যদের ফেরত পাঠিয়ে দেন। এরপর আর জহির রায়হানকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।

মাত্র ৩৭ বছর জীবনের পরিধি ছিলো জহির রায়হানের। এই ক্ষুদ্র জীবনে দাপটের সঙ্গে চলচ্চিত্র ও সাহিত্যে দোর্দণ্ড প্রভাববিস্তার করে গেছেন। মাত্র ৩৭ বছরের জীবনেই এই কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের ইতিহাসের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকার। কেবল সাহিত্য ও চলচ্চিত্র নয়- স্বাধীনতা পূর্ব বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত প্রতিটি গণ আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন জহির রায়হান। তা ৫২'র ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৬৬'র ছয় দফা, ৬৯'এর গণঅভ্যুত্থান হোক কিংবা ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ। প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। ছোট্ট এই ক্ষুদ্র জীবনে একজন মানুষ কতোটা দিতে পারেন, জহির রায়হান যেন ছিলেন তার সীমারেখা। যার জীবন ছিল  অবিস্মরণীয় কীর্তিতে ভরা।

আজ কিংবদন্তী চলচ্চিত্র নির্মাতা, সাহিত্যিক জহির রায়হানের জন্মদিন। জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই আমাদের চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রের প্রতি। 

আহমাদ ইশতিয়াক, [email protected]

Comments

The Daily Star  | English

Horrors inside the Gaza genocide: Through a survivor’s eyes

This is an eye-witness account, the story of a Palestinian in Gaza, a human being, a 24-year-old medical student, his real human life of love and loss, and a human testimony of war crimes perpetrated by the Israeli government and the military in the deadliest campaign of bombings and mass killings in recent history.

23h ago