সংস্কৃত পালি আরবি ফারসি: ভাষার সংকট ও সম্ভাবনা
কিছু দিন আগে একটি খবর বেশ শোরগোল তুলেছিল: সংস্কৃত ভাষায় উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সংস্কৃত বলতে ও লিখতে পারেন না। হাসির জোগান দিলেও আলোচনাটি যৌক্তিক আলাপের কোনো ভিত্তি তৈরি করতে পারেনি। মৃত ভাষা নিয়ে কিছু দিন হেসে খবরটি নিজেই মৃত হয়ে গেছে। অথচ প্রশ্ন উঠতে পারত যে, ভাষা মরে যায় কেন? একটি মৃত ভাষা কি একেবারেই গুরুত্বহীন? কেন সংস্কৃত শিখতে হবে? সংস্কৃত শিক্ষার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চাহিদা কী? বছরের পর বছর ধরে বাঙালিরা আরবি শিখেছে; তাতে কি বাংলাদেশে আরবি ভাষাচর্চা বৃদ্ধি পেয়েছে? পালি ভাষার কী পরিস্থিতি? ফারসি ভাষা শিখে লোকেরা কী করছে? বাংলাদেশের প্রধান তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য পড়ানো হয় কেন? এসব প্রতিষ্ঠানের ভাষা বিষয়ক বিভাগগুলোর কর্মকাণ্ড বিষয়ে কি গবেষণা হয়েছে?
এত এত প্রশ্ন দেখে ভাবতে পারেন আমি নিশ্চয়ই ভাষা সম্পর্কে খড়গহস্ত। কিন্তু আদতে তা নয়। বরং আমার অবস্থান এসব ভাষা শিক্ষার পক্ষে। আমি বলতে চাই, কোনো ভাষাই স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নেয় না। আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কার্যকারণ ভাষাকে দুর্বল কিংবা শক্তিশালী করে তোলে। আর এ কারণেই বুঝতে পারি, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিসরে ভাষাগুলো সমান অবস্থায় নেই। জ্ঞানজাগতিক বাহাস বা চিন্তা চর্চার ভাষা হিসেবে সংস্কৃত ও পালি সর্বত্র বিস্তৃত ভাষা নয়; বাঙালির চর্চায় আরবি সচল ভাষা হিসেবে বজায় থাকলেও ফারসির জোরদার অবস্থান নেই। অন্য দিকে আরবিকে বিবেচনা করা হয় প্রধানত ধর্মের ভাষা হিসেবে। অথচ আরবির রয়েছে ধর্মাতিরিক্ত অবস্থান। আরব অঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রকাশের প্রধান মাধ্যম আরবি ভাষা। ভাষাগুলোর এই অবস্থা ও অবস্থান দেখে প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়াই স্বাভাবিক যে, এ কালের মানুষ কেন সংস্কৃত শিখবে বা জানবে।
অন্তত দুটি কারণে সংস্কৃত জানা জরুরি। ভারতীয় সাংস্কৃতিক ইতিহাসে সংস্কৃত একটি প্রভাবশালী ভাষা। আর্য সংস্কৃতির বিস্তার এবং ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসনের কালে সংস্কৃত ছিল শক্তিশালী মাধ্যম। দুর্বলের আনাগোনা সেখানে ছিল না। জাতিভেদের মানদণ্ডে প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত। এমনকি ইতিহাসের আধুনিক পর্বেও মুহম্মদ শহীদুল্লাহর জন্য বন্ধ করা হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা; সংস্কৃত শিখতে চাইলে সে সময়ের সংস্কৃত ভাষার শিক্ষক অপারগতা প্রকাশ করেছিলেন। এর প্রকাশ্য কারণ ছিল শহীদুল্লাহর মুসলমান পরিচিতি। কিন্তু সংস্কৃত কোনো বিশেষ ধর্মাবলম্বীর ভাষা নয়। সনাতন ধর্মের অসংখ্য গ্রন্থ সংস্কৃত ভাষায় রচিত বলে তাকে ধর্মের বাতাবরণে আটকে রাখা যৌক্তিক নয়। একইভাবে আটকে থাকতে পারে না আরবি কিংবা ফারসি।
