সেলিম আল দীন: প্রসঙ্গ পুতুলনাট্য

বাংলা সাহিত্যের এককালের সৃজ্যমান লেখকদের মধ্যে একমাত্র সেলিম আল দীনকে পুতুলনাট্য নিয়ে ঔৎসুক এবং এর ‘আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে’ প্রয়াসী হতে দেখা গেছে। বিভিন্ন রচনায় তিনি পুতুলনাট্যের উপকরণ ও প্রসঙ্গের অবতারণা ব্যতিরেকেও এর উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। রচনা করেছেন একটি পুতুলনাট্যের পাণ্ডুলিপি।
ছবি: সংগৃহীত

বাংলা সাহিত্যের এককালের সৃজ্যমান লেখকদের মধ্যে একমাত্র সেলিম আল দীনকে পুতুলনাট্য নিয়ে ঔৎসুক এবং এর 'আধুনিকায়ন ও উন্নয়নে' প্রয়াসী হতে দেখা গেছে। বিভিন্ন রচনায় তিনি পুতুলনাট্যের উপকরণ ও প্রসঙ্গের অবতারণা ব্যতিরেকেও এর উন্নয়নে উদ্যোগ নিয়েছেন। রচনা করেছেন একটি পুতুলনাট্যের পাণ্ডুলিপি।

১৯৮৪-৮৫ সালে 'ঢাকা থিয়েটারে'র পক্ষ থেকে 'গ্রাম থিয়েটার' কার্যক্রমের অংশ হিসেবে তিনি পুতুলনাট্যের 'আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের প্রয়াসে' কাজ শুরু করেন। ঢাকার নয়ারহাটে 'বংশাই থিয়েটার' আয়োজিত পৌষমেলা ও তালুকনগরের আজাহার বয়াতীর 'মাঘী মেলা'য় মানিকগঞ্জের শ্রী বলরাম রাজবংশীর পুতুলনাচ প্রত্যক্ষ করেন এবং দলটির সঙ্গে পরিচিত হন। দলটির সঙ্গে গ্রাম থিয়েটারের 'তত্ত্ব ও প্রক্রিয়া' সম্পৃক্ত পূর্বক এ মাধ্যমটির 'উন্নয়ন প্রয়াস' নেন তিনি। তারই 'স্বাক্ষর' হিসাবে তিনি রচনা করেন 'পুতুলনাচের পাণ্ডুলিপি' বিশুকুমারের পুতুলনাচ।

সেলিম আল দীন পুতুলনাট্যকে 'টিকিয়ে রাখা'র লক্ষ্যে 'পৌরাণিক ভাবালুতা'র পরিবর্তে 'আধুনিক জীবন থেকে চরিত্র ও কাহিনী গ্রহণে'র পক্ষপাতি। সেই ভাবনাজাত রচনা তার বিশুকুমারের পুতুলনাচ। এই পুতুলনাট্যটির কাহিনীতে বিধৃত হয়েছে 'মাটির তাল চাকে ফেলে মাটির জিনিস বানায় যে কুমার' অর্থাৎ 'কুম্ভকার' বিশুকুমারের কষ্টকথন। এই কথন হলো মেশিনে তৈরি এনামেল আর টিনের জিনিসপত্রের সাথে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের 'নারাই' (লড়াই)। বর্ণিত পুতুলনাট্যের কাহিনী সংক্ষেপ হলো,-

