সৈয়দ আবুল মকসুদ ও তার ওয়ালীউল্লাহ চর্চা

এক দুঃসময়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ চলে গেলেন যে তার বিদায়ে উপযুক্ত শোক প্রকাশের অবকাশও পাননি তার পাঠক ও প্রীতিভাজনেরা। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু শানিত। প্রখর ব্যক্তিত্ব ও দীপ্তি ছিল তার কথায় ও কাজে। হয়তো সে কারণে তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল সীমিত। পেশাগত পরিচয়ে তিনি সাংবাদিক, কলাম লেখক, তথ্যানুসন্ধানী একজন উঁচুমানের গবেষক ছিলেন। তার প্রাত্যহিক জীবনে গান্ধীবাদের প্রভাব আমরা দেখতে পাই। গান্ধীর অহিংস নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। গান্ধীর ওপর লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। আবার মাওলানা ভাসানীরও ভক্ত ছিলেন তিনি। আপোষকামিতার যে বর্তমান সমাজ, তার থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদ ব্যতিক্রম এবং একধরনের প্রতিবাদী জীবনই বেছে নিয়েছিলেন।

এক দুঃসময়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ চলে গেলেন যে তার বিদায়ে উপযুক্ত শোক প্রকাশের অবকাশও পাননি তার পাঠক ও প্রীতিভাজনেরা। তার কণ্ঠস্বর ছিল শান্ত কিন্তু শানিত। প্রখর ব্যক্তিত্ব ও দীপ্তি ছিল তার কথায় ও কাজে। হয়তো সে কারণে তার বন্ধুবান্ধবের সংখ্যা ছিল সীমিত। পেশাগত পরিচয়ে তিনি সাংবাদিক, কলাম লেখক, তথ্যানুসন্ধানী একজন উঁচুমানের গবেষক ছিলেন। তার প্রাত্যহিক জীবনে গান্ধীবাদের প্রভাব আমরা দেখতে পাই। গান্ধীর অহিংস নীতিতে তিনি বিশ্বাসী ছিলেন। গান্ধীর ওপর লিখেছেন একাধিক গ্রন্থ। আবার মাওলানা ভাসানীরও ভক্ত ছিলেন তিনি। আপোষকামিতার যে বর্তমান সমাজ, তার থেকে সৈয়দ আবুল মকসুদ ব্যতিক্রম এবং একধরনের প্রতিবাদী জীবনই বেছে নিয়েছিলেন।

হুমায়ুন আজাদের ওপর মৌলবাদীদের হামলাকে 'ফ্যাসিবাদের নগ্নরূপ' হিসেবে আখ্যায়িত করে ২০০৪ সালের মার্চ মাসে প্রথম আলোতে একটি কলাম লেখার কারণে, বাসস থেকে তাকে এ ধরনের লেখার জন্য বারণ করা হয়। এর প্রতিবাদে তিনি বাসস থেকে পদত্যাগ করেন। অনেকে হয়তো জানেন, ইরাকে যুক্তরাষ্ট্রের আক্রমণের পর তিনি অভিনব কায়দায় প্রতিবাদ করেন। তার শপথ ছিল ইরাকে যতদিন মার্কিন আগ্রাসন অব্যাহত থাকবে, ততদিন পশ্চিমাদের উদ্ভাবিত সেলাইকরা কাপড় পরবেন না। আমৃত্যু তা রক্ষা করেছিলেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ বিষয়ে আমার অদম্য কৌতূহল দেখে আমাকে তিনি কাছে টেনে নিয়েছিলেন। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর কর্মসূত্রে দীর্ঘদিন প্রবাসে থাকার কারণে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার আকস্মিক মৃত্যুর পর স্বাধীন বাংলাদেশে তার মতো গুরুত্বপূর্ণ লেখক সমকালীন পাঠকদের কাছে ছিল অপঠিত, অপরিচিত। সৈয়দ অবুল মকসুদই প্রথম সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জীবন ও সাহিত্য গ্রন্থ রচনার মধ্য দিয়ে এই অবিস্মরণীয় কথাশিল্পীকে বাংলাদেশের মানুষদের সামনে হাজির করেন। যে বৃহত্তর মুসলমান সমাজকে পটভূমি করে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আবির্ভাব, সেই সমাজের অভ্যন্তরীণ অপবিশ্বাস, অন্ধকারাচ্ছন্ন পরিমণ্ডলকে ছিঁড়েখুঁড়ে অভাবনীয় চেহারায় তিনি উন্মোচিত করেছেন, সেই তাৎপর্য বুঝে ওঠার জন্য তখনো বাঙালি মুসলমান সমাজ প্রস্তুত ছিল না।