মনে রাখা দরকার সাহিত্য ও দর্শনের ভাষাও সংস্কৃত। বাংলা ভাষী কবি লেখকদের অনেকেই ছিলেন সংস্কৃতে পণ্ডিত। অনেকেই ছিলেন তত্ত্বজ্ঞানী; সংস্কৃত ছিলেন তাদের জ্ঞানচর্চার ভাষা। প্রাসঙ্গিকভাবে আমাদের মনে পড়বে 'গীতগোবিন্দ' কাব্যের মহৎ স্রষ্টা জয়দেবের কথা। সন্ধ্যাকর নন্দী লিখেছেন 'রামচরিত' কাব্য। উনিশ শতকে সমাজ সংস্কার বিষয়ক তর্কবিতর্কের সময় সংস্কৃত থেকেই শাস্ত্রের নজির টানা হতো। সতীদাহ প্রথা বিষয়ক বাদানুবাদে দেওয়া হয়েছে সংস্কৃত শাস্ত্রের দোহাই। বিধবাবিবাহ বিষয়ক আন্দোলনের সময় বাংলার পাশাপাশি সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছে বিভিন্ন পুস্তক। শতাব্দী অতিক্রান্ত হলেও সে সবের অনুবাদ বাংলায় প্রকাশিত হয়নি। বাঙালি মনীষার অধিকাংশই এসব পুস্তকের সঙ্গে পরিচিত নন।
অপরাপর ক্লাসিক ভাষার মতো করে সংস্কৃতকেও বিবেচনা করতে হবে ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধনের ভাষা হিসেবে। একজন বাংলা ভাষী ব্যক্তি যদি বাংলা ভাষার কালানুক্রমিক ইতিহাস বুঝতে চান, তাহলে তাকে সংস্কৃতের কাছে যেতেই হবে। বাংলা ভাষার রূপতাত্ত্বিক বিবর্তন বোঝার ক্ষেত্রে সংস্কৃত নিঃসন্দেহে সহায়ক। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এ কারণেই সংস্কৃতকে বলেছেন 'চিরকেলে মহাজন'। কালকেন্দ্রিক প্রেক্ষাপটে রেখে বাংলা ভাষার সংগঠন বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেও প্রয়োজন পড়বে সংস্কৃতের।
বাংলা অঞ্চলের ধর্মতাত্ত্বিক ইতিহাস যাদের আরাধ্য, তাদের জন্য সংস্কৃত এক অফুরান ভাণ্ডার। আর প্রাচীন ভারতীয় তত্ত্ব ও দর্শনের সীমানায় প্রবেশ করতে চাইলে সংস্কৃতকে উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। বৈষ্ণব শাস্ত্রকারদের ব্যাখ্যা তৈরি হয়েছে সংস্কৃতে। রূপ গোস্বামী লিখেছেন বৈষ্ণব রসশাস্ত্র বিষয়ক গ্রন্থ 'উজ্জ্বল নীলমণি'। কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীচৈতন্যচরিতামৃত বইয়ের পৃষ্ঠায় ছড়ানো আছে অজস্র সংস্কৃত শ্লোক। সংস্কৃত না জানা ব্যক্তির পক্ষে এসবের প্রাসঙ্গিক ভাষ্য প্রস্তুত করা মোটেই সম্ভবপর নয়।