প্রথমে দুটি গায়ক পুতুল নৃত্যগীত সহযোগে বন্দনাগীত শুরু করে,

                 মাটি আমার মা জননী-ধূলা কুটার শাড়ী।

     মাটি আমার উনান জ্বলন- বাঁশীরাজের হাড়ি ॥

বন্দনাগীত সমাপ্তির পর 'মূলগাতক পুতুল' উপস্থিত দর্শককে জানিয়ে দেন বক্ষ্যমাণ পালার নাম। দুই গায়কের রঙ-রসিকতাপূর্ণ কথোপকথনের মাধ্যমে জানা যায়, 'দ্যাশে যে দিন থিকা এনামেল কুম্পানী বসল হেদিন থিকা কুমারগরে মাথায় বাড়ি'। রামায়ণ, বেহুলার বাসান, লাইলী মজনু, রাধা-কৃষ্ণ প্রভৃতি শাস্ত্রকথা রেখে আহ্বান জানায় গায়ক-পুতুল 'উদিল গা; খালি পা। হাতভরা রগ, গতরভরা শোক' মাখা 'সিয়াবরণে'র কুমারদের কথা শোনার জন্য।

শুরুতেই বিশু-পুতুল ঢুকে জানায় তার মনে সুখ নেই। তার মন জ্বলে 'আগুনে',- 'পেডের আগুন' নিভাবে সে কি দিয়ে? বিশুর সংলাপ থেকে জানা যায়, এক সময় টুপকারচরের কুমারদের ছিল 'কতনা সুনাম'। তখন লক্ষ্মী থাকতো 'কুমারগরে দুয়ারে বান্ধা'। এখন চলে গেছে 'শওরে'(শহরে) আর লক্ষ্মী থাকে 'মিশিঙে' অর্থাৎ মেশিনে। আজকাল কুমারদের তৈরি মাটির জিনিস কেনেনা কেউই; কেনে 'এনামেলের মাল'। শহরের ছোঁয়ায় টুপকার চরের মানুষজনও দালান তৈরি করছে, তারা ঘর থেকে মাটির  তৈরি জিনিস 'ঝাইরা বিদায়' দিচ্ছে। বিশুভাবে, 'যদি মেশিঙের বিরুদ্ধে ফাইট দিবার পারতাম'। পরপর দুই হাট থেকে দু'শ টাকার মাল ফেরৎ এসেছে। পরে শাহামুদ্দি পাইকার মাল নিয়ে যায় অন্য স্থানে 'ভালো বাজার আছে' বলে।

পাইকার শাহামদ্দি এলে জানা যায় 'ভিন জেলায় মাটির তৈয়ার জিনিষের কদর আরও কম'। বিভিন্ন হাটে তার মাল পরিবাহী নৌকা ভিড়ানোর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে সে। তা থেকে জানা যায়, মাটির তৈরি প্রায় সকল জিনিসপত্রের চাহিদা কমে গেলেও কোথাও কোথাও 'গাঞ্জার কল্কি'র কদর আগের চেয়ে বেড়েছে। সে পরামর্শ দেয় গোলাই ডাঙ্গার কুমারদের ন্যায় বিশুও যেন 'এহান থনে হইরা' যায়। বিশু আহাজারি করে 'আহারে সুহেন'! শাহামুদ্দির 'ফেরত মাল' গুলো নিয়ে ফেরি করার জন্য কাঁধে নিয়ে গ্রামে ঢুকে বিশু কুমার। অত বড় বোঝা বাইতে না পারলেও কি অভাব তাকে 'ছাইরা দিব'! সে গান ধরে-

আছে মাথায় মালের ঝাঁপি

কে নিবা ধান দিয়া মাপি

আছে তিল ঘষণি, ধূপের দানী

কালা কলস রাখবা পানি

বিশু কুমারের হাতের ধন

কাঠির বাড়ি ঠনঠনাঠন ॥

আরেক কুমার রসিক লাল তাদের 'দরদী বন্ধু বশর মিয়া এমপি'র নিকট থেকে অর্থ নিয়ে 'ভিডা বাড়ি বেইচা উত্তরের দ্যাশে' চলে যেতে বললে বিশু জানায় সে 'ভিডা' ছাড়বে না। ছেড়ে কোথায় যাবে ? যেখানেই যাবে মাথার সামনে ভগবানের 'জুইড়া' দেয়া 'কপালত' তাদের 'নগেই যাবে'। বশীর মিয়া তাদের 'দরদী' বটে তবে তা 'এনামেল কোম্পানী'র ন্যায় 'দরদী'। রসিক যতোই বোঝায় টুপকার চরে তাদের 'দিন শ্যাষ', বিশু আত্মবিশ্বাসের সাথে জানায় 'ভিটা ছাইরা নর্কবাসী হবার পারুম না'।

