সামাজিক বৈষম্যের দৈত্যটাকে পরাভূত করা চাই
আমাদের প্রান্তিকতা সম্পর্কে কোনো সন্দেহই নেই। প্রান্তিক মানুষের সুখও আছে। ওই যে মৎস্য ধরিব খাইবো সুখে! কিন্তু মাছও এখন আর আগের মতো পাওয়া যায় না। নদী নালা শুকিয়ে গেছে, পুকুরগুলো জীর্ণ। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কলহে, সামান্য সামান্য আকাঙ্ক্ষা বৃষ্টিবর্ষণে মগ্ন থাকাটায় সুখ আছে আশা করা যায়; জগৎ থাকুক জগতের মতো, আমি বরঞ্চ পাশ ফিরে শুই- এইভাবে থাকাটা মন্দ নয়। কিন্তু জগৎ তো সেভাবে থাকতে দেয় না, ত্যক্তবিরক্ত করে, খোঁচায়, চায় আরও প্রান্তে ঠেলে দেবে। তাতে মুস্কিল হয়।
বাণিজ্য আসে। আসে সাম্রাজ্যবাদ। বলে, শুয়ে শুয়ে ঘুমাবে তা হবে না। ওঠো। আমাদের পণ্যের ক্রেতা হও, সেবক হও, আমাদের স্বার্থের জায়গা ছেড়ে দাও, যা কিছু সম্পদ আছে তোমাদের- মাটিতে, মাটির নীচে কিংবা পানিতে তা তুলে দাও আমাদের হাতে।
কিন্তু এই যে প্রান্তিক বলছি এই প্রান্তিকতার সংজ্ঞাটি কি? কাকে বলবো প্রান্তিক? প্রান্তিক হচ্ছে সে কেন্দ্র থেকে যে অনেক অনেক দূরে। কিন্তু এই যে ইংল্যান্ড, এককালে জগৎশাসন করতো, শাসন করতো আমাদেরকেও, সেও তো এক কোণেরই দেশ, দ্বীপ মাত্র, মস্ত এক সমুদ্রের বুকে। সেই ইংল্যান্ড প্রান্তিক নয়, আমরা প্রান্তিক কেন? কারণ হচ্ছে ক্ষমতা। যার ক্ষমতা আছে, এবং নিজের ক্ষমতা যে অন্যের ওপর প্রয়োগ করতে পারে সেই হলো কেন্দ্র, যত বেশী ক্ষমতা ততবেশী কেন্দ্রস্থ হওয়া, আর যার ওপরে যত বেশী ক্ষমতা প্রয়োগ সে ততবেশী প্রান্তে। স্বভাবতঃই।
আমেরিকাও এক সময়ে প্রান্তেই ছিল, যখন সে ছিল অনাবিষ্কৃত; তারপরেও তাকে অনেক দিন প্রান্তিক বলেই বিবেচনা করা যেত, যখন সে ছিল বিভিন্ন ইউরোপীয় জাতির উপনিবেশ। কিন্তু এখন আর নেই। আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে, ক্ষমতাবান হয়েছে, এবং সারা বিশ্বের ওপর কর্তৃত্ব করছে। এখন সে হচ্ছে কেন্দ্র, অন্যরা বিভিন্ন পরিমাণে প্রান্তিক। ব্যাপারটা তাই ভূগোলের নয়, অর্থনীতির বটে। এবং অর্থনীতির কারণেই রাজনীতির অনুপ্রেরণা। বাণিজ্যের জন্য ইউরোপীয়রা জাহাজ ভাসিয়ে দিক্বিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। জলদস্যুপনা করেছে, ভূমি দখল করেছে। কাঁচা মাল সংগ্রহ, বাজার তৈরী, পণ্যবিক্রি, মানুষ কেনাবেচা সবকিছুই ছিল বাণিজ্যের অন্তর্গত। ভদ্রতা বলে কোনো কিছু ছিল না। দখলদারেরা বন্দুকের জোর কাজে লাগিয়েছে, হত্যা করেছে মানুষ, দখল করেছে ভূমি, উস্কানি দিয়েছে গৃহযুদ্ধের, জাহাজ বোঝাই করে মানুষ নিয়ে গেছে, বন্দরে বন্দরে বিক্রি করবে বলে। সবকিছুর কেন্দ্রে ছিল মুনাফা।