কেউ কেউ বাঙালির নিজস্ব নন্দনতত্ত্বের হদিস নিতে চান; কিন্তু কোথায় পাবো তার উৎস উপাদান? প্রকৃতপক্ষে প্রাচীন ও মধ্যযুগের বাঙালির যা কিছু ভাবনা, তার সঙ্গে সংস্কৃতের কোনা-না-কোনো সংযোগ আছে। ঔপনিবেশিক ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রভাবপর্বে সংস্কৃত বাহিত নন্দনতাত্ত্বিক চিন্তা হয়ে উঠেছিল আত্মরক্ষার হাতিয়ার। আর তাই সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে বিপুল এক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল উনিশ শতকে। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন সংস্কৃত ভাষা ও সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব। সাহিত্যের আদর্শ, রস, ভাষারীতি সম্পর্কে লেখকদের নতুন তৎপরতা আরম্ভ হয়েছিল।
সংস্কৃতের মতো শক্তিশালী সাংস্কৃতিক ভাষার সঙ্গে তুলনা করতে গেলে বাংলাদেশে পালি ভাষার অবস্থান আরও বেশি করুণ বলে অনুমিত হয়। অথচ এ ভাষাতেই জ্ঞান বিতরণ করেছিলেন মহামতি গৌতম বুদ্ধ। তার জীবন ও জন্মান্তর নিয়ে পালি ভাষায় রচিত হয়েছিল জাতক। ভারতীয় উপমহাদেশের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও মননের বিরাট বিরাট চিহ্ন লুকিয়ে আছে বৌদ্ধ স্থাপনা, শ্লোক ও গ্রন্থে। তার সঙ্গে সেতুবন্ধনে সক্ষম কেবলই পালি। এ ভাষায়ই পাচ্ছি 'মিলিন্দ প্রশ্নে'র মতো গুরুত্বপূর্ণ যুক্তিশাস্ত্রীয় গ্রন্থ। অনেক পালি গ্রন্থ বাংলা ভাষায় অনূদিত হয়নি। বাংলা ও পালি ভাষার সম্পর্ক বিষয়ক খতিয়ানও তাত্ত্বিকভাবে খুব বেশি স্পষ্ট নয়। আমাদের অনেকেরই অজানা যে, সমণ পুণনানন্দ সামী, রবীন্দ্রবিজয় বড়ুয়ার মতো পালি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশেরই সন্তান। তাদের হাতে রচিত হয়েছে পালি ভাষা ও সাহিত্য বিষয়ক গুরুত্বপূর্ণ বই।
অন্য দিকে আরবি ও ফারসির সঙ্গে বাঙালির যোগ ঐতিহাসিক। বাংলা ভাষার কৈশোর দশায় মুসলমানদের সাম্রাজ্যিক অভিঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ভাষা দুটি প্রবেশ করেছিল। বাঙালি গ্রহণ করেছিল নবাগত ভাষার শব্দমালা। শাসক সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল বলে ভাষা দুটি শেখার একটি সাংস্কৃতিক অভ্যাস গড়ে উঠেছিল। আমাদের মনে রাখা দরকার আরবি ফারসির হাতে হাত মিলিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করে নতুন চিন্তা। এক্ষেত্রে ইসলাম ও সুফিবাদ উল্লেখযোগ্য দুই অবশ্যম্ভাবী সাংস্কৃতিক উপাদান।
কালে কালে বাঙালি নিজেও রপ্ত করতে শিখেছে এই দুই ভাষার রচনাকৌশল। বাংলা ভাষী লেখকের হাতে রচিত হয়েছে আরবি ও ফারসি পুস্তক। যেমন করে এখনকার বাঙালিরা লিখতে চায় ইংরেজি ভাষায়। ফারসি বা আরবি কেবলই মুসলমানের ভাষা -- এমন এক সংকুচিত দৃষ্টিভঙ্গি ভাষাশিক্ষার কার্যকারণকে ব্যাহত করে নি। সংস্কৃতির ভাষা হিসেবে আরবি ও ফারসি গৃহীত হয়েছিল। বাংলার বিখ্যাত মনীষী রামমোহন রায় দুটো ভাষাই শিখেছিলেন, সম্পাদনা করেছিলেন ফারসি পত্রিকা। বাংলা অঞ্চলের অনেকেই ফারসিতে লিখেছেন। ১৮৩৬ সালে আবদুল গফুল নাসাখ লিখেছিলেন বিশ্বজনীন ইতিহাস জামিউত তাওয়ারিখ। উবায়দুল্লাহ আল-উবায়দী ছিলেন উনিশ শতকের ফারসি ভাষার বিখ্যাত কবি। বাংলা অঞ্চলের এসব সৃষ্টিশীলতার খোঁজ খবর কমই নেওয়া হয়েছে।