ওয়ালীউল্লাহর প্রতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষিত হয় অনেক পরে, তার মৃত্যুর পরে ধীরে ধীরে। পরবর্তীতে বাংলা একাডেমি থেকে সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর রচনাবলী প্রথম খণ্ড (উপন্যাস তিনটি) ১৯৮৬ সালে এবং দ্বিতীয় খণ্ড (দুটি গল্পগ্রন্থ: নয়নচারা, দুইতীর ও অন্যান্য গল্প, অগ্রন্থিত ৩২টি গল্প, নাটক: বহিপীর, তরঙ্গভঙ্গ, সুড়ঙ্গ, উজানে মৃত্যু, বিবিধ) ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়। যদিও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর বিপুল সংখ্যক লেখা ওই রচনাবলীর বাইরে রয়ে গেছে। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অগ্রন্থিত লেখা প্রসঙ্গে একটু পরেই আলাপে আসছি। এরপর সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকর্ম নিয়ে উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন অনেকে—আবু রুশদ্, শওকত ওসমান ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর উপন্যাস আবদুল মান্নান সৈয়দ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ জিনাত ইমতিয়াজ আলী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ: জীবন দর্শন ও সাহিত্যকর্ম মোহাম্মদ জয়েনুদ্দীন, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর নাটক তানভীর মোকাম্মেল, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সিসিফাস ও উপন্যাসে ঐতিহ্য জিজ্ঞাসা শামসুদ্দিন চৌধুরী, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যে প্রতীচ্য প্রভাব ইত্যাদি। কিন্তু সৈয়দ আবুল মকসুদের কাজটি ছিল প্রথম এবং তিনিই সূত্রটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন।

'সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য' গ্রন্থের সূচিপত্রের দিকে তাকালে দেখা যায়, দুইভাগে বিন্যাস্ত করে বইটির পরিকল্পনা সাজিয়েছেন তিনি। প্রথম ভাগে পাঁচটি অংশ, ১. জীবন ২. ছোটগল্প ৩.উপন্যাস ৪. নাটক ৫. বিবিধ-প্রসঙ্গ। বোঝা যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সামগ্রিক সৃষ্টিকর্মের ওপর তিনি আলো ফেলতে চেয়েছেন। দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে ছয়টি অংশ, ১.অগ্রন্থিতা ২. কবিতা ৩. চিত্রসমালোচনা ৪. ছোটগল্প ৫. পত্রাবলি ৬. পরিশিষ্ট। এই ভাগে মূলত নানা তথ্য-উপাত্ত থেকে প্রাপ্ত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর অগ্রন্থিত, দুষ্প্রাপ্য লেখাগুলোকে সন্নিবেশিত করা হয়েছে। এখানে তার কবিতা, চিত্রসমালোচনা, নানা পত্রিকায় প্রকাশিত প্রথম পর্যায়ের গল্প, বিভিন্নজনের সঙ্গে তার পত্রালাপ, পরিশিষ্টে তার জীবনপঞ্জি, গ্রন্থপঞ্জির তথ্য রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে তথ্য যাচাই-বাছাই করে, সুচিন্তিত, পদ্ধতিগত শৃঙ্খলার নৈপুণ্য দিয়ে তিনি সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সাহিত্যকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন এবং অগ্রন্থিত বিচিত্র বিষয়ে লেখাগুলোকে সূত্রাবদ্ধ করেছেন। যেমন: ওয়ালীউল্লাহর জন্মদিন নিয়ে বিভ্রান্তি- '১২ বা ২১ মার্চ কিংবা ১৫ আগস্ট এ তিনটির একটিও তার জন্মদিন নয়। বাংলাদেশের লেখক পরিচিতিতে ৫ আগস্ট উল্লেখ আছে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি নিজ হাতে টাইপ করে যে জীবনপঞ্জি তৈরি করেছিলেন, তাতে তার জন্মদিন ১৯২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর লেখা রয়েছে। তার পারিবারিক ও অন্যান্য সূত্র থেকেও আমি নিশ্চিত হয়েছি যে তার জন্মদিন ১০ সেপ্টেম্বর।'