বিলাপ করে বিশুর বউ মধ্যযুগের কাব্যনারীদের ন্যায় তার দুঃখের বারমাইশা শুনায়-

বৈশাখ জৈষ্ঠ কাটে আষাঢ় মুহি চাইয়া

আহে শাওন ভাদ্র মাস বান কাটালি লইয়া

আশ্বিন মাসে দূর্গাপুজা ঢোলে বাজে তাল

অভাবের সংসারে উনান শূন্য হাড়ি জ্বাল।

কার্তিকেনা কাইত হয়া রই পৌষে উডে কাশি

মাঘ ফাগুনে চৈত বাতাসে- মুহে নাইরে হাসি ॥

গ্রামের অন্যান্য কুমার পরিবারের ন্যায় 'উত্তুরের দ্যাশে' যেতে রাজি-না বলে ফুলমতি রাগে দুঃখে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত কামনা করে। ক্লান্ত ক্ষুব্ধ বিশু বাড়ি ফিরে বউকে পিটায়, অকথ্য গালিগালাজ দেয়। লাঞ্ছিত ফুলমতি খেদ করে বলে, 'ভগবান- আবার যদি জরমাই, ডোম মুচিগরে ঘরে পাডায়া দিও। . . . কুমার পাড়ায় আর জরম দিওনা'।

কল্পনায় দৃষ্ট 'মা বুসুন্দরী'র উদ্ধৃতি দিয়ে বিশু জানায় এখন থেকে কেউ যেন জিনিসপত্র 'হেলা' করে না বানায়। কলসীর গায় 'লাল বরণ রঙ মাইখা শাদা রঙের কলমী লতা আঁইকা' দিলে 'তাতে রূপ খেলে'। 'সোন্দর জিনিসকে দরকারী' করে তোলার প্রত্যয়ে দৃপ্ত বিশু ঘোষণা দেয় 'ভিটা আমরা ছারুম না'। অতঃপর সমবেত পুতুল নৃত্য-গীত পরিবেশন পূর্বক পালার সমাপ্তি ঘটে-

বল জয় জয় জয়

বল জয় অন্তরে বাহিরে

জাগো বিশু কুমার

বল নাই নাই ভয়

বল কুমারগরে জয়

নারাই কইরা বাঁচতে হবে

[------]

জয় জয় বিশুকুমার জয়।

পুতুলনাট্যের কাহিনী বিন্যাস, সংলাপ কথন, সঙ্গীত প্রভৃতি কতটা দর্শক নন্দিত হতে পারতো, কিংবা শিল্পমূল্যে পালাটির সার্থকতাই বা কতটুকু- সে সব বিচার্য হতো যদি পালাটির প্রয়োগ দৃষ্ট হতো। লেখক সেলিম আল দীন নিছক আবেগ তাড়িত হয়ে পুতুলনাট্যের পালাটি রচনা করেন নি, বরং 'কুমারদের সঙ্গে আধুনিক কালের শিল্পায়ণের দ্বন্দ্ব লোকজ মটিফের শৈল্পিক উত্থান প্রসঙ্গ' প্রকটিত ছিল।

অধ্যাপক সেলিম আল দীন কেবলমাত্র যে বক্ষ্যমান পুতুলনাট্যটি রচনা করেছেন তা-ই নয়, তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এই বলে যে, 'বিশু কুমারের পুতুলনাচের মাধ্যমে আমাদের লেখক সম্প্রদায় এই শিল্প মাধ্যমটি সম্পর্কে তাদের আধুনিক ও সৃষ্টিশীল ঔৎসুক্য প্রকাশ করবেন।' তাঁর এই 'প্রয়াসের আরও উত্তরণ ঘটতো যদি আরও নতুন নতুন বিষয় নিয়ে লেখার সুযোগ' তিনি পেতেন। তদুপরি তিনি 'নির্দ্বিধায়' আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন যে, 'আমাদের ঐতিহ্যপ্রিয় জনগণ 'পুতুলনাচের' আনন্দ ও সৌন্দর্যকে গ্রহণ করতে আজও প্রস্তুত'।