আরবি ফারসিকে বাতিল করার চেষ্টাও কম হয়নি বাংলাদেশে। বহুচর্চিত এই দুই ভাষার প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। তার একটি উদাহরণ বাংলা ১২৪৫ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ থেকে প্রকাশিত একটি অভিধান; 'পারসিক অভিধান' নামের এই পুস্তক ছিল 'পারসীক শব্দস্থলে স্বদেশীয় সাধুশব্দ সংগ্রহ'। জয়গোপাল তর্কালঙ্কার আরবি ও ফারসিকে বলেছেন 'যাবনিক ভাষা'। তার উদ্দেশ্য ছিল বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত আরবি ফারসি শব্দের অপসারণ এবং 'সাধু শব্দ' পুনঃস্থাপন। জয়গোপালের সাধু শব্দ ও গৌড়ীয় শব্দ আর কিছুই নয়, সংস্কৃত শব্দের অন্য নাম। প্রকৃতপক্ষে সংস্কৃতের প্রতি ব্যাপক আগ্রহ বাংলা ভাষার ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল সংস্কৃতের বোঝা এবং আরবি-ফারসি ভাষার শব্দসম্ভারকে উচ্ছেদ করা হয়েছিল। উচ্ছেদের এই প্রক্রিয়াকেই বাঙালির অপরাপর অংশ প্রত্যাখ্যান করেছে। আরবি ও ফারসির দৌলতে তার নিয়েছে পাল্টা অবস্থান। একপক্ষে আরবি-ফারসি বিরোধী, অন্যপক্ষে সংস্কৃত বিরোধী; কিন্তু এই বিরোধিতার পরিণতি এমন হতে পারে না যে, সংস্কৃত কিংবা আরবি, ফারসি ভাষাকেই প্রত্যাখ্যান করতে হবে কিংবা ভাষাচর্চার কাঠামো থেকে ভাষাসমূহকে উৎখাত করতে হবে।
এ কথা নিশ্চয়ই ঠিক, যে অর্থে ইংরেজি শেখার উপযোগিতা বাংলা অঞ্চলে তৈরি করা হয়েছে সে অর্থে সংস্কৃত, পালি, আরবি বা ফারসি শেখার কোনো উপযোগিতা নেই। প্রশ্ন জাগে, বাংলা শেখার উপযোগিতাও কি আছে? বাংলা যতোই প্রধান ভাষা হোক না কেন, একুশে ফেব্রুয়ারিতে যতোই আবেগে থরো থরো হয়ে কম্পিত হই না কেন, পেশাগত চোখে বাংলার উপযোগিতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলার এই দশায় সংস্কৃত পালি আরবি ফারসির অবস্থান থাকবে উপযোগিতার তলানিতেই। কিন্তু বিপরীত বাস্তবতা সৃষ্টি করা জরুরি। ভাষাগুলো শেখার ও ধারণ করার প্রয়োজন আছে, উপযোগিতা সৃষ্টি করার অনেকগুলো পথও আছে। সুষ্ঠু ও সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার মাধ্যমে সংস্কৃত আরবি ফারসি পালিসহ বিভিন্ন ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থাকে সক্রিয় করা যেতে পারে। বাংলাদেশের সংস্কৃত ও পালি শিক্ষাবোর্ডের অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। ৭৫-পরবর্তী নব্য সাম্প্রদায়িক প্রেক্ষাপটে প্রতিষ্ঠানটি বন্দী হয়ে পড়েছে ভাঙা খুপরিতে। অথচ বাংলাদেশের বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলসমূহে পালি শিক্ষার সাংস্কৃতিক প্রয়োজন আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের পুনর্গঠন তাই জরুরি।