সৈয়দ আবুল মকসুদের গ্রন্থ থেকে প্রথম জানা যায়, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ শুধু কথাসাহিত্যিক নন, একজন ক্ষমতাবান চিত্রশিল্পী, চিত্রসমালোচক, কাঠের নকশার কাজও জানতেন। তার পরিচিত পরিমণ্ডল, বন্ধু-বান্ধব, রাজনৈতিক দৃষ্টি, শৈল্পিক চেতনা সম্পর্কেও আমরা অবগত হই। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর প্রথম দিকের প্রায় হারিয়ে যাওয়া রচনাবলী সংগ্রহ করে আবুল মকসুদ একটি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ সংগ্রহকৃত গল্পের সংখ্যা ছিল ১৩টি, পরবর্তীতে সৈয়দ আকরম হোসেন সম্পাদিত রচনাবলীর দ্বিতীয় খণ্ডে ওই ১৩টিসহ আরও ১৯টি নিয়ে মোট ৩২টি অগ্রন্থিত ছোটগল্প সংকলিত হয়। 'এ্যাকাডেমিক অব ফাইন আর্টস এক্সিবিশন' শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের প্রদর্শনীর সমালোচনা। এটাই সম্ভবত বাংলাদেশের কোনো চিত্রশিল্পীকে নিয়ে লেখা প্রথম চিত্র সমালোচনা। পত্রাবলি অংশে তৎকালীন ঔপন্যাসিক, কাজি আফসারউদ্দিন আহমদকে লেখা ৫টি, সৈয়দ নুরুদ্দিনকে ৪টি, কায়সুল হক, এ, কে, নাজমুল করিম, কবি আবুল হোসেন, বেগম আমেনা আমানুজ্জামান খান, মাহমুদ শাহ কোরেশীকে লেখা ১টি করে এবং শওকত ওসমানকে লেখা ২টিসহ মোট ১৬টি পত্র এতে পাওয়া যায়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে তার দ্বিতীয় গ্রন্থটি হচ্ছে- স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। ওয়ালীউল্লাহকে নিয়ে কাজ করতে গিয়ে তার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, সমসাময়িক অনেকের সঙ্গে তাকে কথা বলতে হয়েছে। সেসব সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ উঠে এসেছে এই গ্রন্থে। এখানে কেবল ব্যক্তি ওয়ালীউল্লাহ নয়, একই সঙ্গে তৎকালীন সমাজ-শিল্প-সাহিত্য-রাজনীতি-সংস্কৃতির একটা পরিচয়ও পাওয়া যায়। অগ্রজ সৈয়দ নসরুল্লাহ, বিমাতার চোখে, নজমুল করিম: স্কুল-কলেজ, মোহাম্মদ তোহা: ঢাকা কলেজ, প্রেম ও নারী, কাজি আফসারউদ্দিন আহমদ, মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন: সওগাত, গোলাম কুদ্দুস, শওকত ওসমান, আবু সাঈদ চৌধুরী: মুক্তিযুদ্ধ, আবদুল মতিন প্রমুখের মুখ থেকে শোনা স্মৃতিকথার মধ্যে পাঠক উজ্জ্বল তারুণ্যে ঝলকিত ভিন্ন এক ওয়ালীউল্লাহকে আবিষ্কার করতে পারবে। বিশেষত তার সহধর্মিণী এ্যান-মারি রোজিতা মার্সেল থিবোর সাক্ষাৎকার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে তার প্রেম-বিবাহ, রুচি, ব্যক্তিত্ব, পারিবারিক জীবনের অনালোকিত দিক উন্মোচিত হয়েছে এই অংশে। এ্যান-মারি বলেন—'ইন্ডিয়ান পার্টিশন নিয়ে কথা হয়েছে। হিন্দু-মুসলমানের বিরোধের মূল কারণ নিয়ে কথা বলতেন। ধর্মীয় সংকীর্ণতা, হিন্দুদের বর্ণ প্রথা, মুসলমানদের অনগ্রসরতা, ধর্মীয় গোঁড়ামী, অগ্রসর হিন্দু নেতাদের নির্মম স্বার্থপরতা.. সব আলোচনায় আসত। কলকাতার কলেজ-জীবনে একবার পিকনিকে গিয়েছিলেন। দলে তারা মাত্র দুজন ছিলেন মুসলমান। হিন্দু ছাত্ররাই রান্নাবান্না করেন। খাবারের সময় তাদের দূরে আলাদা বসতে হয়েছিল। রেলস্টেশনের দুই প্রান্তে পানির কল থাকত দুটি। মুসলমানদের একদিকে, হিন্দুদের অন্যদিকে। সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ছিল ওঁর কাছে অসহনীয়।'