এখন ব্যাপার কিছুটা ভিন্ন। কিন্তু মর্মবস্তুতে কোনো বদল ঘটে নি। বাণিজ্য এখনো ওই লুণ্ঠনই। বাণিজ্যের প্রয়োজনে যুদ্ধ চলছে, ঘটছে জবরদখল। স্থানীয় সম্পদ নিজের দেশে নিয়ে যাওয়া, স্থানীয় বাজারে নিজেদের পণ্য বিক্রি করা- এসবের তো ঘাটতি নেই। কাজটা চলে ছদ্মবেশে; ভদ্রতার বিভিন্ন প্রকার আবরণে। এমনকি দাস প্রথাও শেষ হয় নি। প্রান্তিক দেশগুলো থেকে মানুষ তো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুঁজিবাদী বিশ্বে। পার্থক্য অবশ্য একটা আছে। সেটা এই যে, এখন আর জোর খাটাতে হয় না, যারা যায় স্বেচ্ছায় রওনা দেয়, এবং ঢুকতে না-পারলে, অর্থাৎ দাস হবার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হলে, নিজেদেরকে চরমভাবে ভাগ্যহত মনে করে। কেবল অদক্ষ শ্রমিক নয়, দক্ষ, সুশিক্ষিত মানুষও পাগল হয় যাবার জন্য। এমনি বাধ্যবাধকতা। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় যে-মেয়েটি বিক্রির জন্য অন্যকিছু পায় না, নিরুপায় হয়ে সে আপন দেহ বিক্রি করে, লোলুপ ক্রেতাদের কাছে। অসহায় নারীকে তখন বলা হয় যৌনকর্মী; যেন তার কাজটা আর পাঁচজন শ্রমিক-কর্মচারীর মতোই, মজুরীর বিনিময়ে শ্রম বিক্রি। যেন ওই কাজে মেয়েরা স্বেচ্ছায় যায়, যেন ট্রেড ইউনিয়ন গড়বার অধিকার দিলেই তাদের পরম সুখ লাভ। এটা হচ্ছে নতুন ভদ্রতা। আগে লুণ্ঠন লুণ্ঠনই ছিল। তাকে উন্নতিতে সাহায্য করা, দারিদ্র্যবিমোচনের চেষ্টা, বাজার উদারীকরণ, আধুনিকায়ন ইত্যাদি বলা হতো না।
ইংল্যান্ড যদি সমুদ্রে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে অপারগ এবং সেই কারণে উপনিবেশ স্থাপনে ব্যর্থ হতো, উল্টো যদি এমন হতো যে আমাদের বঙ্গভূমিই সমুদ্র ও বাণিজ্যে বিশ্বজয়ী হয়েছে, জয় করেছে ইংল্যান্ডকেও, তাহলেই আমরাই হতাম কেন্দ্র, আর ওই দেশ হতো প্রান্ত। কিন্তু আমরা পারি নি। না-পারার কারণ সমুদ্রব্যবহারে এবং বাণিজ্যপ্রসারে আমাদের অসমর্থতা। আমাদেরও তো সমুদ্র ছিল। জাহাজও ছিল। সমুদ্রপথে সওদাগররা বাণিজ্যে বের হয়েছে, এমন খবরও আছে। কিন্তু সেটা প্রাচীনকালের ব্যাপার, আধুনিক যুগে সমুদ্র আর আমাদের দখলে থাকে নি। আমাদের সমুদ্র অন্যরা নিয়ে নিয়েছে, জলদস্যু, হার্মাদ, বম্বেটে এবং ব্যবসায়ীরা এসেছে বাইরে থেকে; এসে সমুদ্রের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে বাঙালীকে দিয়েছে কোণঠাসা করে। সেই যে সমুদ্র হাতছাড়া হলো, এখনো তাকে ফেরৎ পাই নি; সেটা মস্ত একটা কারণ আমাদের এই প্রান্তিকতার।
সবচেয়ে ধুরন্ধর ও অগ্রসর ব্যবসায়ী ছিল ইংরেজরা। তারা ব্যবসায়ী হিসেবে এসে রাজ্য স্থাপন করলো, এবং ছলেবলে কৌশলে কেবল বাংলা নয়তো সমগ্র ভারতবর্ষকেই নিয়ে নিল নিজেদের অধীনে। বাণিজ্যের উপযোগী সামগ্রী বাংলায় উৎপন্ন হচ্ছিল বৈকি। নইলে ব্যবসায়ী ইংরেজ এলো কেন? বস্ত্র ছিল; চাল, লবণ, তুলা, মশলা, চা, নীল- এসব উৎপাদিত হতো। মাটির নীচে ছিল খনিজ সম্পদ। এসব দ্রব্য বাঙালী নিজে যে বিদেশে পাঠাবে, বিক্রি করে দেশে সমৃদ্ধি আনবে, তেমন দেশপ্রেম তাদের মধ্যে ছিল না। অন্তরায় ছিল সামাজিকও। সেন বংশের রাজাদের আমলে ব্রাহ্মণরাই দেশ শাসন করতো। তুর্কী আগমনের পর তারা শাসনক্ষমতা হারালো ঠিকই, কিন্তু সামাজিক ক্ষমতাকে ধরে রাখলো। আর নিজেদের সেই ক্ষমতা যাতে বিঘ্নিত না হয় সে-জন্য অন্যান্য কাজের মধ্যে এটাও বলে দিলো যে, সমুদ্রযাত্রা হবে অমার্জনীয় পাপ। সমুদ্রগামীদেরকে ভয় করাটা তাদের দিক থেকে মোটেই অযৌক্তিক ছিল না। সমুদ্রে যে যাবে সে তো আর সামাজিক শাসনের মধ্যে থাকবে না।