ভাষাসমূহের সামগ্রিক কার্যকারিতার জন্য প্রথম প্রয়োজন আমাদের ভাষা বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। কোনো ভাষাকে অপ্রয়োজনীয় কিংবা মৃত ভাষা হিসেবে ইতিহাসের প্রেতপুরীতে নিক্ষেপ করার অর্থ হলো ভাষার শক্তিকে অবহেলা করা। অথচ অনুশীলনের মাধ্যমে ভাষা সচলও হতে পারে। হতে পারে পুনরুজ্জীবিত। তার প্রমাণ হিব্রু ভাষা। তার অর্থ এই নয় যে, সকালে উঠেই আমরা বলা শুরু করব, দুঃখম্ বিনা সুখম্ ন ভবতি। কিংবা সদা সচ্চং ব্রুহি। বাংলাদেশের এই ভাষাপরিস্থিতি বিচারে তিনটি প্রস্তাব আমি পেশ করতে চাই।
প্রথম প্রস্তাব: সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি শেখার প্রাথমিক ব্যবস্থা ও সুযোগ উন্মুক্ত করা, ভাষা শিক্ষার সাম্প্রতিক পদ্ধতিগুলোর আলোকে সহজতর ও যোগাযোগ সক্ষম প্রেক্ষাপট প্রস্তুত করা। ভিন্ন ভাষায় আগ্রহী ব্যক্তি যেন সহজেই শেখার ক্ষেত্রটিকে ব্যবহার করতে পারে। একই সঙ্গে মাধ্যমিক পর্যায়ে সংস্কৃত, পালি, আরবি শেখানোর বন্দোবস্তকে মুখস্থ বিদ্যার পর্যায়ে না রেখে যোগাযোগ সক্ষম বিদ্যায় পরিণত করা দরকার।
দ্বিতীয় প্রস্তাব : বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ভাষা শিখন ও শিক্ষাদানের ব্যবস্থাকে সময় উপযোগী ও কার্যকরী করে তোলা এবং ভাষা বিষয়ক বিভাগগুলোর কাজের পরিধি বাড়ানো। ভাষার সঙ্গে ব্যক্তির ঐতিহাসিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও পেশাগত যোগাযোগ স্থাপন করা। উচ্চশিক্ষায় প্রতি বছর শত শত শিক্ষার্থীকে সংস্কৃত, পালি, আরবি, ফারসি শেখাবার প্রয়োজন নেই। কিন্তু স্বল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীকে গুণগত শিক্ষা দেবার মাধ্যমে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করা যেতে পারে; তারা যেন কোনো ভাষার প্রাচীন স্তর থেকে শুরু করে সর্বশেষ রূপ পর্যন্ত পড়তে, বুঝতে ও বিশ্লেষণ করতে পারে।
তৃতীয় প্রস্তাব : ভাষাসমূহের জন্য অনুবাদ প্রকল্পের উদ্যোগ গ্রহণ করা। এই প্রকল্পের কাজ হবে সাংস্কৃতিকভাবে প্রয়োজনীয় ভাষাসমূহের পুস্তকের অনুবাদ। ইতিহাস ঘাঁটলেই দেখা যাবে সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, উর্দু ভাষায় রচিত প্রচুর সংখ্যক সাহিত্যিক, সামাজিক ও ঐতিহাসিক রচনা বাংলায় অনূদিত হয়নি। অনুবাদের জন্যে অপেক্ষমাণ অসংখ্য শাস্ত্রীয় গ্রন্থ। অথচ এসব ভাষায় রচিত পুস্তকের রচয়িতা বাংলা অঞ্চলেরই বাসিন্দা। এই প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে উর্দু ও হিন্দি ভাষা। আমরা জানি, বাংলাদেশে দুটো ভাষারই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অস্তিত্ব আছে। বহুকাল ধরেই বাংলাদেশি নাগরিকের কোনো কোনো অংশের মাতৃভাষা উর্দু। এই বাংলাদেশেই রচিত হয়েছে উর্দু ভাষার সমৃদ্ধ সাহিত্য। আর গণমাধ্যমের সূত্রে বাঙালি মাত্রই হিন্দি ভাষায় প্রায় স্বশিক্ষিত। কিন্তু সংগীত, সিনেমা ও সিরিয়ালে আটকে থাকা এই শিক্ষার উচ্চতর কোনো প্রয়োগ নেই।