এখানে ওয়ালীউল্লাহর মানস-পরিচয় ফুটে উঠেছে চমৎকারভাবে। ওয়ালীউল্লাহ সম্পর্কে অনেক তথ্য প্রথমবারের মতো তুলে ধরা হয়েছে এই বইতে। কিন্তু এসবে বাইরেও ওয়ালীউল্লাহর অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ লোকচক্ষুর আড়ালে রয়ে যায়। ২০১৩ সালে 'প্রথমা প্রকাশন' থেকে সাজ্জাদ শরিফের সম্পাদনায় সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ অগ্রন্থিত রচনা শিরোনামে বইতে ২টি ছোটগল্প-'মুক্তি' (গল্পটি ইংরেজিতে লেখা। অনুবাদ করেছেন শহিদুল জহির) 'আমাদের প্রপিতামহ' প্রবন্ধ-সমালোচনা-স্মৃতিকথা- 'আমাদের কয়েকজন শিল্পী' 'বাহারদা' হাবীবুল্লাহ বাহারকে নিয়ে স্মৃতি এবং তার কলেজ জীবনের বন্ধু হৃষীকেশ বাবুকে লেখা ২০টি চিঠি সংকলিত হয়। 'অজানা ওয়ালীউল্লাহ' শিরোনামের ভূমিকায় সাজ্জাদ শরিফ লিখেছেন—'ওয়ালীউল্লাহর জীবনের কিছু কিছু দিক আজও আমাদের কাছে গাঢ় ছায়ায় আচ্ছন্ন, এতদিন পরেও তার বেশ কিছু লেখা অগ্রন্থিত ও অপ্রকাশিত—অনেক লেখা হয়তো হারিয়ে যাওয়ার পথে। ইংরেজিতে অন্তত একটি উপন্যাস দ্য 'আগলি এশিয়ান' উপন্যাসিকা 'হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিন্স্' লিখেছিলেন আবু শরিয়া ছদ্মনামে। কদর্য এশীয়—এ উপন্যাসটি লেখা হয়েছিল জে লেডারার ও ইউজিন বারডিকের লেখা তীব্র কমিউনিস্টবিরোধী উপন্যাস দ্য আগলি অ্যামেরিকান এর আবেগভরা প্রতিক্রিয়ায়। দ্য আগলি এশিয়ান এর পটভূমি নগর—আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে তৃতীয় বিশ্বের একটি কাল্পনিক রাষ্ট্রের রাজধানী। এ উপন্যাসের কুশীলবরা ক্ষমতার নিয়ন্তা। ১৯৫৪ সালে যে ইংরেজি উপন্যাসটি ওয়ালীউল্লাহ লিখেছিলেন, তার বিষয় ঔপন্যাসিকের অভিজ্ঞতায় ধরা পড়া বাংলাদেশের গ্রাম। আন-মারিকে ১৫ অক্টোবর ১৯৫৪-তে এক চিঠিতে এ উপন্যাস সম্পর্কে ওয়ালীউল্লাহ লিখেছেন—'এটি আসলে এখানকার গ্রামাঞ্চলের জীবনযাত্রার ওপর ভিত্তি করে লেখা উপন্যাস তবে এর পরতে পরতে আছে আমার ব্যক্তিগত ভাবনাচিন্তা। এর আঙ্গিকটি মজাদারও হতে পারে।'...সেটি গেল কোথায়?'