আমরা লেখকের এই প্রত্যাশার সত্যতা লাভ করি পরবর্তী সময়ে তাঁর রচিত চাকা (১৯৯১) নাটকে ব্যবহৃত 'পুতুলনাচের গান' ব্যবহৃত হওয়ার মধ্য দিয়ে। ঢাকা থিয়েটারের চাকা 'কথানাট্যের' মঞ্চ প্রযোজনায় উদ্ধৃত পুতুলনাচের গান কয়েকজন অভিনেতা পুতুলনাট্যের পুতুলের ন্যায় পোশাক পরিধান পূর্বক ভাঙ্গা ভাঙ্গা চলন ও শারীরিক ভঙ্গির নৃত্যের মাধ্যমে 'পুতুল-রূপ' অভিনয়ে পরিবেশন করে। উক্ত পুতুল-রূপ নৃত্যগীত দর্শনের মধ্য দিয়ে দর্শক যেন স্মৃতিতে থাকা ঐতিহ্যবাহী পুতুলনাট্যেরই ভিন্ন পরিবেশনা উপভোগ করেন।

লেখকের আরো কিছু রচনায়ও তিনি পুতুলনাট্যকে প্রাসঙ্গিকভাবে সম্পৃক্ত ও বিষয়বস্তুরূপে অবলম্বন করেছেন। যেমন, ১৯৮৮-৮৯ সালে রচিত তাঁর প্রথম উপন্যাস (লেখকের পক্ষ থেকে 'সর্বশেষ উপন্যাসও বটে' বলে দাবি করা হয়েছে) অমৃত উপাখ্যান-কে তিনি বলেছেন 'দ্বৈতাদ্বৈতের কথকতা'। লেখক উপাখ্যানের মূল কথক মনজুরুল হাসান হাসুর নিজ ভাষ্যে বর্ণনাকৃত প্রত্যক্ষ-গল্পের পাশাপাশি, কল্পনার-গল্পে বুনন করেছেন আর 'এক অমৃত নটের উপাখ্যান'। সেখানে শৈশবের স্মৃতির হাত ধরে বেড়ে ওঠে 'শ্রীনটমুখ' নামক এক কুমোর-পুত্র ও নটি কুট্টমিতার উপাখ্যান। লেখকের ভাষ্যে জানা যায়, নটমুখ শৈশবে দেখা আদিনটের 'পুতুলনাচ থেকে একটু একটু করে অভিনয় শিখে জীবনস্রোতের বাঁকে বাঁকে ভাসিয়েছে ময়ূরপঙ্খী'। নটমুখের অভিনীত পালায় বার বার উঠে আসে জয়দেবের গীতগোবিন্দের রাধা-কৃষ্ণ বিষয়ক পদমালা। সেখানে কল্পনার গল্পের নটি কুট্টমিতা রাধা-পুতুলের ন্যায় নাচতে চায়। কুট্টমিতা জানায়, সে 'পুতুলনাচের অতিথিরূপিত ভঙ্গি ভেঙ্গে' সাধক নট শ্রীকরের চরণে নিবেদনের জন্য একটি অভিনয়াংশ প্রস্তুত করেছে। কথক লেখকের উপলব্ধি হয়, কুট্টুমিতার অবয়বে যেন 'পুতুলের নানা মুখ ভাসে'।