তার চোখ যাবে খুলে, দুনিয়াটা যাবে বড় হয়ে। তার চেয়েও বড় বিপদের আশঙ্কা ছিল সওদাগরিকে নিয়ে। সওদাগরপুত্র তো একসময়ে রাজপুত্রের কাছাকাছি ছিল, ধনসম্পত্তির কারণে। সেটা গল্পকাহিনীর ব্যাপার। বাস্তবজগতে যদি সওদাগররা ধনদৌলত নিয়ে এসে হাজির হয়, তাহলে বিত্তখোয়ানো ব্রাহ্মণকে তারা মান্য করতে যাবে কোন দুঃখে? সমুদ্রযাত্রা তাই কেবল নিষিদ্ধ করা হয় নি, ব্রাহ্মণরা পারলে সওদাগরদেরকে দেশছাড়া করতো।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর লোকেরা দস্যু ছিল, কিন্তু নিজের দেশের জন্য ছিল কিছুটা ভালোবাসাও। দেশপ্রেমের অভাবের দরুন আমাদের দেশের বণিকেরা তাঁদের মুনাফা তো বটেই, দেশের সম্পদও বিদেশে প্রচার করতে ইতস্তত করেন না; তাঁরা চোরাচালানী, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে তা হজম করে ফেলা ইত্যাদি কর্মকান্ডে সোৎসাহে জড়িত থাকেন। ওদিকে মোবাইল ফোনের ব্যবসায়ী তৎপরতার ভেতর দিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশীদের রক্তপানি করা ডলার বিদেশে চলে যায়। বৈদেশিক ঋণের সুদ গুণতে গিয়ে মুদ্রাতহবিলে টান পড়ে। ওই ঋণ আনানেওয়ার ব্যাপারটাও এক ধরনের ব্যবসা বৈকি। এককথায় বলতে গেলে, ব্যবসায়ী তৎপরতার দরুণ আমাদের নিজস্ব উৎপাদন জোরদার হচ্ছে না। কলকারখানা গড়ে উঠছে না, যা ছিল সেগুলোরও কিছু কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্র এবং বাণিজ্য হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার সঙ্গে আরও একটি বড় কারণ রয়েছে আমাদের এই কোণঠাসা দশার পেছনে। সেটা হচ্ছে পরাধীনতা। বারবার বাইরে থেকে লোক এসেছে, এসে আমাদের দেশ দখল করে নিয়েছে। এর ফলে আমরা উঠে দাঁড়াতে পারি নি। মেরুদণ্ড বাঁকা হয়ে গেছে। আর্য, তুর্কী, পাঠান, মোগল, ইংরেজ, যারাই এসেছে নিজেদেরকে তারা বোঝার মতো চাপিয়ে দিয়েছে জনগণের ওপর, এবং শোষণ করেছে। ওপর থেকে চাপ, এবং ভেতর থেকে নিঃস্বকরণ, দু'ভাবেই স্থানীয় মানুষ প্রান্তিক মানুষে পরিণত হয়েছে। অল্পকিছু মানুষ, যারা শাসকদের কাছ থেকে কিছু অনুগ্রহ সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছে, এবং বিনিময়ে শাসকদের শাসনকে নিশ্চিতকরণে সহায়তা দিয়েছে, তারাই শুধু কিছুটা ভালো থেকেছে। জনগণের অবস্থা ভালো হবে এমন সম্ভাবনা ছিল না, এবং তারা তা হয়ও নি। সাতচল্লিশের পরে স্বাধীন পাকিস্তানের শাসনকর্তারাও তো চেয়েছিল পূর্ববঙ্গকে কোণঠাসা করে রাখবে।
পরাধীনতার কুফল যে কেবল অর্থনৈতিক তা নয়, মনস্তাত্ত্বিকও। পরাধীন থাকতে থাকতে বাঙালী নিজেকে খুবই ছোট ভেবেছ; তাদের মধ্যে যারা উচ্চমনে ছিল, অর্থাৎ কিনা কাছে ছিল শাসকদের, তারাও হীনমন্যতায় ভুগেছে। হীনতার বোধটা মস্তিষ্কে চলে গেছে এবং সেখানে আটকা থাকে নি, থাকবার কথাও নয়; পৌঁছে গেছে মেরুদণ্ডেও। এটা যে কেবল বাংলাদেশের ব্যাপারে সত্য তা নয়। একই ঘটনা উপনিবেশ-শাসিত অন্যান্য দেশেও ঘটেছে।
(আগামী পর্বে শেষ)
Comments