এর উত্তর পেতে হয়তো সৈয়দ আবুল মকসুদের মতো কোনো অনুসন্ধানী গবেষকের অপেক্ষায় থাকতে হবে। সাজ্জদ শরিফ জানাচ্ছেন, দ্য আগলি এশিয়ান, হাউ ডাজ ওয়ান কুক বিন্স্ -এর পাণ্ডুলিপি পেয়েছেন সুলতানা সারওয়াত আরা জামানের কাছ থেকে। বাংলা একাডেমি থেকে সৈয়দ আকরম হোসেনের সম্পাদনায় তার যে দুই খণ্ডের রচনাবলী বের হয়েছিল, তার ধারাবাহিকতকতায় ইংরেজি লেখাগুলো সংকলিত করে তৃতীয় খণ্ড বের হবার কথা। ওয়ালীউল্লাহর স্ত্রী তৎকালীন একাডেমির মহাপরিচালক মনসুর মুসার সঙ্গে কথাও হয়েছিল, কিন্তু বেশ কয়েকটি চিঠি দেওয়ার পরও একাডেমির পক্ষ থেকে কোনো উত্তর পাননি। তার সহধর্মিণী আন-মারি থিবো ১১ জুলাই ১৯৯৮ প্যারিসে পরলোকগমন করেন। আন-মারি থিবো ইংরেজি রচনা খণ্ডের জন্য একটা তালিকাও করেছিলেন। সে তালিকায় ছিল শিল্পী জুবাইদা আগা ও সাদেকাইনের চিত্রকলা নিয়ে নিবন্ধ, পাকিস্তানের জনগণ, সঙ্গীত ও নারী স্বাধীনতা নিয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ, 'এলিট অ্যান্ড ম্যাস কালচার' 'বুক ডেভেলপমেন্ট' 'আন্ডার ডেভেলপমেন্ট' এবং 'মিডিয়া অ্যান্ড ভায়োলেন্স' এবং আরও কিছু পত্র। এসব লেখার ভবিষ্যৎ এখন অনিশ্চিত।  আমাদের প্রত্যাশা, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ইংরেজি রচনাগুলো সংকলিত করে অচিরেই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হোক। বাংলা একাডেমি এই দায়িত্ব পালনে এগিয়ে আসবেন নিশ্চয়।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু' উপন্যাস আজো পাঠ করা হয় ধর্মব্যবসা, মাজারভক্তির, ইসলামের গোঁড়া অনুসারীর বিপরীত দৃষ্টিকোণ থেকে। কিন্তু যে মাজার মজিদের নিরঙ্কুশ ক্ষমতার উৎস, যে ক্ষমতা বলে গ্রামবাসীর ওপর মজিদ একছত্র কর্তৃত্ব করে, প্রভুত্ব খাটায়, ক্ষমতার এই জটিল সম্পর্কের দিক থেকে কেউ তা পাঠ করেনি। এখানকার একাডেমিক আঙ্গিনার গবেষণা সন্দর্ভের আরোপিত ধারণা, যেমন- ওয়ালীউল্লাহ 'অস্তিত্ববাদী লেখক' 'চেতনা প্রবাহরীতি' ইত্যাদি অতিচিহ্নিত তকমার তলানিতে চাপা পড়ে গেছে অন্য পাঠ ও বিশ্লেষণ। 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসে বাঁকাল নদীতে চর পড়ার ফলে স্টিমার চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া, মূল ভূখণ্ড থেকে কুমুরডাঙ্গা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, নদীর কান্না-এসব রূপকের সঙ্গে তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনৈতিক টানাপোড়েনর উত্তাল প্রেক্ষাপটের আশ্চর্য মিল কীভাবে পাঠকের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়? তৎকালীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের পূর্ব-পশ্চিম দুই অংশের মধ্যে ক্রম-বিচ্ছিন্ন হতে থাকা বাস্তবতার রাজনৈতিক রূপক হচ্ছে 'কাঁদো নদী কাঁদো'। 'দ্য আগলি এশিয়ান' আগাগোড়া একটা রাজনৈতিক উপন্যাস। এখানে যে দেশ, তার নাম বাংলাদেশ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তৃতীয় বিশ্বের দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এবং অভ্যন্তরীণ ক্ষমতা বিন্যাসের গ্রন্থী উন্মোচনই দ্য আগলি এশিয়ান-এর মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।

 সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু', 'চাঁদের অমাবস্যা', 'কাঁদো নদী কাঁদো' এই তিনটি উপন্যাসের তিনটি চরিত্র লালসালু'র-অক্কাস, চাঁদের অমাবস্যা'র-আরেফ আলী, কাঁদো নদী কাঁদো'র-মুস্তফাকে বাংলাদেশের তিন প্রজন্মের প্রতিনিধি কল্পনা করে বাংলাদেশ অঞ্চলের আধুনিকায়নের উদ্যোগ-আয়োজন করেছেন। সেটা তত্ত্বীয়ভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে না মার্কসবাদী, না সেক্যুলার বরং দর্শনগত উচ্চতার। সেই সময়ের অবিকশিত বাঙালি মুসলমান সমাজ এবং বিরাজমান বাস্তবতার কোনো বদল আজো ঘটেনি। অভ্যস্ত রীতি, আরোপিত ধারণার বাহিরে গিয়ে এভাবে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে পাঠে আজো আমরা পৌঁছতে পারিনি। সৈয়দ আবুল মকসুদের কৃতিত্ব, তিনি প্রথম ওয়ালীউল্লাহর বিষয়ে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন এবং ওয়ালীউল্লাহ চর্চার পথিকৃৎ হিসেবে কাজ করেন।

একজন ভাবুক ও চিন্তক হিসেবে সৈয়দ আবুল মকসুদকে ইতিহাস, রাজনীতি, স্মৃতি ও চেতনার অনুসন্ধানে ব্যাপ্ত থাকতে দেখি। তার বইয়ের তালিকা দেখলে বোঝা যায়, কত বিচিত্র বিষয়ে তার আগ্রহ ছিল। কাগমারী সম্মেলন, ভাসানী কাহিনী, মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, গান্ধী মিশন ডায়েরি, পূর্ব বঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথের ধর্ম তত্ত্ব ও দর্শন, প্রাচ্য প্রতিভা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চ শিক্ষা, স্যার ফিলিপ হার্টগ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য, নবাব সলিমুল্লাহ ও তার সময়, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, হরিশ্চন্দ্র মিত্র, বাঙালি জাতি বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ঢাকার বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য, স্মৃতিতে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ ইত্যাদি। গবেষণার জন্য তিনি সবসময় মৌলিক সূত্র খুঁজতেন। সূত্রের খোঁজে বাংলাদেশের অনেক জায়গায় ঘুরেছেন।

সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ'র স্মৃতি, অগ্রন্থিত লেখার তালাশে কলকাতা, দিল্লী, প্যারিস, লন্ডন এমনকি পাকিস্তানেও গিয়েছিলেন। অনেক দুর্লভ তথ্য, উপকরণ, ডায়রি, পত্রিকা সংগ্রহ করেছিলেন। তার বইগুলোতে সেই তথ্যবহুলতার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। পরিশ্রম এবং মৌলিক সূত্রনির্ভরতার কারণে তার বইয়ের গ্রহণযোগ্যতা ও কদর ছিল বিজ্ঞজনদের কাছে। বাংলাদেশের একাডেমিক দুর্বলতার কারণে যেখানে মানসম্মত গবেষণার কোনো স্কুল বা ধারা তৈরি হয়নি, সেখানে ননএকাডেমিক, ব্যক্তিক জায়গা থেকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর জীবন ও সাহিত্য এর মতো গ্রন্থ ছিল বিস্ময়কর ব্যতিক্রম।

আহমেদ মাওলা: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

Comments