১৯৮৪-৮৫ সালে গ্রাম থিয়েটারের কার্যক্রমের অংশ হিসেবে লেখক পুতুলনাট্য দলের সঙ্গে যে কাজ করেছিলেন বলা যায় তারই ধারাবাহিক পরিচর্যা ও নান্দনিক শিল্পবোধের উৎকর্ষে সিক্ত উদ্বৃত অমৃত উপখ্যান। সেইসঙ্গে লেখকের 'ব্যক্তিগত প্রসঙ্গের লুপ্ত অংশ' এবং প্রাচীন বাঙলা-নাট্যরীতির প্রামাণ্য কবি জয়দেব বিরচিত 'গীতগোবিন্দের বিভিন্ন পালা ও প্রচলিত কৃষ্ণলীলা বিষয়ক আখ্যান পুতুলনাট্যের মাধ্যমে প্রদর্শিত' হবার গবেষণালব্ধ উপলব্ধি প্রভৃতির সংশ্লেষণ ঘটেছে এখানে। বাঙলা সাহিত্যে সৃজনশীল রচনায় পুতুলনাট্যের এরূপ নান্দনিক ও দর্শনজাত সংযুক্তি অভূতপূর্ব।

১৯৯১-৯২ সালে টেলিভিশন ধারাবাহিক রূপে রচিত গ্রন্থিকগণ কহে- তেও লেখকের পুতুলনাট্য বিষয়ক গভীরবোধ ক্রিয়াশীলতার নমুনা দৃষ্ট হয়। উক্ত ধারাবাহিকের সূচনা পর্বের নামাঙ্কৃত করেছেন 'নাচায় পুতুল যথা' শিরোনামে। অতঃপর শুরু করেন, 'পুতুলনাচ যাত্রার প্রচলিত কনসার্টজ্জ ছোট্ট দু'তিনটি নারী-পুতুল ঘুরে ফিরে গায়জ্জ ওরে আগে পিছে পঞ্চদাসী রেজ্জ ওরে মধ্যে কন্যা যায়।' অর্থাৎ প্রচলিত লোকায়ত সুরের স্নান-গীতের সাথে নৃত্যকী-পুতুলের নৃত্য-অভিনয় দিয়ে উন্মোচিত হয়েছে ধারাবাহিকের গল্প। নৃত্যকী-পুতুলেরা 'চিত্রার্পিত' হলে বর্ণনা শুরু হয়। তাতে লেখক জানান, গ্রন্থিকগণের গল্প প্রবাহে 'ক্ষীণ বিশুষ্ক প্রায়' যাত্রাপালা ও তার গ্রন্থিকগণের দৃশ্যের আড়ালে যাপিত সেই পতিত দগ্ধ জীবনের কণা তুলে ধরার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছেন তিনি। তাঁর অকপট স্বকারোক্তি, নানা নাম চিহ্ন অঙ্কিত গ্রন্থিকেরা 'এখানে ব্যক্তি স্বরূপ বারবার পুতুলের মূল ভঙ্গীমার দিকে চলে যায়। ক্রমে ক্রমে হয়ে ওঠে জনগণের আনন্দ লিপ্সার ক্রীড়নক।'

হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহী বাঙলা আখ্যান পরিবেশনারীতি 'পাঁচালি'র আঙ্গিকজাত 'মহাকাব্যিক গুণসম্পন্ন' 'মঙ্গলকাব্যে'র দর্শনগত কাঠামোয় সেলিম আল দীন অভিযোজিত করেছেন যাত্রাপালার গৌষ্ঠীবদ্ধ মানুষের 'লৌকিক অভিজ্ঞতা ও অতিলৌকিক কল্পনার গীতনাট'। একে রূপকার্থ ব্যঞ্জনাদানের নিমিত্তে তিনি প্রতিস্থাপিত করেছেন নেপথ্য থেকে সুতা দ্বারা অভিনেতা কর্তৃক সঞ্চালিত পুতুলনাট্যের সাথে। স্মর্তব্য, পুতুলনাট্যের এরূপ ব্যঞ্জনাধর্মী প্রয়োগের প্রতিতুলনা কিছুমাত্র লভ্য শুধু পুতুলনাচের ইতিকথা উপন্যাসে।