উল্লেখ্য যে, এই প্রকল্প পরিকল্পনায় বাংলাদেশের চাকমা, মারমা, গারো, ত্রিপুরা, মণিপুরী, সাঁওতালি জাতির ভাষাকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। কিন্তু আমি এসব ভাষার জন্য অন্য একটি বৃহত্তর ভাষাপরিকল্পনার কথা ভাবতে চাই। প্রাক্ প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষার স্তর পর্যন্ত স্বতন্ত্রভাবে এসব ভাষাকে বিবেচনা করতে হবে। কেবল অনুবাদ প্রকল্পের অংশ করে বাংলাদেশের স্থানীয় ভাষাসমূহের যথাযথ অনুশীলন ও পরিচর্যা করা সম্ভব নয়।
প্রশ্ন উঠতে পারে: অনুবাদকে কেন গুরুত্ব প্রদান করছি? অনুবাদের ভেতর দিয়ে প্রকৃতপক্ষে দুটো কাজ সম্পন্ন হতে পারে; এক. ভাষা শেখার ভিত্তিভূমি সুদৃঢ় হবে; দুই. ভাষা শেখার প্রায়োগিক দৃষ্টান্ত হিসেবে জমে উঠবে সাহিত্যিক, দার্শনিক, তাত্ত্বিক রচনার অনূদিত সম্ভার। অনুবাদ প্রকল্প কি একই কাজের পুনরাবৃত্তি করবে? ধরা যাক, মেঘদূতের অনুবাদ অনেক হয়েছে। তেমনি আছে জাতকের অনুবাদ। সেসব রচনার আবার অনুবাদ কেন? এই পুনরাবৃত্তিতে দোষ নেই। বহুজনের হাতে ম্যাকবেথ অনুবাদে যেমন সমস্যা নেই, তেমনি সমস্যা নেই মেঘদূতের অনুবাদে। মনে রাখতে হবে, বুদ্ধদেবের মেঘদূত বিশেষভাবে বুদ্ধদেবেরই অনুবাদ, তার কালের অনুবাদ। এ কালের সংস্কৃত অভিজ্ঞ কোনো ব্যক্তির হাতে পড়লে মেঘদূতের ভাষ্য ও রূপান্তর ভিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।
কোলম্যান বার্কসের ইংরেজি থেকে অনূদিত বঙ্গীয় রুমি যতোই মধুর হোক না কেন তার বর্ণ ও গন্ধ, রূপ ও রস এসেছে প্রধানত দ্বিতীয় হাত মারফত তৃতীয় ভাষায়। রূপসীর রূপদর্শন না করে তৃতীয় সখির দুতিয়ালিতে আমাদের শুনতে হয় রূপসংকীর্তন। রূপ যদি দেখতেই হয়, পরোক্ষে নয়, যতোটা পারা যায় প্রত্যক্ষেই দেখা হোক। যেমন প্রত্যক্ষের সাক্ষাৎ পাওয়া যায় কাজী নজরুল ইসলামকৃত ওমর খৈয়ামের অনুবাদে। ফারসি জানতেন বলেই বাংলা ভাষী পাঠকের জন্য নজরুল উপহার দিতে পেরেছিলেন ইরানের সৌরভ। আর তাই কোনো ভাষাকে মৃত ভাষার প্রেতপুরীতে নিক্ষেপের আগে ভাষাটির ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও বিদ্যায়তনিক প্রয়োজন সম্পর্কে ভাবা দরকার। প্রয়োজনের তাগিদেই হিব্রুর উত্থান ঘটেছে, আবারও লাতিন হয়ে উঠেছে আগ্রহের বিষয়।
সুমন সাজ্জাদ: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Comments