'কথানাট্য' শিল্পরীতির আশ্রয়ে রচিত তাঁর দ্বিতীয় নাটক যৈবতী কন্যান মন (রচনা ১৯৯১, প্রকাশকাল ১৯৯২)। দুটি পৃথক খণ্ডে দুই ভিন্নকালের 'নারী চিত্তের বিচিত্র ঐশ্বর্য্যরে সৌন্দর্য্য আস্বাদনের আবেগ' ও 'ভ্রমের উৎপাদনে' সৃজিত দ্বন্দ্ব-চিত্র অঙ্কন করেছেন লেখক। তাঁর মতে, তিনি প্রথম খণ্ডে 'অষ্টাদশ শতকের ধর্মকাব্যের সঙ্গে গীতিকা পালার দ্বন্দ্বের ছবি আঁকতে চেয়েছেন' এবং 'দ্বিতীয় খণ্ডে প্রাকৃত জীবনের গন্ধমাখা এক নারী- পরী- শিল্পের ভেতর দিয়ে যে অহং তৈরি করল তা আত্মবিনাশী। শিল্প ও জীবনকে প্রায় এক বিন্দুতে মেলাতে চেয়েছিল সে।'

দ্বিতীয় খণ্ডে 'প্রাকৃত জীবনের গন্ধমাখা' 'নারীকল্প' চিত্রণের নিমিত্তে লেখক নির্বাচন করেছেন প্রাকৃত শিল্প যাত্রা ও পুতুলনাট্যের ভূবনকে। তিনি এক নারীজ্জ পরীকে সৃজন করেছেন জীবনের অর্ধেককাল যাত্রাপালায় ভেসে বেড়িয়ে যাত্রা দলের মেয়ে মনিরা বেগমকে নিয়ে ফিরে এসে ঘর বাঁধা মাজেদুল হকের গৃহে। মাজেদুল হক শিল্প ও জীবনের তাগিদে গড়ে তোলেন 'মৌরাবি পুতুলনাচ'। মাজেদুল হক ছোট্ট মেয়ে পরীকে পুতুলের মতো সাজিয়ে-হাত-পা-চোখ পুতুলের ন্যায় ন্যাস করে নিজে অথবা স্ত্রী মনিরা বেগমকে দিয়ে গাওয়াতেন।

পুতুল তোমার জনম কিরূপ যে জানে।

    আলোকলতায় বাইন্ধা সুতায় সে টানে॥

সেই সঙ্গে শিক্ষা দিতেন মেয়েকে নৃত্য ও অভিনয়-শিল্পের 'ভেদের কথা তত্ত্বকথা'। তাঁর ভাষ্য ছিল, 'পুতুল কি পুতুল নাচেরেজ্জ নিজের পরাণেরটা নাচে কালাসুতায়।' মৃত্যুর উপান্তে পিতা মাজেদুল হক কন্যার হাত চেপে ধরে টান দিয়েছিল; পরীর মনে হয়েছে- 'ঠিক যেভাবে পুতুলনাচের সুতা টানতো বাবা কিংবা কাউকে শেখাতো সেই টান। পরীকে কি পুতুল ভেবেছিল বাবা?'

পুতুলনাট্য দলের প্রতিষ্ঠাতা, যিনি পৈতৃক মৎসজীবী পেশা গ্রহণ না করে প্রাকৃত শিল্পের পথ বেছে নিয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে 'মৌরাবি পুতুলনাচ' দলে যে সংকট-দ্বন্দ্ব সৃষ্ট হয়, তা এই জনপদের পুতুলনাট্য দলের চিরায়ত সংকট। লেখক প্রাকৃত জীবনের ভেতর বেড়ে ওঠা এক নারী এবং লোকায়ত শিল্প ধারায় সৃজিত শিল্পী; শিল্প ও জীবনকে এক বিন্দুতে মেলানোর দ্বন্দ্ব ক্লিষ্ট পরীকে চিত্রিত করেছেন আবহমান বাংলার চিরায়ত শিল্পধারার চিত্রপটে।

একদা মৌরাবি গাঁয়ের যে পরী 'সোনাঝুরি ফুল গাছদের পুতুল নাচিয়েছিল। সেই পরী এই লোকজ শিল্পের ভেতরে পতিত প্রাকৃত জীবনে অম্লনদীতে শেষমেশ জীবন শবের মান্দাস ভাসায়।' সে নিজ শিল্পগুরুর নিকট 'কাম' যাচনা করে- 'নাই নাই। শিল্পীর কোনো ধর্ম নাই। তার ইচ্ছা নেশা তার ধর্ম।' লেখকের অমৃত উপাখ্যানে কল্পনার-গল্পে বেড়ে ওঠা শূদ্রকন্যা নটি কুট্টমিতাজ্জ যার চোখে ছিল পুতুলের নাচ জ্জ রাধা-পুতুলের ন্যায় নাচতে চেয়েছিলজ্জ তার আর্তনাদ, 'ধর্ম আমার হলো না, শিল্পের ঘরে পারলামনা পৌঁছাতে। কাম আমাকে ভাসিয়ে নিল';  সেই আর্তনাদের প্রতিধ্বণি যেন শুনতে পাই আরেক যাত্রা-পুতুলনাচের মেয়ে পরীর কণ্ঠেজ্জ 'কবে আমার এই আসর পালা শেষ হবে! কোন দ্যাশে গিয়া; ঠেকবে আসরজ্জ খোদার আরশের কাছে যাবো না? ঐ আকাশ ছুবোনা ! নাকি কারো ছোঁয় কারো ছোঁয় না ?' 'প্রেতসিদ্ধ' কবির দুই নারীই মনোবেদনা ও আত্মদংশনের দ্বান্দ্বিকতায় নিজেদের তুলে দেয় আত্মহননের অজগরের মুখে। প্রাকৃত জীবন ও চিরায়ত শিল্পের এই দ্বান্দ্বিক পরিণতির জন্য লেখক আশ্রয় করেছেন লোকায়ত শিল্পধারা পুতুলনাট্যের।

'এই জগত সংসার কোন সুতার টানে নাচে? বাঁচে মরে, জনম লয়?'- এই অনির্ণেয় প্রশ্নকে বার বার সম্মুখবর্তী করে লেখক একদিকে যেমন এক মানবীয় নারীর শিল্প ও জীবনের দ্বান্দ্বিক রূপকে বাঙ্ময় করে তুলেছেন, পাশাপাশি এদেশের পুতুলনাট্য দলের সচরাচর গড়ে ওঠা সংকট- পেশাপগত দ্বন্দ্ব- ঈর্ষা- সামাজিক সমস্যা- ভেতরের অন্ধকার দিক- পেশা বদল-অর্থনৈতিক- সামাজিক- ব্যক্তিক নিরাপত্তাহীনতা-  এর ভেতরের মানুষদের প্রেম-ভালোবাসা-হাসি-কান্না-দুঃখ-যন্ত্রণা-কষ্টকথা- শিল্প-দর্শন-অভিনয়তত্ত্ব- যাবতীয় কিছু তুলে ধরেছেন লেখক যৈবতী কন্যার মনের 'পরী' খণ্ডে। ঔৎসুক্য গবেষকবৃন্দ উক্ত গ্রন্থের আলোকে এদেশের পুতুলনাট্য ও যাত্রা দলের আর্থ-সামাজিক ও শিল্পভাবনা বিষয়ে গভীর অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করবেন- আশা করা যেতেই পারে।

 

ড. রশীদ হারুন: অধ্যাপক, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
 

Comments

The Daily Star  | English
Bangladesh Bank dissolves National Bank board

Bangladesh Bank again dissolves National Bank board

The bank’s sponsor director Khalilur Rahman made the new chairman

1h ago